ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতের সম্পদের বহির্গমন প্রসঙ্গে পলাশির লুণ্ঠন, আর্থিক নিষ্ক্রমণের কথা স্বীকার, পলাশি লুণ্ঠনের ধারা, কোম্পানির কর্মচারীদের উৎকোচ ও উপঢৌকন, স্পিয়ারের অভিমত, টমসন ও গ্যারাটের অভিমত, ব্যক্তিগত বাণিজ্য, কোম্পানির বেআইনি চুক্তি, ঠিকাদারি, কার্ল মার্কসের অভিমত, স্বাধীন বণিক, কোম্পানির কর্মচারীদের স্বদেশে অর্থ প্রেরণ, কোম্পানির মাধ্যমে নিষ্কাশন, নির্গমনের পরিমাণ, নির্গমন তত্ত্বের বিরোধিতা, সম্পদ নির্গমন যুক্তিযুক্ত নয়, ভারতীয়দের দারিদ্র্যের কারণ সম্পদের নির্গমন ও এই প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র দত্তের অভিমত সম্পর্কে জানবো।
সম্পদের বহির্গমণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | সম্পদের বহির্গমণ |
অর্থ | বাংলার অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ড-এ পাচার |
সূচনা কাল | পলাশীর যুদ্ধ -এর পর |
মূল প্রবক্তা | দাদাভাই নৌরজি |
ভূমিকা:- পলাশির যুদ্ধের পর রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণে সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ জলস্রোতের মতো ইংল্যাণ্ডে চলে যায় এবং এর বিনিময়ে ভারত কোনও উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পায় নি। ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতরা এই ঘটনাকে ‘আর্থিক নিষ্ক্রমণ’, ‘আর্থিক নির্গমন’, ‘সম্পদের বহির্গমন’ বা ‘Economic Drain’ বলে অভিহিত করেছেন।
সম্পদের বহির্গমণ প্রসঙ্গে পলাশি লুণ্ঠন
ব্রুকস্ অ্যাডামস (Brooks Adams) নামে জনৈক গবেষক এই ঘটনাকে ‘পলাশি লুণ্ঠন’ বা ‘Plassey plunder’ বলে অভিহিত করেছেন। এরপর থেকে ‘পলাশি লুণ্ঠন’ কথাটি চালু হয়ে গেছে।
সম্পদের বহির্গমণ-এর বাংলা শব্দ ব্যবহার
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অম্লান দত্ত Economic Drain কথাটির বাংলা করেছেন ‘অপহার’।
সম্পদের বহির্গমণ বা আর্থিক নিষ্ক্রমণের কথা স্বীকার
সমকালীন ইংরেজ শাসকদের মধ্যে ভেরেলেস্ট, ফিলিপ ফ্রান্সিস, ওয়ারেন হেস্টিংস, জন শোর, জেমস গ্রান্ট এবং বিশিষ্ট ইংরেজ রাজনীতিবিদ এডমণ্ড বার্ক-ও পলাশি লুণ্ঠন বা আর্থিক নিষ্ক্রমণের কথা স্বীকার করেছেন।
পলাশি লুণ্ঠনের ধারা
এই আর্থিক নির্গমন হয়েছিল মোটামুটি দু’টি ধারায়। যথা –
- (১) বেসরকারিভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ বণিক প্রভৃতির দ্বারা বাংলার সম্পদ লুন্ঠন এবং তা ইংল্যাণ্ডে পাঠানোর ফলে সম্পদের নির্গমন।
- (২) কোম্পানির বাণিজ্য, আর্থিক ও রাজস্বনীতির ফলে বাংলার সম্পদের নির্গমন।
কর্মচারীদের উৎকোচ ও উপঢৌকনের মাধ্যমে সম্পদের বহির্গমণ
- (১) ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীরা উৎকোচ, উপঢৌকন, নজরানা ও অন্যান্য সূত্রে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ঐ অর্থ দেশে পাঠায়। এই অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
- (২) ক্লাইভ ছিলেন এই লুন্ঠনের পথপ্রদর্শক। টাকার নেশায় উন্মত্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন — “টাকা, শুধু টাকা! নষ্ট করার মতো সময় একদম নেই” (“Money ! Money! and no time to be lost )।
