জোসেফ স্টালিন

জোসেফ স্টালিন প্রসঙ্গে তার জন্ম, ছেলেবেলা, লেনিনের উত্তরসূরী, সর্বহারা একনআয়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাস্তবানুগ নীতি, সোভিয়েত শাসন, সাম্যবাদী চেতনার বিস্তার, হিটলারের ও স্টালিন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ, দৃঢ় নেতৃত্ব ও তার নিষ্পেষণ সম্পর্কে জানবো।

জোসেফ স্টালিন

ঐতিহাসিক চরিত্রজোসেফ স্টালিন
জন্ম১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৮ খ্রি:
দেশরাশিয়া
পরিচিতিসাম্যবাদী রাজনীতিবিদ
মৃত্যু৫ মার্চ, ১৯৫৩ খ্রি:
জোসেফ স্টালিন

ভূমিকা :- রুশ বিপ্লবের পুরোধা পুরুষ ভি আই লেনিন-এর পর রুশ বিপ্লব-এর ইতিহাসে বিশেষ করে প্রথম মহযুদ্ধোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যিনি তিনি জোসেফ স্টালিন। লেনিনের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা অধিক খ্যাত তাদের মধ্যেও জোসেফ স্টালিন প্রধান পুরুষ।

লেনিনের প্রধান সহযোগী স্টালিন

লেলিনের মন্ত্র শিষ্য বিশ্ববিপ্লবের প্রধান প্রবক্তা ট্রটস্কি আভিজাত্যে, শিক্ষায়, জ্ঞান গরিমায় এবং বাগ্মীতায় হয়ত স্টালিন থেকেও অধিক খ্যাত ছিলেন, পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত শাসনকে সমগ্র রাশিয়ায় এবং জারের সাম্রাজ্য-এর নানা প্রান্ত সুদৃঢ় করণে যিনি লেনিনের প্রধান সহযোগী হিসাবে সফল ভূমিকা পালন করেছেন তিনি জোসেফ স্টালিন।

দুই সফল ব্যক্তিত্ব লেনিন ও স্টালিন

  • (১) মার্কসবাদ-এর ও সাম্যবাদ-এর সফল প্রসার ত্বরান্বিত করতে যে দুটি ব্যক্তিত্ব সর্বাপেক্ষা অধিক ক্রিয়াশীল তা লেনিন ও স্টালিন। লেনিনের সহযোগী ট্রটস্কি সাহেব রুশ বিপ্লবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু লেনিনের স্বল্পকালীন জীবনের সায়াহ্ন বেলায় দেখা যায় যে সারা সোভিয়েত রাশিয়ায় রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্মী ও কৃষক মজদূর সাধারণ মানুষের কাছে স্টালিন।
  • (২) লেনিনের জীবদ্দশায় যথেষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেন, বিশেষ করে বিশ্ববিপ্লবের প্রধান পুরোহিত ট্রটস্কি, মার্কসবাদের আন্তর্জাতিকতা নিয়ে যতই বেশি মাথা ঘামিয়েছেন স্টালিন ততই বাস্তববাদী রুশ পার্টির কাছে, কাছের মানুষ হয়েছেন।

শক্তিশালী নেতা হিসাবে স্টালিনের নিজেকে প্রতিষ্ঠা

লেনিনের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব থেকেই স্টালিন তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট নেতা, ট্রটস্কি, জেনেভিউ, কামেনেঠ, বুখারিন এদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মৃত্যুর পূর্বে লেনিনের উপলব্ধি

অনেকের মতে লেনিন মৃত্যুর পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থায় তাঁর মৃত্যুর পরই এক বিভীষণ মহানায়কের উত্থান ঘটবে যিনি কমিউনিষ্ট বিপ্লবের গণতান্ত্রিক চরিত্রে একধরনের একনায়কত্বের আবহ সৃষ্টি করবেন।

