সন্ত্রাসের রাজত্ব বা শাসন

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব, সন্ত্রাসের রাজত্বের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকদের মতামত, বৈদেশিক আক্রমণ, ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, সন্ত্রাসের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, সন্ত্রাসের সাংবিধানিক ভিত্তি, সন্ত্রাসের তিনটি পর্ব, সন্ত্রাসের ভয়াবহতা, লাল সন্ত্রাস, সন্ত্রাসের অবসান, সন্ত্রাসের প্রকৃতি, সন্ত্রাসের সাফল্য, সন্ত্রাসের বিপক্ষে যুক্তি, সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তি, সম্পর্কে জানবো।

সন্ত্রাসের রাজত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাসন্ত্রাসের রাজত্ব বা শাসন
সময়কাল২ জুন, ১৭৯৩ – ২৭ জুলাই, ১৭৯৪
স্থানফ্রান্স
লাল সন্ত্রাস১৩ এপ্রিল – ২৭ জুলাই, ১৭৯৪
নায়করোবসপিয়ার
সন্ত্রাসের রাজত্ব

ভূমিকা:- ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই পর্যন্ত তেরো মাস ফরাসি বিপ্লব -এর ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ, ঘটনাবহুল ও ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই কালপর্বে ফ্রান্সের ইতিহাসে যে ধরনের আত্মঘাতী ও হিংসাশ্রয়ী ঘটনা ঘটে, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। এই কাল পর্ব সন্ত্রাসের রাজত্ব নামে পরিচিত।

সন্ত্রাসের শাসনের কারণ

এই হিংসাত্মক ঘটনার কারণ গুলি হল নিম্নরূপ। –

(ক) ঐতিহাসিকদের মতামত

সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হওয়ার সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নানা কথা বলেছেন। যেমন –

  • (১) তেইন (Taine) বলেন যে, বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পরিবর্তে কিছু উগ্র, অসাধু ও ক্ষমতালোভী মানুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তারাই গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র-বিধ্বংসী সন্ত্রাসমূলক কাজে অবতীর্ণ হয়।
  • (২) ওলার (Aulard)-এর মতে, বৈদেশিক যুদ্ধই সন্ত্রাসের শাসন নিয়ে আসে। শত্রু-বেষ্টিত ফ্রান্সের জন্য আত্মরক্ষার অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তাঁর মতে, দেশ ও বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য এমন কঠোর ও হৃদয়হীন শাসন অপরিহার্য ছিল।
  • (৩) জোরেস (Jaures), মাতিয়ে (Mathiez) প্রমুখের মতে, কেবলমাত্র যুদ্ধ জয় নয়-সমাজ-বিপ্লব প্রতিষ্ঠা এবং সাঁকুলেৎদের দাবি-দাওয়া মিটিয়ে দেওয়ার জন্য জোকোবিন দল সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
  • (৪) অধ্যাপক সবুল (Soboul) বলেন যে, সাঁকুলেৎদের প্রবল চাপের মুখে পড়েই জেকোবিন দল সন্ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়।
  • (৫) অধ্যাপক ডেভিড টমসন (David Thomson)-এর মতে, প্রচলিত শাসনব্যবস্থা দ্বারা দেশের অভ্যন্তরে প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলন এবং বৈদেশিক আক্রমণ একত্রে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না—এ জন্যই সন্ত্রাস অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
  • (৬) সিডেনহাম (Sydeinham) সন্ত্রাসকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে বলেছেন যে, দেশরক্ষার প্রয়োজন সন্ত্রাসের মৌলিক বা একমাত্র কারণ নয়। বাস্তিল দুর্গের পতন-এর পর থেকে ফ্রান্সে যে হিংসার পরিবেশ গড়ে ওঠে সন্ত্রাস তারই সন্তান।