- (৩) পলাশির যুদ্ধের পর মিরজাফর সিংহাসনে বসে কোম্পানির কর্মচারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্যহন। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে একাই পান প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা এবং বার্ষিক ৩০ হাজার পাউন্ড আয়ের একটি জায়গির।
- (৪) মিরকাশিমকে সিংহাসনে বসিয়ে গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট ও কলকাতা কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যরা পান ৩২ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকা। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মিরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নজমউদ্দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে কোম্পানির কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ৬২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা লাভ করেন।
- (৫) রেজা খাঁ ‘নায়েব নাজিম’ পদ লাভের জন্য কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীদের ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা দেন। এক কথায়, বাংলায় তখন ঢালাও লুণ্ঠন চলতে থাকে।
- (৬) বলা বাহুল্য, এই লুণ্ঠন-নীতি বাংলাতে শুরু হলেও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও অনুরূপ পদ্ধতিতে টাকা সংগ্রহ করে ইংল্যাণ্ডে পাঠানো হত।
সম্পদের বহির্গমণ সম্পর্কে স্পিয়ারের অভিমত
ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার (P. Spear) পলাশি-পরবর্তী এই যুগকে “প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ” (‘Age of open and unashamed plunder’) বলে অভিহিত করেছেন।
সম্পদের বহির্গমণ সম্পর্কে টমসন ও গ্যারাটের অভিমত
ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাট (Thompson and Garratt) বাংলাকে একটি ‘টাকার গাছ’ (‘Pagoda tree’) বলে অভিহিত করেছেন, যা নাড়া দিয়ে টাকা কুড়োনো যায়।
ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদের বহির্গমণ
- (১) ১৭৫৭-১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর উপার্জন করে এবং তা ইংল্যাণ্ডে পাঠায়।
- (২) ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ (Dr. N.K. Sinha) বলেন যে, উৎকোচ বা নজরানা অপেক্ষা কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্লাইভ, জনস্টন, সিনিয়র, লিসেস্টার, সাইকস্ প্রমুখ কপর্দকহীন অবস্থায় ভারতে এসে, দেশে ফিরেছিলেন লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে।
- (৩) সাইকস্, ভেরেলেস্ট, বারওয়েল প্রমুখ কর্মচারীরা কয়েকটি অত্যাবশ্যক পণ্যের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ আয় করেন। বারওয়েল নিজেই স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা আয় করেন। মুর্শিদাবাদ-এর ব্রিটিশ রেসিডেন্ট সাইস্ মাত্র দু’বছরের মধ্যেই রোজগার করেন প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা।
- (৪) এই সব কর্মচারীরা অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ইংল্যাণ্ডে ফিরে গিয়ে রাজার মতো জীবনযাপন করত এবং নিজেদের তারা ভারতীয় নবাব’ (Indian Naboobs) বলে অভিহিত করত।
কর্মচারীদের বেআইনি চুক্তি ও ঠিকাদারির মাধ্যমে সম্পদের বহির্গমণ