মহাশক্তিধর মহাবিপ্লবী স্টালিন

কমিউনিস্ট আন্দোলনে ও জীবনদর্শনে আপোষহীন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। ফলে পার্টিতে তথা সোভিয়েত দেশে আস্তে আস্তে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে ক্রেমলিনে এবং সেখানকার অধিশ্বর মহাশক্তিধর মহাবিপ্লবী স্টালিনের হাতে।

স্টালিনের নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা

  • (১) প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের সমূলে নির্মূলকরণে স্টালিনীয় অভিযানে হাজার হাজার বিশ্বস্ত, সৰ্ব্বত্যাগী আদর্শবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যের নিধন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পূর্বে রুশ সামরিক বাহিনীতেও যে পার্জ বা ঝাড়াই বাছাই অভিযান চলে তাতে রুশ সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রায় সকল সামরিক নেতাই পদচ্যূত বা নিহত হয়।
  • (২) ফলে স্টালিনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিতেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। কারণ যদিও রুশ বিপ্লবের প্রধান হোতা লেনিন ও ট্রটস্কি রেড আর্মিকে বিপ্লবী চেতনায় ও উন্মাদনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও স্টালিন তার ক্ষুরধার বুদ্ধি দ্বারা, কঠোর নিষ্ঠাপরায়ণ পার্টি নেতা হিসাবে নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কাছের মানুষ স্টালিন

লেনিন, স্টালিনের কঠোর স্বভাব, নিষ্ঠুরতা ও একগুয়েমি বিষয়ে অবহিত হলেও তার সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নিরন্তর কর্ম প্রবাহে লিপ্ত থাকার প্রচেষ্টা স্টালিনকে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের কাছের মানুষ করে তুলে।

মার্কসিয় কমিউনিষ্ট তত্ত্বকে স্টালিনের নতুন পথে চালনা

ক্যামনেড, বুখারিন, ট্রটস্কি প্রভৃতি নেতাগণ স্টালিন থেকে তাত্ত্বিক আলোচনায়, বাগ্মীতায়, রাজনৈতিক সততায় যতই শ্রেয় হন না নে, স্টালিন বাস্তববাদী, জাতীয়তাবাদী পথ অবলম্বন করে মার্কসিয় কমিউনিষ্ট তত্ত্বকে এক নতুন পথে প্রবাহিত করেন।

কমিউনিষ্ট পার্টির সর্ব্বময় কর্তা স্টালিন

বিশ্ববিপ্লব আগে, না রুশ দেশে রাজনৈতিক বিপ্লব তথা ক্ষমতা সংহত করা আগে, এই প্রশ্নে স্টালিন সাধারণ কৃষক, শ্রমিকদের কাছে বাস্তববাদী রাজনৈতিক চিন্তার প্রমাণ রাখেন। ফলে বড় বড় মার্কসবাদী নেতাকে তিনি পেছনে ফেলে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে সর্ব্বময় কর্তা হয়ে উঠেন।

বিপ্লবী দলে স্টালিনের দীক্ষা

স্টালিন মূলত রুশ জনগণের কাছের মানুষ। শিক্ষায় দীক্ষায়, আভিজাত্যে, তিনি অতি সাধারণ একজন চর্মকারের সন্তান। মা চেয়েছিলেন ছেলে একজন ভাল ধর্মযাজক হবেন। কিন্তু কৈশোরের কিশলয় পার না হতেই, স্টালিন দীক্ষা নিলেন বিপ্লবী দলে।

সোভিয়েত লৌহমানব স্টালিন

স্টালিন কথার অর্থ লৌহমানব। অর্থাৎ লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত লৌহমানব। অর্থাৎ লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত দেশে যে লৌহ যবনিকার বাতাবরণ রুশ জীবনকে আচ্ছন্ন করে তা লেনিনের নামকরণের সার্থকতায় আভাষিক।

স্টালিনের জন্ম

ককেসাশ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম রাজ্য জর্জিয়ায় স্টালিন জন্মেছেন। জর্জিয়ায় ক্ষুদ্র গোরী শহরে এক সাধারণ সার্ফ অর্থাৎ দাসচাষী পরিবারের চর্মকারের পুত্র। জর্জিয়ান মায়ের নাম একাতেরিয়া।

