জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প প্রসঙ্গে নতুন চীনা শিল্পরীতি, মুঘল চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন, চিরন্তন সাহায্য, শিল্প রসিক ও বিশেষজ্ঞ, চিত্রকলার চরম উৎকর্ষ, প্রকৃতিপ্রেমের দৃষ্টান্ত, চিত্রশিল্পী, শিল্পীদের উৎসাহ, জাহাঙ্গীরের চিত্রশিল্পে খ্রিস্টানধর্ম, চিত্রশিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগ সম্পর্কে জানবো।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প

বিষয়জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প
মুঘল বাদশাজাহাঙ্গীর
সময়কাল১৬০৫-১৬২৮ খ্রি
চিত্রশিল্পীমনসুর, বিষেণ দাস
জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প

ভূমিকা :- সুলতানি যুগে বৃহৎ পরিসরে চিত্রাঙ্কন হলেও, ছোটো চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি তখনও সমাদর পায় নি। মুঘল যুগেই এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

মুঘল আমলে নতুন চীনা শিল্পরীতি

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল জাতি পারস্য অধিকার করার সময় ভারতীয় বৌদ্ধ, ইরানীয়, বাহ্লীক ও মোঙ্গল ভাবধারায় গঠিত এক নতুন চিনা শিল্পরীতি পারস্যে প্রবেশ করে। এই রীতি তৈমুরের বংশধর বাবর, হুমায়ুনআকবর ভারতবর্ষ-এ বহন করে আনেন। এই রীতির সঙ্গে ভারতীয় রীতির সংমিশ্রণে ভারতে এক নতুন স্থাপত্যশিল্প ও চিত্রশিল্পের উদ্ভব হয়।

জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল চিত্রশিল্পের গোড়াপত্তন

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির ভারতে তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত পথেই ‘মুঘল-চিত্রশিল্প’ নামে এক নতুন চিত্রাঙ্কন রীতির প্রবর্তন করেন। পারস্যের বিখ্যাত শিল্পী আবদুস সামাদই আকবরের সময় প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে মুঘল চিত্রশিল্পের গোড়াপত্তন করেছিলেন।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প নবজীবন লাভ

সামাদের বিশিষ্ট কিছু অঙ্কিত চিত্র জাহাঙ্গির সম্পাদিত ‘গুলশান অ্যালবাম’-এ স্থান পেয়েছে। জাহাঙ্গিরই এই চিত্রশিল্পের চরম পৃষ্ঠপোষক এবং এই চিত্রশিল্প এক নবজীবন লাভ করে।

জাহাঙ্গীরের চিরন্তন সাহায্য

প্রকৃতপক্ষে স্থাপত্যশিল্প ও চিত্রশিল্প শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাতেই বিকশিত হয় এবং সেদিক থেকে চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা জাহাঙ্গির নিরলসভাবে করে গেছেন। আবদুস সামাদের নেতৃত্বে আকবরের প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্প বিভাগ ও দরবারে নিযুক্ত চিত্রশিল্পী জাহাঙ্গিরের চিরন্তন সাহায্য পেয়েছেন।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প সম্পর্কে পার্সি ব্রাউনের অভিমত

জাহাঙ্গির শিল্পীর ভালো অঙ্কিত চিত্র সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়ে ক্রয় করতেন। আধুনিক এক শিল্প সমালোচক পার্সি ব্রাউন জাহাঙ্গিরকে ‘the type of rich collector, perennial through the ages’ বলে বর্ণনা করেছেন।

শিল্প রসিক ও বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীর

  • (১) তিনি স্বয়ং যে একজন চিত্র সমালোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর আত্মজীবনীতে অকপটে ব্যক্ত করেছেন। তিনি যে চিত্রশিল্প খুবই ভালোবাসতেন, তাও অকপটে স্বীকার করেছেন। এবং বলেছেন, ছবি দেখলেই তিনি বলে দিতে পারবেন কোন চিত্রকর সেটি এঁকেছেন।
  • (২) এর থেকেই তাঁর চিত্রশিল্পের প্রতি মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এমনকি তিনি দাবি করেছেন যে, কোনো চিত্র যদি কয়েকজন শিল্পী একত্রে এঁকে থাকেন, তিনি তাও বলে দিতে পারতেন কোন শিল্পী চিত্রের কোন অংশটি এঁকেছেন। সত্যই তিনি ছিলেন একজন শিল্প রসিক ও বিশেষজ্ঞ।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রকলার চরম উৎকর্ষ