- (১) বিভিন্ন প্রকার গোপন ও অবৈধ চুক্তি এবং ঠিকাদারির মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর আয় করত। এই ব্যাপারে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন তুলনাহীন। তিনি স্বনামে, বেনামে বহু ‘কনট্রাক্ট’ নিয়েছিলেন।
- (২) চার্লস গ্রান্ট, চার্লস ব্রান্ট, চার্লস ক্রাফট, জন সুলিভ্যান, জন বেলি প্রমুখ হেস্টিংসের প্রিয়পাত্ররাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরা সাঁকো তৈরি, বাঁধ নির্মাণ, সেনাবাহিনীর পোশাক ও মাংস সরবরাহ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের ‘কনট্রাক্ট’ নিয়ে প্রচুর টাকা রোজগার করেন।
- (৩) ‘বোর্ড অফ ট্রেড (Board of Trade)-এর সদস্যরাও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ রোজগার করতেন। কোম্পানির মাল কেনার সময় তাঁরা গরিব চাষি, তাঁতি ও দেশীয় বণিকদের কাছ থেকে বলপূর্বক কমিশন আদায় করতেন।
সম্পদের বহির্গমণ সম্পর্কে কার্ল মার্কসের অভিমত
সাম্যবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কস লিখেছেন যে, “অ্যালকেমিস্টদের (যারা কৃত্রিম সোনা তৈরি করতে পারেন) চেয়েও ধূর্ত এই প্রিয় পাত্ররা শূন্য থেকে সোনা তৈরি করত।”
স্বাধীন বণিক
কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ইংল্যাণ্ডের কিছু স্বাধীন বণিক (Free Merchants)-কে এই দেশে বাণিজ্যের অনুমতি দেয়। এই সব লোভী ও দুর্নীতি পরায়ন স্বাধীন ব্যবসায়ীরা বাংলার চাষি, তাঁতি ও বণিকদের ওপর জুলুম করে ও ভয় দেখিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্যাদি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করত। ইংরেজ বণিকরা আবার এই মাল বেশি দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুঠত।
স্বাধীন বণিক ও কোম্পানির কর্মচারীদের স্বদেশে অর্থপ্রেরণ
কোম্পানির কর্মচারীরা এই বেআইনি অর্জিত অর্থ নানাভাবে স্বদেশে প্রেরণ করত। যেমন–
- (১) ক্লাইভ, হেস্টিংস এবং কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা হীরে-জহরত ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর কিনে তা ইংল্যাণ্ডে পাঠাত এবং ইংল্যাণ্ডে সেগুলি বিক্রি করে নগদ অর্থে পরিণত করা হত।
- (২) কোম্পানির কর্মচারীরা ‘বিল অফ এক্সচেঞ্জ’ মারফৎ-ও এই টাকা স্বদেশে পাঠাত। ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার প্রভৃতি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাণিজ্যের জন্য এ দেশে যে মালপত্র কিনত তার টাকা দিত ইংরেজ কর্মচারীরা।
- (৩) এতে তাদের সুবিধাই হয়েছিল কারণ মালপত্র কেনার জন্য তাদের আর দেশ থেকে সোনা রূপা আনতে হত না। পরে এই কোম্পানিগুলি ইংল্যাণ্ডে সেই টাকা মিটিয়ে দিত।
- (৪) এর ফলে বাংলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল দু’ভাবে। একদিকে দেশের সম্পদ বাইরে চলে যাচ্ছিল, আবার অন্যদিকে বিদেশি বণিকরা মালপত্র কিনবার জন্য পূর্বে যে সোনা-রূপা বাংলায় আনত, তা বন্ধ হয়ে যায়।
- (৫) কলকাতা ও বোম্বাই ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন ব্রিটিশ বাণিজ্যকেন্দ্র, যথা—জেদ্দা, এলেপ্পো, বসরা, কায়রো মারফৎ এই অর্থ স্বদেশে প্রেরিত হত।
- (৬) ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজ বণিকরা নিজেদের বাণিজ্য সংস্থা বা এজেন্সি হাউস’ গড়ে তোলে। এই এজেন্সি হাউসগুলি বণিকদের টাকা স্বদেশে পাঠাবার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