(খ) বৈদেশিক আক্রমণ

  • (১) ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের (২১শে জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রিঃ) ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ইউরোপ-এর বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরা বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি শক্তিজোট গঠন করেন।
  • (২) ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া ও নেপলস্ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিজোট গঠন করে এবং দ্রুত ফ্রান্স অভিমুখে অগ্রসর হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হতে থাকে।
  • (৩) ফরাসি সেনাপতি দামরিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগদান করেন। শত্রু বাহিনী ফ্রান্সের উত্তর-পূর্ব সীমানা অতিক্রম করে দ্রুত প্যারিস অভিমুখে অগ্রসর হয়। এর ফলে গঠিত ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও জাতির নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।

(গ) আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি

  • (১) ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও তখন চলছে চরম অরাজকতা ও প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলন। চরম অন্নাভাব, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মহার্ঘতা ও অভাব এবং খাদ্যের সন্ধানে প্যারিসে বহিরাগতদের ভিড় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
  • (২) জনসাধারণের একবৃহদংশ তখন প্রকাশ্যে প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরোধিতা করতে থাকে, সরকারি আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে এবং কর প্রদানে ও সেনাদলে যোগদানে অসম্মত হয়। বিদেশি গুপ্তচরে দেশ ছেয়ে যায়।
  • (৩) ফ্রান্স তখন মজুতদার, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। রাজতন্ত্রের সমর্থকরা বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লা-ভেণ্ডি, রিতানি, লায়নস, তুলো, বোন, মার্সেই প্রভৃতি স্থান ছিল রাজতন্ত্রীদের প্রধান ঘাঁটি।
  • (৪) ফ্রান্সের ৮৩ টি প্রদেশ (ডিপার্টমেন্ট)-এর মধ্যে ৬০টি প্রদেশেই বিদ্রোহ শুরু হয়। লা ভেভি-র বিদ্রোহী কৃষকদের সঙ্গে ক্ষুব্ধ যাজকরাও (ধর্মযাজকদের সংবিধানের জন্য) যোগ দেন।
  • (৫) জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির স্বার্থে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সে এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তারা উপলব্ধি করেন যে, প্রজাতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দেশে শৃঙ্খলা স্থাপন- যা সম্ভব একমাত্র ভীতি-প্রদর্শন ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
  • (৬) ন্যাশনাল কনভেনশন সিদ্ধান্ত নেয় যে, জরুরি পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের সরকার হবে বিপ্লবী এবং যতদিন না দেশে শান্তি ফিরে আসে এই ব্যবস্থাই চলতে থাকবে। তাঁরা প্রচার করতে থাকেন যে, সন্ত্রাসই হচ্ছে দ্রুত ও বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারের পথ।

সন্ত্রাসের রাজত্ব

বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ প্রবর্তিত এই শাসনব্যবস্থা ‘সন্ত্রাসের শাসন’ নামে পরিচিত। মোটামুটিভাবে এর স্থায়িত্বকাল হল ২রা জুন, ১৭৯৩ থেকে ২৭শে জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

সন্ত্রাসের শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

অধ্যাপক ডেভিড টমসনের মতে, সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল তিনটি —জোকোবিন ক্লাব, কমিউন এবং কনভেনশনের বিভিন্ন কমিটি।

(১) জেকোবিন ক্লাব

এই ক্লাব ছিল সন্ত্রাসের প্রাণকেন্দ্র। বিপ্লবের প্রাক্কালে সারা দেশ জুড়ে এর এক হাজারেরও বেশি শাখা ছিল। এগুলির কাজ ছিল জনমত গঠন, আইনসভার উপর চাপ সৃষ্টি এবং প্রতি-বিপ্লবীদের দমন। এই ক্লাবই ছিল তৎকালীন ফ্রান্সের একমাত্র সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

(২) কমিউন

প্যারিস এবং বিভিন্ন শহর ও গ্রামে প্রচুর কমিউন বা পৌর প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির সঙ্গে জেকোবিন দল ও সাকুলেৎ জনতার গভীর যোগাযোগ ছিল। এগুলি বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক কাজকর্ম করত এবং নানাভাবে আইনসভার উপর চাপ সৃষ্টি করত।

(৩) কনভেনশনের বিভিন্ন কমিটি

জাতীয় মহাসভা বা কনভেনশনের বিভিন্ন কমিটিগুলি-ও এ সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সন্ত্রাসের সাংবিধানিক ভিত্তি