স্টালিনের ছেলেবেলা

  • (১) জন্মলগ্ন থেকে জোসেফের শরীর মজবুত ছিল। বাল্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েও জোসেফ জীবনী শক্তিতে স্বাস্থ্যজ্জ্বোল ছিল। জোসেফের পিতা বিসোরিক্ত রাগী, মাতাল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ফলে দশ বৎসর বয়সে পিতৃহারা জোসেফ স্টালিন মায়ের অনাদারে বেড়ে ওঠেন।
  • (২) বহু সফল মহানায়কের ন্যায় জোসেফ স্টালিন তাঁর মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন আবাল্য। ব্যক্তিগতভাবে বাল্যকাল থেকে কঠোর মাতৃশাসনে ও অনুশাসনে পাদ্রী না হয়ে বিপ্লবী হলেন।
  • (৩) জোসেফের মা ছেলেকে জার্জিয়ার রাজধানী টিফলিসের সেরা বিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। চরিত্র গঠন থেকে পঠন পাঠন সকল বিষয়েই বাল্যে মার প্রভাবে জোসেফ একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়ে উঠতে থাকে।
  • (৪) ফলে মার স্নেহচ্ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে যখন জোসেফ বিপ্লবী দলে সর্বক্ষণের কর্মী হলেন তখন তিনি পুরোহিতের নিষ্ঠায় তাঁর বিপ্লবী কর্ম পরিচালনা করতে থাকেন।

নানা অভিধায় ভূষিত জোসেফ স্টানিল

তিনি পরবর্তীকালে যে লেনিনের দ্বারাও কখন কখনও কিছুটা কম কঠোর হতে আদিষ্ট হন তা সম্ভবতঃ তাঁর মায়ের কঠোর শাসনে গড়ে উঠা নৈষ্ঠিক ও নিষ্ঠুর চারিত্রিক গুণের জন্যই। স্টালিন দৃঢ়চেতা, স্টালিন একগুয়ে, স্টালিন বাস্তববাদী, স্টালিন জাতীয়তাবাদী এই সকল নানা অভিধায় তিনি ভূষিত।

লেনিনের উত্তরসূরী স্টালিন

লেনিনের মৃত্যুর পর পরই, অত্যন্ত দ্রুততায় সারা সোভিয়েত রাশিয়ায় যে ব্যাপক শিল্পায়ন, বৈদ্যুতিকরণ ও স্বাক্ষরতা অভিযান চালান তা নিঃসন্দেহে লেনিনের উত্তরসূরী হিসাবে, উত্তরাধিকারী হিসাবে তাকে স্মরণীয় করে তাঁর জীবনকালেই।

স্টালিনের নেতৃত্বে সর্বহারা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত

  • (১) স্টালিন চরম নিষ্ঠুরতায় প্রতিবিপ্লবী চক্রকে নির্মূল করেন। কিন্তু এই প্ৰতি বিপ্লবী চক্র নিধনের সাথে সাথে আস্তে আস্তে রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার বদলে পার্টি কর্তৃত্ব, পার্টির সর্বময় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (২) ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামরিক বিভাগ সকল বিষয়েই পার্টি তার সর্বাত্মক ও সর্বময় প্রভৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। পার্টির ভিতরে গণতান্ত্রিক চেতনার বদলে বুরোক্র্যাটিক চেতনা অধিক ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। সর্বহারা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

পার্টিতন্ত্র গঠনে স্টালিন

স্টালিন ১৯২৯ সালে পঞ্চদশ বর্ষে উপনীত হলে দেখা যায় তিনি রাজনৈতিক ভাবে সোভিয়েত রাশিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে পার্টিতন্ত্র গড়ে তুলেছেন। ট্রটস্কি, পাখনড, ফ্যামেনেড, জেনোভের সকলেই অন্তর্হিত, নিহত। এই সকল তাত্ত্বিক মহাপণ্ডিত বিশ্ববিপ্লবীগণ লেনিনের মৃত্যুর স্বল্পকালের মধ্যে আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