কোম্পানির মাধ্যমে সম্পদের বহির্গমণ
ইংরেজ কোম্পানির অনুসৃত নীতিও নানাভাবে সম্পদের নির্গমন ঘটাত।যেমন –
- (১) পলাশির যুদ্ধের পূর্বে কোম্পানি ভারত থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি ক্রয় করে তা ইউরোপ-এর বাজারে বিক্রি করত। এই কেনাকাটাকে বলা হত ‘ইনভেস্টমেন্ট’ (Investment) বা বিনিয়োগ। এর জন্য কোম্পানি নিজের দেশ থেকে সোনা-রূপা বা বুলিয়ান আমদানি করত।
- (২) পলাশির যুদ্ধের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং বাংলায় নবাব তৈরির ব্যবসা, দেওয়ানি লাভ প্রভৃতির মাধ্যমে কোম্পানির হাতে প্রচুর অর্থ আসে। কোম্পানি এই অর্থই বাংলার বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে ‘ইনভেস্টমেন্টের’ জন্য স্বদেশ থেকে আর সোনা-রূপা আমদানির প্রয়োজন থাকে না।
- (৩) জেমস গ্রান্ট -এর মতে বছরে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। এইভাবে বাণিজ্যিক লগ্নি মারফৎ বাংলার টাকা বাইরে চলে যেতে থাকে।
- (৪) ইউরোপের বাজারে চীন-এর সবুজ চা ও সাদা রেশমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় কোম্পানি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলার সোনা-রূপা চীনে পাঠাতে থাকে। ১৭৬০-এ এর পরিমাণ ছিল বার্ষিক ২৪ লক্ষ টাকা। ১৭৭০-এ এর পরিমাণ কমে হয় ২০ লক্ষ টাকা। পরে বাংলা থেকে আফিং রপ্তানি করে চীনা বাণিজ্যের মূলধন সংগ্রহ করা হত।
- (৫) কোম্পানির অংশীদারদের ‘ডিভিডেন্ট ’এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রাপ্য বাবদ কোম্পানি বাংলার রাজস্বের একটি বিরাট অংশ ইংল্যাণ্ডে পাঠাত। ডঃ যোগেশচন্দ্র সিংহ (Dr. J. C. Sinha) বলেন যে, ১৭৬৬ থেকে ১৭৮০-র মধ্যে এই বাবদ বাংলা থেকে মোট ১ কোটি পাউন্ড ইংল্যাণ্ডে পাঠানো হয়।
- (৬) বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর প্রশাসনিক ব্যয় এবং ইনভেস্টমেন্ট বাবদ খরচও যেত বাংলার রাজস্ব থেকে। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী-র মতে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর এই বাবদ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা বাংলা থেকে পাঠানো হত।
- (৭) কোম্পানির রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধখাতে যে বিপুল ব্যয় হয় তার বিরাট অংশ যেত বাংলার রাজস্ব থেকে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলির মধ্যে চারটি মহীশূর যুদ্ধ, প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ এবং ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের কথা বলা যায়।
- (৮) ভারতের মাথাভারি প্রশাসনিক কাঠামো, ইংরেজ কর্মচারীদের মোটা বেতন, ইংল্যাণ্ডের ‘ইণ্ডিয়া অফিস’-এর খরচ—সবই মেটানো হত বাংলার রাজস্ব থেকে।
সম্পদের নির্গমনের পরিমাণ
এইভাবে ভারত থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ ইংল্যাণ্ডে গেছে তার পরিমাণ হিসেব করা সম্ভব নয়। এই ব্যাপারে নানা পণ্ডিত নানা ধরনের হিসেব দিয়েছেন। যেমন –
- (১) যোগেশচন্দ্র সিংহ বলেন যে, ১৭৫৭-৮০ কালপর্বে ভারত থেকে ইংল্যাণ্ডে যায় ৩৮ কোটি ৪ লক্ষ পাউন্ড। স্যার পি. জে. গ্রিফিথ-এর মতে ১৭৮০ থেকে ১৮১৩-র মধ্যে এই নির্গমনের পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি পাউন্ড।