সন্ত্রাসের শাসনকে কার্যকরী করার জন্য নিয়মিত সংবিধানকে অকার্যকর করে রাখা হয়। ‘জাতীয় মহাসভা‘-র হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকলেও এই সভা কয়েকটি কমিটির হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেয়। এই শাসনব্যবস্থায় প্রধান সংগঠনগুলি হল —

(১) গণ-নিরাপত্তা সমিতি

এর সদস্য সংখ্যা প্রথমে ছিল নয়, তারপর তা বৃদ্ধি করে বারো করা হয়।  এই কমিটির হাতেই সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। এই কমিটিই শাসন পরিচালনার নীতি-নির্ধারণ এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার সকল দায়িত্ব পালন করত। এই কমিটিই মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করত, সেনাপতি নিয়োগ করত এবং বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করত। কনভেনশন বিনা প্রশ্নে এই কমিটির সব সিদ্ধান্ত মেনে নিত। রোবসপিয়র ছিলেন এই কমিটির সর্বেসর্বা।

(২) সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি

এই কমিটির হাতে সারা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পুলিশ বিভাগ প্রভৃতির দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। এই কমিটিকে সাহায্য করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। এই কমিটির অধীনে ছিল অসংখ্য বিপ্লবী কমিউন ও সমিতি, যারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করত।

(৩) সন্দেহের আইন

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বিধিবদ্ধ হওয়া ‘সন্দেহের আইন’ (‘Law of Suspect) নামক এক আইন অনুসারে বিপ্লব-বিরোধী সন্দেহে যে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যেত এবং বিপ্লবী আদালতে তার বিচার হত। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের জন্য সমগ্র ফ্রান্সে ৫০ হাজার বিপ্লবী কমিটি গঠিত হয়।

(৪) বিপ্লবী বিচারালয়

বিপ্লবী বিচারালয় নামের আদালতে এইসব অভিযুক্তের বিচার হত এবং এই আদালতের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। এই আদালত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অপরাধ যাচাই না করেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দিত।

(৫) বিপ্লবের বধ্যভূমি

অপরাধী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে ‘বিপ্লবের বধ্যভূমি’ (‘Square of Revolution) -তে এনে ডাঃ গিলোটিন (Guillotine) নামক জনৈক ব্যক্তির আবিষ্কৃত গিলোটিন নামক যন্ত্রের সাহায্যে তাদের শিরশ্ছেদ করা হত।

সন্ত্রাসের ইতিহাস

সন্ত্রাসের শাসনকালকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। যথা –

(ক) প্রথম পর্ব

  • (১) জিরণ্ডিন ও জেকোবিন দল একত্রে সন্ত্রাসের সূচনা করলেও অচিরেই তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। দুই দলের আদর্শগত সংঘাত এবং দুই দলের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাই এই বিবাদের কারণ।
  • (২) জাতীয় মহাসভায় জিরণ্ডিন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক যুদ্ধে পরাজয় প্রভৃতি কারণে তাদের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়। এছাড়া, তাদের মধ্যবিত্ত-ঘেঁষা নীতিও জেকোবিনদের পছন্দ হয় নি।

(খ) দ্বিতীয় পর্ব

  • (১) এই অবস্থায় সাকুলেৎ জনতার সমর্থিত জেকোবিনদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্বে মধ্যপন্থী বা Plain গোষ্ঠীর নেতারা ও জেকোবিনদের সমর্থন জানান।
  • (২) এই পর্বে জেকোবিন দলের তিনজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন হিবার্ট, দাঁতো ও রোবসপিয়র। এছাড়া অন্যান্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন ল্যাসার কার্নো (Lazare Carnot ), ফুশে (Fuoche), শার্লট কোর্সে (Charlotte Corday) প্রমুখ।
  • (৩) এইসব নেতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন রোবসপিয়র-সন্ত্রাস শাসনের মূল পরিচালক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র। নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা আদর্শবাদী, সৎ, নিষ্ঠুর ও উল্লেখযোগ্য।