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে চিত্রকলার চরম উৎকর্ষ ঘটে। চিত্র-সমালোচকের খ্যাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যক্তিগত জীবনে জাহাঙ্গিরের প্রকৃতিপ্রেম। তিনি ভ্রমণ ও খেলা ভালোবাসতেন। মদ, সাহিত্য ও শিল্পকে একই সঙ্গে তিনি ভালোবেসেছিলেন।

বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে সূক্ষ্ম শিল্পানুভূতির জন্ম

  • (১) বাবরের মতোই পারস্য জাতির সাংস্কৃতিক গুণাবলি তিনি অর্জন করেছিলেন এবং বাবরের মতোই তিনি বাগান, ফুল ও প্রাকৃতিক দৃশ্য ভালোবাসতেন। জাহাঙ্গিরই একমাত্র মুঘল সম্রাট, যিনি এই আকর্ষণেই উনিশবার কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন।
  • (২) কাশ্মীরের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল, ফল, বৃক্ষ প্রভৃতি তাঁর মনে সূক্ষ্ম শিল্পানুভূতির জন্ম দেয়। তিনি তাঁর শিল্পীদের দিয়ে এগুলি পুনরায় অঙ্কন করিয়েছিলেন সূক্ষ্ম তুলির টানে।

জাহাঙ্গীরের আমলে প্রকৃতি প্রেমের দৃষ্টান্ত

  • (১) জাহাঙ্গিরের জীবনে অনেক ব্যর্থতা আছে। কিন্তু পার্সি ব্রাউন বলেছেন, তিনিই ছিলেন ‘Soul and spirit of the Mughal Art’. এমনকি তিনি মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
  • (২) তিনি বলেছিলেন, আমার সমাধি উন্মুক্ত থাকবে এবং প্রকৃতির স্বর্গীয় বায়ু, বৃষ্টি ও শিশির বিন্দু আমার কবরের সৌন্দর্য বর্ধন করবে। প্রকৃতির প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসাই আজ তাঁকে লাহোরের এক সুন্দর বাগানে শায়িত রেখেছে। এর থেকেই জাহাঙ্গিরের অতি উচ্চস্তরের এক শিল্পানুরাগের পরিশুদ্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্পী

  • (১) সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই জাহাঙ্গির হিরাটের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আগা-রিজাকে রাজদরবারের নিযুক্ত করেছিলেন, একথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন। আগা-রিজা ছিলেন পারস্যের বিখ্যাত শিল্পী আবু-ই-হাসান-এর পুত্র। তিনিই জাহাঙ্গিরের রাজদরবারে প্রধান চিত্রশিল্পী ছিলেন।
  • (২) জাহাঙ্গিরের পৃষ্ঠপোষকতায় আরও কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পী রাজদরবারে নিযুক্ত হন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফারুক বেগ। ইনি মোঙ্গলীয় চিত্রশিল্পী। ফারুক বেগই পরে আবদুস সামাদের মৃত্যুর পর সমরখন্দের অধিবাসী মহম্মদ নাদির ও মহম্মদ মুরাদের সহযোগিতায় সামাদের সৃষ্ট চিত্রশিল্প বিভাগের প্রধান চিত্রকর হয়ে ওঠেন।
  • (৩) মহম্মদ নাদির ও মহম্মদ মুরাদ ছিলেন মুঘল দরবারের শেষ দুই বিদেশি চিত্রকর। বিরল পশুপাখির চিত্রাঙ্কনে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন উস্তাদ মনসুর। উস্তাদ মনসুর পশুপক্ষীর একেবারে জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করতে পারতেন।
  • (৪) বিষেণদাস ছিলেন দক্ষ ভাস্কর। এখানে উল্লেখ্য, জাহাঙ্গির বিষেণদাসকে পারস্যে প্রতিকৃতি অঙ্কন-শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মনোহর ও গোবর্ধনও ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী।
  • (৫) আর একজন প্রখ্যাত উঁচুমানের শিল্পীর নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন আবুল হাসান। রঙের ব্যবহারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এইসব শিল্পীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাহাঙ্গির একটি চিত্রশালা নির্মাণ করেন।
  • (৬) এঁদের সহযোগিতায় কতকগুলি গ্রন্থের অলংকরণের কাজ সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থ অলংকরণের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাণ্ডুলিপি হল রাজকানোয়ার, যেটি চেস্টার বিটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। নিজামউদ্দিন দলভির সংগৃহীত ‘গজল’ ও ‘রুবাইৎ’-এর চিত্র অলংকরণ খুবই উচুমানের।
  • (৭) এছাড়া হাফিজের ছোটো আকারের নিওয়ান ও আনোয়ার-ই-সুহেলি গ্রন্থের অলংকরণের কাজ প্রকৃতপক্ষে আগা-রিজা অনন্ত, আবুল হাসান ও বিষেণদাসের সমবেত প্রচেষ্টার ফল। এই গ্রন্থ অলংকরণে অত্যন্ত গ্রামীণ সারল্য ও সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