স্টালিনের মোহময় বাস্তবানুগ নীতি

  • (১) কমিউনিষ্ট পার্টি স্টালিনের মোহময় বাস্তবানুগ নীতিগুলি অধিক সমাদরে গ্রহণ করল। বিশ্ববিপ্লবের বদলে রুশ বিপ্লবের সফল রূপান্তর রুশ কমিউনিস্ট পার্টির কাছে অধিক বুদ্ধিগ্রাহ্য মনে হল।
  • (২) ফলে সাম্যবাদী বিপ্লবের আন্তর্জাতিক চেতনায় ছেদ পড়ল। রুশ জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদের পথে সোভিয়েত রাশিয়ার পদযাত্রা বিশ্বকমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করল।

স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত শাসন

কিন্তু স্টালিনের নেতৃতে বিশ্বাসী রুশজনগণ শক্তিশালী লালদূর্গ হিসাবে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে বিশ্ববিপ্লবের পরিপূরক হিসাবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর হল। রুশসাম্রাজ্যের দূরতম প্রান্তেও সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠিত হল। অনেক ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করেই তা সমাধা করা হল। বিশেষকরে এশিয়াটিক রাজ্যগুলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশেষ কঠোরতা প্রয়োজন হল।

স্টালিনের নেতৃত্বে সাম্যবাদী চেতনার বিস্তার

রাশিয়ায় ধর্মান্ধ অর্থডোক্সচার্চ এবং এশিয়ায় মুসলমান উলেমাগণ মরনপণ লড়াই করে পরাস্ত হলেন স্টালিনিয় নিষ্ঠুরতার কাছে। এছাড়া সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চেতনাও জারের সাম্রাজ্যের দূরপ্রান্ত তাজাকিস্থান, কাজাকিস্তান, কির্গিজিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলেও কমবেশি কিছু গড়ে উঠেছিল।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করতে ব্রতী স্টালিন

তিনি নিজেও মস্কো থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে জর্জিয়ার জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরেই জর্জিয়ায় টিফলিসে স্কুলের পাঠ অসমাপ্ত রেখে যাজকের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ ছেড়ে বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। ফলে বর্তমান শতাব্দীর ত্রিশের দশকে স্টালিন সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করতে ব্রতী হন একনিষ্ঠভাবে যাজকের নিষ্ঠায়, সামরিক নির্মমতায়।

স্টালিনের নেতৃত্বে দেশ গঠন ও সমাজ গঠনের কাজ

১৯২৮ সালেই সারা সোভিয়েত রাশিয়ায় সপ্তবার্ষিক পরিকল্পনা মাফিক পুনর্গঠন কর্ম, উন্নয়ন কর্ম, পরিচালিত হতে থাকে। স্টালিনের নির্দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সৈনিকের শৃঙ্খলায় ও পুরোহিতের নিষ্ঠায় সুদূর বিস্তৃত বহুধা বিভক্ত বহু ভাষাভাষী সোভিয়েত রাশিয়ায় দেশ গঠন ও সমাজ গঠনের কাজ চলতে থাকে।

সপ্তবার্ষিক পরিকল্পনা পরিচালনায় স্টালিন

  • (১) স্টালিন যে দৃঢ়তায় ও দ্রুততায় সপ্তবার্ষিক পরিকল্পনাগুলির সফল রূপায়ণ ঘটিয়ে সোভিয়েত দেশে যুগযুগান্তরের পশ্চাৎপদতা থেকে আধুনিকতার আলোকবর্তিকা জ্বালেন তা কেবল হিটলারের নাৎসি দল-এর স্যোসাল ডেমক্রাসির সাথে তুলনীয়।
  • (২) কয়েক বছরের ব্যবধানে হিটলার পরাজিত জার্মানিকে ইউরোপ-এর এক মহাশক্তিধর শিল্পোন্নত দেশে রূপান্তরিত করেন। ঠিক একইভাবে সামরিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ রুশ কমিউনিস্ট পার্টি হাজার হাজার মাইল ব্যাপী বিস্তৃত জারের সাম্রাজ্যের দূরতম অঞ্চলও সাম্যবাদের সফল রূপায়ণ অনুভব করান।
  • (৩) ফলে মধ্য রাশিয়ায় ঊষরপ্রান্তর কেঁপে লেনিনগার্ড থেকে তাড়িভষ্টক পর্যন্ত বিশ্বের দীর্ঘতম রেল পথেও বৈদ্যুতিকরণ করা হয়। এছাড়া বাঁধ, খাল খনন, পতিত অহল্যা জমি উদ্ধার করে লক্ষ লক্ষ একর জমি কৃষিযোগ্য করে তোলে। কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত করা সম্ভব হয়।