(গ) তৃতীয় পর্ব

  • (১) হিবার্ট, দাঁতো এবং জেকোবিন দলের অন্যান্য নেতাদের হত্যার পর ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে রোবসপিয়র সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তাঁর একক নেতৃত্বে চরম সন্ত্রাস চলতে থাকে।
  • (২) ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ২৭শে জুলাই তাঁর বন্দি হওয়া পর্যন্ত সময়কাল ‘লাল সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত। ২৮শে জুলাই গিলোটিনে তাঁর মৃত্যু হয়।
  • (৩) সূচনা পর্বে সন্ত্রাস রুদ্ররূপ ধারণ করে নি। নেতৃত্ব প্রয়োজন ব্যতীত বলপ্রয়োগ করতেন না। তাঁদের ইচ্ছা ছিল মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও আনুগত্য সঞ্চার করা। এতে ঠিক ফললাভ না হওয়ায় নেতৃবৃন্দ যথার্থ সন্ত্রাসের পথ ধরতে বাধ্য হন।

সন্ত্রাসের ভয়াবহতা

  • (১) ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে তেরো মাসের এই সন্ত্রাসের শাসনকাল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। বিপ্লবী নেতৃবর্গ এই সময় যেন রক্ত পিপাসায় মেতে ওঠেন। বিপ্লবের নামে তাঁরা প্রায় ৫০,০০০ নর-নারীকে গিলোটিনে হত্যা করেন।
  • (২) সন্দেহের আইনে গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে। বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের আর সন্ধান মেলে নি। এছাড়া, আরও বহু মানুষকে পাইকারি হারে তাঁরা লয়ার নদীর জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন। মৃতদেহের পচনের ফলে লয়ার নদীর জল দূষিত হয়ে যায়।
  • (৩) এই কালপর্বে যাঁরা প্রাণ দেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখজনক হলেন রানি মেরি আঁতোয়ানেত, জিরণ্ডিন দলের পরামর্শদাত্রী মাদাম রোঁলা, ব্রিসো, বারনাভ, বৈজ্ঞানিক বেইলি, জিরণ্ডিন দলের বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ এবং বহু বিশিষ্ট ফরাসি সন্তান।
  • (৪) বিপ্লবী নেতা ও জেকোবিন দলের সদস্য হিবার্ট ও দাঁতো অবিরাম রক্তপাতের বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করতে থাকলে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ ও এপ্রিলে রোবসপিয়রের নির্দেশে তাদের পরপর হত্যা করা হয়।

লাল সন্ত্রাস

  • (১) সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে একে একে সরিয়ে রোবসপিয়র সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল থেকে ২৭শে জুলাই পর্যন্ত তাঁর একক নেতৃত্বে সন্ত্রাস চলতে থাকে।
  • (২) এই পর্বে ক্ষেতের ফসলের মতো মানুষের মাথা কাটা পড়ে। কেবলমাত্র ‘সন্দেহের আইনে’ ৪৫২৫ জন বন্দি হন। ঠিক কতো মানুষ নিহত হয়, তা বলা দুরূহ। এই পর্ব বা ঘটনা ‘লাল সন্ত্রাস’ (Red Terrorism) নামে পরিচিত।

সন্ত্রাসের শাসনের অবসান

  • (১) প্রকৃতপক্ষে এই সময় সন্ত্রাসের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুনে সেনাপতি জর্ডানের যুদ্ধজয়ের পর বিদেশি আক্রমণের সম্ভাবনা একরকম মুছে গিয়েছিল। এছাড়া লিয়ঁ, মার্সেই, তুলোঁ-র বিদ্রোহও দমিত হয়েছিল। এইসব কারণে আর সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল না।
  • (২) ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই সময় রোবসপিয়র কেবলমাত্র সন্ত্রাসকে অব্যাহতই রাখলেন না, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত ও কঠোরতর করেন।
  • (৩) ১০ই জুন ‘প্রেইরিয়াল’ (Prireal) নামে এক আইন পাস করে বিচারালয়ের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়। ন্যাশনালকনভেনশনের সদস্যরাও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হারান। এর ফলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
  • (৪) জেকোবিন, জিরণ্ডিন ও মধ্যপন্থী দলের আতঙ্কিত সদস্যরা সমবেতভাবে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে। পরদিন রোবসপিয়র-সহ তাঁর চব্বিশজন অনুগামীকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়।
  • (৫) নতুন বিপ্লবী বর্ষপঞ্জী অনুসারে ৯ই থার্মিডোর (২৭শে সেপ্টেম্বর) রোবসপিয়র ক্ষমতাচ্যুত হন। ধার্মিডোর মাসে এই ঘটনা ঘটেছিল বলে একে ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া‘বলা হয়। রোবসপিয়রের মৃত্যুতে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।