জাহাঙ্গীর কর্তৃক শিল্পীদের উৎসাহিত

জাহাঙ্গির সমসাময়িক ঘটনা, পছন্দসই দৃশ্য, দুষ্প্রাপ্য পশুপাখি, পুষ্প প্রভৃতির প্রকৃতিবাদী চিত্রের অতিরিক্ত উৎসাহী ছিলেন। এছাড়া শিকার, প্রমোদ ও নৃত্যগীতের বহু ছবি এবং বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তির আলেখ্য অঙ্কনের প্রতি শিল্পীদের উৎসাহিত করেছিলেন।

জাহাঙ্গীরের চিত্রশিল্পে খ্রিস্টানধর্ম

জাহাঙ্গিরের সময়ই ইউরোপীয় চিত্রশিল্প ভারতীয় শিল্পীদের প্রভাবিত করে। খ্রিস্টান ধর্মের বিষয়বস্তুও জাহাঙ্গিরের চিত্রশিল্পে স্থান পায়। এমনকি জাহাঙ্গির যিশুখ্রিস্টের প্রতিকৃতি ভালোবাসতেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্পে খাঁটি ভারতীয় চরিত্র

চিত্রকলার প্রতি জাহাঙ্গিরের অনুরাগ সম্পর্কে স্যার টমাস রো ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জাহাঙ্গিরের আমলের চিত্রশিল্পে ইরানীয় প্রভাবের বিলুপ্তি ঘটে। চিত্রকলায় খাঁটি ভারতীয় চরিত্র বিকাশলাভ করে।

জাহাঙ্গীরের আমলে অসাধারণ চিত্রকর্ম

জাহাঙ্গিরের চিত্রগুলির মধ্যে বিশেষ করে অসাধারণ শিল্পী মনসুরের আঁকা কলকাতা জাদুঘর-এ সংরক্ষিত সাইবেরিয়ান সারসটি আজও আমাদের বিস্ময় জাগায়। এছাড়া জাহাঙ্গিরের আজমিরে খাজা সাহেবের দরগাহ পরিদর্শনের যে চিত্রটি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে সংরক্ষিত আছে, তা এককথায় বিস্ময়কর। জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেকের চিত্রটিও অতীব মনোরম।

জাহাঙ্গীরের চিত্রকলায় রাজনৈতিক ঘটনার বিন্যাস

মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গিরের চিত্রকলায় সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনার বিন্যাস দেখা দেয়। নিজের কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে, কিছু চিত্রে তিনি কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন – ইরানের শাহ আব্বাসকে তিনি সাদরে বরণ করছেন, অথবা তাঁর চরমতম শত্রু মালিক অম্বরের ছিন্ন মস্তকে আঘাত করছেন – এরকম দুটি চিত্র সংরক্ষিত আছে ওয়াশিংটনের আর্ট গ্যালারি ও চেস্টার বিটি গ্রন্থাগারে।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প সম্পর্কে অশোক দাসের মন্তব্য

চিত্র সমালোচক অশোক দাস জাহাঙ্গিরের চিত্রশিল্পের এই বৈশিষ্ট্যের দিক আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “was a new feature in the development of Mughal painting”.