- (২) হোল্ডেন ফারবার-এর হিসেব অনুযায়ী ১৭৮৩-৯৩-এর মধ্যে এর পরিমাণ ছিল ১৮ লক্ষ পাউন্ড। অধ্যাপক পি. জে. মার্শাল এই ব্যাপারে মোটামুটিভাবে বার্ষিক ৫ লক্ষ পাউন্ডের কথা বলেন।
- (৩) এই ব্যাপারে কোনও সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব না হলেও এ কথা ঠিকই যে, এই সময় বাংলা তথা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদের নির্গমন হয়েছিল।
- (৪) মেজর উইনগেট (Major Wingate) নামে জনৈক ইংরেজ দুঃখ করে বলেন যে, ভারত থেকে যে পরিমাণ টাকা ইংল্যাণ্ডে পাঠানো হয়, তার কিছুই ভারতে খরচ করা হয় না।
- (৫) ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সিলেক্ট কমিটির সভাপতি (পরে ভারতের গভর্নর জেনারেল) লর্ড এলেনবরা (Lord Ellenborough) বলেন যে, ভারত থেকে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ লক্ষ পাউন্ড ব্রিটেনে আসে, কিন্তু বিনিময়ে ভারতকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম ভিন্ন অন্য কিছু দেওয়া হয় না।
- (৬) মাদ্রাজের রাজস্ব বোর্ডের সচিব জন সুলিভ্যান (John Sullivan) বলেন যে, “আমাদের শাসনব্যবস্থা অনেকটা স্পঞ্জের মতো। গঙ্গা-তীরবর্তী দেশ থেকে এই স্পঞ্জধর্মী শাসন যা কিছু সম্পদ সব শুষে নেয় এবং টেমস্-তীরবর্তী দেশে এনে তা নিংড়ে দেয়।” দাদাভাই নৌরজী ও রমেশচন্দ্র দত্তের রচনায় এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে।
সম্পদের নির্গমন তত্ত্বের বিরোধিতা
বাংলার সম্পদের সত্য সত্যই নির্গমন হয়েছিল কিনা তা নিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা বিতর্ক তুলেছেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত গুলি হল –
- (১) স্যার জন স্ট্রাচি বলেন যে, ভারতে শাস্তি-শৃঙ্খলা প্রবর্তনের মূল্য হিসেবে ভারতের অর্থ ইংল্যাণ্ডে গেছে। এই অর্থ দিয়ে ইংল্যাণ্ডে ভারতের জন্য অনেক কিছু কেনা হয় এবং ভারতের জন্য লণ্ডনের বাজার থেকে কম সুদে ঋণ গ্রহণ করা হয়। তখন এত কম সুদে ভারতে ঋণ পাওয়া যেত না। এর উত্তরে বলা হয় যে, সুদের হার যাই হোক না কেন, এই অর্থ ভারতে থাকলে তা জনগণের উপকারেই লাগত।
- (২) স্যার থিওডোর মরিসন তাঁর ‘Economic Transition in India’ গ্রন্থে বলেন যে, বাংলা থেকে মাল রপ্তানি হওয়ায় বাংলার কোনও ক্ষতি হয় নি, কারণ আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হলে লাভই হয়।
- (৩) বাংলার রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে রেশম তাঁত ও চিনি শিল্পের প্রসার ঘটে, জাহাজে মাল চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং এই সবের ফল হিসেবে দেশে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং এই রপ্তানির ফলে ভারতের মঙ্গলই হয়েছে।
- (৪) মরিসনের বক্তব্যের উত্তরে বলা যায় যে, রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও তার দ্বারা বাংলার বণিক, তাঁতি বা অন্যান্য উৎপাদকদের কোনও উপকার হয় নি কারণ কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা কখনোই তাদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে মাল কিনত না।
- (৫) দাদনি ও এজেন্সি প্রথার মাধ্যমে তারা বাংলার বণিক ও উৎপাদকদের সর্বনাশ করে এবং কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের দাপটে এ দেশের সাধারণ মানুষ-জন শোষিত হয়। জেমস্ স্টুয়ার্ট বলেন যে, রপ্তানির ফলে বাংলা ধনশালী হয় নি।