সন্ত্রাসের শাসনের প্রকৃতি

  • (১) সন্ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে কোনও শ্রেণি-সংঘর্ষের চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে প্রাণ দেন সব শ্রেণির মানুষ— এমনকী সন্ত্রাস পরিচালনার নেতৃবর্গও। গিলোটিনে প্রাণ দেওয়া মানুষের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির মানুষরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
  • (২) লেফেভর ও কোবান বলেন যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৮৫ জনই ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। যাজক ও অভিজাতদের মধ্যে যথাক্রমে ৬.৫ এবং ৮.৫ শতাংশ গিলোটিনে প্রাণ দেন। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, সন্ত্রাসে নিহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল কৃষক ও মেহনতি মানুষ।

সন্ত্রাসের শাসনের সাফল্য

নানা ত্রুটি সত্ত্বেও সন্ত্রাসের শাসনকালের কৃতিত্বও কম নয়। যেমন –

  • (১) এই শাসন-পর্বের মূল কৃতিত্ব হল গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা, প্রতি-বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং বিদেশি শক্তিজোটের আক্রমণের হাত থেকে ফ্রান্স ও বিপ্লবকে রক্ষা করা। এই আমলেবেশ কিছু সংস্কার প্রবর্তিত হয়।
  • (২) গির্জাগুলি বন্ধ করে দিয়ে খ্রিস্টধর্মের অনুষ্ঠান সীমিত করা হয়। ‘যুক্তির পূজা’ শুরু হয়। বিখ্যাত নটারডাম গির্জা ‘যুক্তির মন্দির’-এ রূপান্তরিত হয়।
  • (৩) প্রচলিত খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি বাতিল করে নতুন ‘প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি’ প্রবর্তন করা হয়।
  • (৪) মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সর্বোচ্চ মূল্য ও মজুরির সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ, নতুন মাপ, ওজন, দশমিক মুদ্রা এবং রুটির জন্য রেশন কার্ডের প্রবর্তন করা হয়।
  • (৫) অবৈতনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হয়।
  • (৬) অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে তা বণ্টন এবং দাসপ্রথা উচ্ছেদ করা হয়।
  • (৭) রুশোর গণ-সার্বভৌমত্বের নীতির উপর ভিত্তি করে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়, যদিও তা কার্যকর করার সুযোগ মেলেনি।
  • (৮) ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কার্নটের নেতৃত্বে ১০ লক্ষ সেনার এক বিরাট বাহিনী গঠিত হয়, যা ইউরোপীয় রণাঙ্গনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। এছাড়া, নতুন ও আধুনিক অস্ত্র কারখানা তৈরি হয়।

সন্ত্রাসের বিপক্ষে যুক্তি

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের বিপক্ষে পণ্ডিতরা নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন। যেমন –