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্র শিল্পের বিষয়

  • (১) প্রকৃতপক্ষে জাহাঙ্গির ছিলেন মুঘল চিত্রশিল্পের প্রাণপুরুষ। তাঁর আমলে মুঘল চিত্রশিল্প সজীবতা লাভ করে। জাহাঙ্গিরের চিত্রশিল্পে সাধারণ মানুষের যথাযথ চিত্রণ ভারতীয় চিত্রশিল্পে এই প্রথম এক বিশেষ অবদান।
  • (২) জাহাঙ্গিরের অভিষেক, দোলযাত্রা বা হোলি, দীপাবলি বা দেওয়ালি, তুলাদান প্রভৃতি উৎসব-এ জনতার এক অভূতপূর্ব চিত্র পাওয়া যায়। এমনকি শিকারের দৃশ্য, তাও অবহেলিত হয় নি। তাঁর সময়ে চিত্রশিল্পের তিনটি ধারা, যথা চীনজাপান-এর চিত্রধারা, পারসিক চিত্রশিল্প ও ভারতীয় চিত্রশিল্প একীভূত হয়ে এক নতুন ভারতীয় শিল্পধারা রূপে বিকশিত হয়।
  • (৩) এডওয়ার্ড ও গ্যারেট এই শিল্পধারার বিকাশকে ‘a type which was essentially Indian’ বলে অভিহিত করেছেন। চিত্র সমালোচক পার্সি ব্রাউন জাহাঙ্গিরের চিত্রশিল্প আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল চিত্রশিল্পের গৌরব-রবি অস্তমিত হয়।

জাহাঙ্গীরের আমল চিত্রশিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগ

এই সমস্ত দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, শাহজাহান-এর রাজত্বকালকে যদি মুঘল স্থাপত্য শিল্পের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা যায়, তাহলে জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালকে মুঘল চিত্রশিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগ বলা যেতে পারে।

জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্পের বিভিন্ন দিকের বিকাশ

  • (১) জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে চিত্রশিল্পের বিভিন্ন দিক বিকাশ লাভ করে। মিনিয়েচার চিত্রে আগা-রিজা এবং প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিষণ দাস ও ফারুক বেগ এবং বিচিত্র বিপ্লব সৃষ্টি করেন। মুঘল আমলের প্রতিকৃতি অঙ্কন মূলত ইরানি এবং মুঘলপূর্ব ভারতীয় কলা দ্বারা প্রভাবিত।
  • (২) প্রারম্ভিক মুঘল রীতির ‘তিন-চতুর্থাংশ মুখচিত্রণ’ জাহাঙ্গিরের আমলে প্রায় লুপ্ত হয়ে যায় এবং তার জায়গা নেয় ‘অর্ধ মুখচিত্রণ’। এটিকে মুঘল চিত্রকলার ভারতীয়করণ বলা যেতে পারে। আকবরের রাজত্বকালের শেষদিক থেকেই এই পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যেতে থাকে।
  • (৩) বিচিত্র কর্তৃক অঙ্কিত প্রতিকৃতিগুলিতে ‘এক মুখ’কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষেণদাস ও আবুল হাসান-এর প্রতিকৃতি অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত হওয়ার কথা জাহাঙ্গির তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। এঁদের অঙ্কিত প্রতিকৃতিগুলিতেও ‘অর্ধ মুখচিত্রণ’ পরিলক্ষিত হয় এবং অন্যান্য মুঘল চিত্রকরদের অঙ্কিত প্রতিকৃতিগুলি সম্পর্কেও একথা খাটে।

ইরানি চিত্রকলা থেকে জাহাঙ্গীরের গ্ৰহণ

  • (১) পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতিতে পা-গুলি হত চ্যাপটা এবং একদিকে ঘোরালো এবং হাত সাধারণত থাকত খড়্গামুষ্ঠিবদ্ধ অথবা বিশ্রামভঙ্গিতে এলায়িত কিংবা রত্নালংকারজড়িত। এইসব প্রস্ফুটিত পুষ্পধারক হস্তমুদ্রা ইরানি চিত্রকলা থেকে গৃহীত।
  • (২) অবশ্য সম্রাট ও বিশিষ্ট সন্তগণের প্রতিকৃতিতে হস্তধৃত ভূমণ্ডল-এর চিত্রণ মুঘলরীতিতে মৌলিক। কিছু আঙুলের মুদ্রায় ভারতীয় কলার ছাপ স্পষ্ট। এই কারণেই হস্তমুদ্রা চিত্রণে যে বিভিন্নতা মুঘল চিত্রকলায় চোখে পড়ে, ইরানি চিত্রকলায় কোথাও তা মেলে না। এদিক থেকে বিচিত্র-র কাজগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাহাঙ্গীরের আমলে প্রতিকৃতি অঙ্কন