- (৬) পি.জে.মার্শাল বলেন যে, বাংলা থেকে যদি সত্যই সম্পদের নির্গমন হয়ে থাকে তবে তা একতরফা হয় নি —বিনিময়ে বাংলাও নানাভাবে উপকৃত হয়। তিনি বলেন যে, কোম্পানির সেনাদল বাংলাকে রক্ষা করে। পূর্বে এর জন্য নবাবকে অর্থব্যয় করতে হত।
- (৭) কোম্পানি বাংলাকে নিখরচায় একটি সুন্দর প্রশাসন উপহার দেয়। কোম্পানিকে বাণিজ্যে সাহায্য করে অনেক দেশীয় গোমস্তা ধনকুবের হয়ে ওঠে এবং কোম্পানির মুনাফার কিছু অংশ বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিতেও ব্যয় করা হয়। সুতরাং তাঁর মতে এই নির্গমন একতরফা ছিল না বা বাংলার পক্ষে ক্ষতিকারকও ছিল না।
সম্পদের নির্গমন যুক্তিযুক্ত নয়
- (১) মার্শাল, গ্রান্ট প্রমুখ বলেন যে ‘নির্গমন’ কথাটি আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ মোগল আমলেও বাংলার সুবাদার ও দেওয়ানরা রাজস্ব হিসেবে প্রচুর অর্থ দিল্লিতে পাঠাতেন।
- (২) ভারতীয় পণ্ডিতরা অবশ্য এই সব যুক্তি মানেন না। বলা হয় যে, দিল্লি ভারতেরই অংশ এবং মোগলরা ভারতীয়। দিল্লিকে রাজস্ব প্রদানের অর্থ নির্গমন নয়। মোগলরা যে অর্থ নিত তা দেশের অভ্যন্তরে দেশবাসীর স্বার্থেই ব্যয় হত, কিন্তু কোম্পানি অর্থ নিয়ে যেত ইংল্যাণ্ডে।
ভারতের দারিদ্র্যের কারণ সম্পদ নির্গমন
জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মতে সম্পদের নির্গমন একটি বাস্তব ঘটনা এবং ভারতের দারিদ্রের কারণই হল ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতীয় সম্পদের নির্গমন।
সম্পদের নির্গমন সম্পর্কে রমেশচন্দ্র দত্তের অভিমত
রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, পৃথিবীর কোনও দেশে সম্পদ নির্গমনের এত ন্যক্কারজনক উদাহরণ আর দেখা যায় না। তাঁর মতে, ইংল্যাণ্ডকে যদি অন্য কোনও দেশে এত বিপুলসম্পদের অর্ধেকও পাঠাতে হত, তাহলে সেখানে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিত তা সমগ্র ইংল্যাণ্ডবাসীকে গ্রাস করত।
উপসংহার:- স্যার জন শোর (John Shore ) বলেন যে, “ভারতের সুখ-শান্তির দিন শেষ হয়ে গেছে। ভারতীয় সম্পদের এক বিশাল অংশ বাইরে চলে গেছে। অপশাসনের হীন অবস্থায় ভারতের সমস্ত শক্তিকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।”
(FAQ) সম্পদের বহির্গমন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা ও ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে কোনাে প্রতিদান ছাড়াই বিপুল পরিমাণ অর্থ, বিভিন্ন পণ্য ও উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ইংল্যান্ডে চালান করেছিল।এই ঘটনাটিই ঐতিহাসিক ও সমালােচকদের মতে সম্পদের নির্গমন বা অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণ ( Economic Drain ) নামে পরিচিত।
দাদাভাই নৌরজি তাঁর ‘Poverty and Unbritish Rule in India’গ্ৰন্থে (১৮৬৭ সালে)।
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অর্থ ও সম্পদকে দু – হাত ভরে ভারত থেকে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে পাচার করেছিল।বিদেশি ইংরেজরা সােনা, রুপা বা কোনাে পণ্যসামগ্রীর বিনিময়ে এই সম্পদের নির্গমন ঘটায়নি, তাই এই ঘটনাকে অনেকে লুণ্ঠন বলে উল্লেখ করেছেন । ব্রুকস অ্যাডামস আর্থিক নির্গমনের এই ঘটনাকে ‘পলাশীর লুণ্ঠন’ বা ‘Plassey Plunder’ বলে অভিহিত করেছেন ।