  • (১) ঐতিহাসিক তেইন বলেন যে, সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল ক্ষমতালোভী, দুর্বিনীত, সুবিধাভোগী এক শ্রেণির মানুষের প্রচেষ্টা। এই সময় ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না।
  • (২) কেবল সন্দেহের বশে এবং কিছু মানুষের খামখেয়ালিপনা মেটাতে হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। তাই বলা হয় যে, “সন্ত্রাসের দ্বারা বিপ্লব তার নিজ সন্তানদের গিলে ফেলে।”
  • (৩) এই সময় এক শ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়। লেফেভর প্যারিসে এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জনতার উল্লেখ করেছেন। তেইন এইসব উচ্ছৃঙ্খল এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতাদের উপর প্রবল ঘৃণা বর্ষণ করেছেন।
  • (৪) দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপদার্থ লোকেরা সেদিন সমাজের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন। এই জিনিস নিশ্চয় গণতন্ত্রসম্মত বা সমর্থনযোগ্য নয়। রোবসপিয়র গির্জার উপাসনা বন্ধ করে দিয়ে গির্জাকে ‘যুক্তির মন্দির’ এবং গির্জায় ‘যুক্তির দেবী’-র উপাসনা শুরু করেন। এর ফলে বহু মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে।
  • (৫) ষোড়শ লুই-এর হত্যা, পুরাতনতন্ত্রের ধ্বংস, ব্যক্তি ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা প্রভৃতির সঙ্গে রোবসপিয়রের মহাসন্ত্রাস ও একনায়কত্ব কতটা সঙ্গতিপন্ন! ফরাসি জাতি কি এই জন্যই এত ত্যাগ স্বীকার করেছিল?
  • (৬) অনেকে বলেন যে, সন্ত্রাসের ফলে বিপ্লব রক্ষা পায় এবং বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে ফ্রান্স রক্ষা পায়। এর উত্তরে লুই ব্লাঁ (Louis Blane) বলেন যে, “সন্ত্রাস ফ্রান্সকে বাঁচায় নি। সন্ত্রাস বিপ্লবকে পঙ্গু করে দেয়।”

সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তি

  • (১) সন্ত্রাসের রাজত্বের স্বপক্ষে বলা যায় যে, এটি ছিল ‘আপৎকালীন স্বৈরতন্ত্র’। বিদেশি আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে নবগঠিত ফরাসি প্রজাতন্ত্রের এক প্রবল সংকটময় কালে, এই সন্ত্রাসের শাসনই অরাজকতা ও বিদ্রোহের অবসান ঘটায়।
  • (২) সন্ত্রাসের শাসন দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে এবং বিদেশি আক্রমণকারীদের পর্যুদস্ত করে। তাই ঐতিহাসিক টেলর বলেন, “সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করেছিল।” ওলার বলেন যে, অভ্যন্তরীণ প্রতি-বিপ্লব ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল।
  • (৩) হেজ বলেন যে, সন্ত্রাস তার উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয় — “ফ্রান্সে বিপ্লব রক্ষা পায় এবং ইউরোপে ফ্রান্স টিকে থাকে।” মাতিয়ে, লেফেভর প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সমাজে বিপ্লবের আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল।
  • (৪) সন্ত্রাস ব্যতীত কখনোই কালোবাজারি দমন, সর্বোচ্চ মূল্য ও নিম্নতম মজুরি আইন, ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমিবণ্টন ও সকলকে ন্যায্য হারে কর প্রদানে বাধ্য করা সম্ভব হত না।

উপসংহার:- রবিনসন ও বিয়ার্ড-এর মতে, সন্ত্রাসের সময় সাধারণ মানুষ আমোদ-প্রমোদেই দিন কাটাত। থিয়েটার ও অপেরাগুলি পূর্ণই থাকত। রেস্তোরাঁগুলি আড্ডাবাজ মানুষে ভর্তি থাকত। বিলাসিনী মেয়েরা সোনার তৈরি গিলোটিনের মডেল গলার হারের লকেটে ঝুলিয়ে রাখত। রাইকার বলেন যে, ভয়াবহতা ও নৃশংসতা সত্ত্বেও সন্ত্রাসের শাসন বাস্তব রাজনীতিজ্ঞানের পরিচায়ক।

(FAQ) সন্ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের সময়কাল কত?

২ জুন, ১৭৯৩খ্রিস্টাব্দ থেকে ২৭ জুলাই ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

২. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের নায়ক কে?

রোবসপিয়ার।

৩. কোন সময় পর্বকে লাল সন্ত্রাস বলা হয়?

১৩ এপ্রিল থেকে ২৭ জুলাই ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

৪. সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে কখন?

২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

৫. কার মৃত্যুর মাধ্যমে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে?

রোবসপিয়ার।

Leave a Comment