প্রতিকৃতি অঙ্কনে মনোভাব ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বিচিত্রর প্রয়াস সফল ও প্রশংসনীয়। তাঁর কাজ গায়ক ও বাদক এবং অন্য এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গায়কের মুখভঙ্গি ও আলাপক্রিয়া, শিকারির মন্ত্রমুগ্ধ ও বিভোর দশার চিত্রণ ছবিতে লয় ও গতির প্রতীক।

জাহাঙ্গীরের আমলে সাধারণ মানুষের যথাযথ চিত্রণ

  • (১) সাধারণ মানুষের যথাযথ চিত্রণ ভারতীয় কলায় জাহাঙ্গিরের চিত্রকরদের বিশেষ অবদান। সাধারণ মানুষের যথাযথ চিত্রণে বিশেষ করে বৃক্ষ, কুটির, চরকা এবং পুরোভাগে বিশ্রামরত ক্লান্ত গ্রামবাসী গ্রামীণ জীবনের পূর্ণ দৃশ্যগত প্রভাব সৃষ্টি করে। এর সমতুল্য দৃষ্টান্ত মুঘল চিত্রকলায় দুর্লভ।
  • (২) বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্যমী লোকদের দৈনন্দিন জীবনের পটভূমি ও পরিসরে চিত্রণ জাহাঙ্গির ও শাহজাহান-এর আমলের চিত্রকরদের কাজের অচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। সাধারণ মানুষের এত বিশদ চিত্রণ মুঘলপূর্ব কিংবা মুঘল আমলের ভারতীয় কলায় আর দেখা যায় নি। জাহাঙ্গিরের সময় মুঘল চিত্রকলায় জনজীবনের প্রতিনিধিত্ব হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বয়সের সক্ষম চিত্র

  • (১) বিচিত্র-র কাজগুলিতে মানুষের বয়সেরও সক্ষম চিত্রণ দেখা যায়। জাহাঙ্গির বিদ্বানকে সম্মান দিচ্ছেন এরকম একটি প্রতিকৃতিতে জাহাঙ্গিরের প্রৌঢ়, দুর্বল, শিথিল শরীর এবং মুখের স্থির ও অলসভাব থেকে এটির সময়কাল ১৬২৫-২৮ খ্রিস্টাব্দের বলেই মনে হয়।
  • (২) জাহাঙ্গির-এর সঠিক বয়সের অভিব্যক্তি একমাত্র এই ছবিটিতেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে। সংলক্ষণরত প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিচিত্র স্পষ্টতই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এই জাতের অন্যান্য চিত্রকরদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন আবুল হাসান, বিষেণদাস, মনোহর, গোবর্ধন, হাশিম প্রমুখ।

জাহাঙ্গীরের আমলে পাড় চিত্রণ

মুঘলরীতিতে পাড় চিত্রণ অপেক্ষাকৃত উন্নত। জাহাঙ্গিরের আমলে এক পৃথক শাখার কলা হিসাবে পাড় চিত্রণের বিকাশ হয় এবং আলংকারিক ও জ্যামিতিক আকার ছাড়াও ভূদৃশ্য, পশু-পাখি-মানুষ, প্রতিকৃতি, পুষ্পিত লতা, পাশ্চাত্য কাজ ও খোদিত চিত্রাবলির অসাধারণ কদর পেতে থাকে। শাহজাহানের আমলে প্রথাটি পূর্ণভাবে বিকশিত হয় এবং প্রতিকৃতি অঙ্কন ও পাড় চিত্রণ অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে।

উপসংহার :- জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চিত্রশিল্পের অন্তর্নিহিত প্রাণ ও সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়। জাহাঙ্গিরের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব, তিনি চিত্রশিল্প-রীতিকে পারসিক প্রভাবমুক্ত করে ভারতীয় শিল্পে পরিণত করেন।

(FAQ) জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্প সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মুঘল চিত্রশিল্পের প্রাণপুরুষ কাকে বলা হয়?

জাহাঙ্গীর।

২. কোন মুঘল সম্রাট ১৯ বার কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন?

জাহাঙ্গীর।

৩. জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রশিল্পী কারা ছিলেন?

উস্তাদ মনসুর, বিষেণ দাস, আবুল হাসান, গোবর্ধন।

Leave a Comment