সাধারণ মানুষের অশেষ দুর্দশা

  • (১) তবে এই সফল গ্রাম উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব করতে গিয়ে মাঝেমাঝে হঠকারী স্টালিনীয় পার্টি সিদ্ধান্ত রুশ জনগণ তথা সারা সোভিয়েত দেশে সাধারণ মানুষের অশেষ দুর্দশার কারণ হয়।
  • (২) অভিজ্ঞতার অভাবে পার্টির আবেগমথিত সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে গিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে ব্যহত হয়েছে বার বার। আর হাজার হাজার কৃষক শ্রমিক দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সারা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে স্টেট ফার্ম আর জোত খামার, কৃষি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন।

প্রতিবিপ্লবী প্রবণতার বিরুদ্ধে স্টালিনের অভিযান

  • (১) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে ত্রিশের দশকে স্টালিনের নির্দেশে সুদৃঢ় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে ও রেড আর্মিতে কারণে অকারণে প্রতিবিপ্লবী প্রবণতার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে স্টালিনের নির্দেশে হাজার হাজার নিষ্ঠাবান সৈনিক ও পার্টি কর্মী রাষ্ট্রের হাতে নিহত হয়।
  • (২) ফলে রুশ দেশের সম্বন্ধে পাশ্চাত্য জগতে হিটলারকে রোখবার ক্ষমতার সম্বন্ধে সংশয় দেখা যায়। হিটলার নিজেও রুশ পার্টি ও সামরিক বাহিনী সম্বন্ধে হীন মনোভাব পোষণ করেন।
  • (৩) কারণ ত্রিশের দশকের শেষ দিকে প্রায়শই কারণে অকারণে সোভিয়েত দেশে হাজার হাজার মানুষকে নিয়তি তাড়িত সাইবেরিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে দাস শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পাঠান হত।
  • (৪) গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন তখন সোভিয়েত রাশিয়ার দূরঅস্ত। ফলে সাধারণ মানুষ ছাড়াও সামরিক নেতৃত্ব, সংস্কৃতিক জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এমনকি পার্টির বিশ্বস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বও নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
  • (৫) ফলে সামগ্রিকভাবে ত্রিশের দশকে কিছু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও দেশ সামগ্রিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে হিটলার যখন রাশিয়াকে আক্রমণ করে তখন রেড আর্মি কেবল পিছু হটতে থাকে।

হিটলার ও স্টালিন

  • (১) স্টালিন ও হিটলার উভয়েই জাতি গঠনে জাতীয় চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরাজিত জার্মানির অভিমানী জার্মান মানুষকে ভালভাবে অনুভব করে, হিটলার আস্তে আস্তে জার্মানিতে সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন।
  • (২) আর সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশ্বের বৃহত্তম ভৌগোলিক পরিধিযুক্ত একটি রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত করেন।
  • (৩) তবে জার্মানির পরাজয়ের পর জার্মানিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে দেখা যায় জার্মান মনন ও মানস হিটলারের ইহুদি হত্যা, গণহত্যা, গণতন্ত্র হত্যাকে ক্ষমা করেনি।
  • (৪) কিন্তু স্টালিন সোভিয়েট রাশিয়া নিষ্ঠুরতায়, নরহত্যায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কণ্ঠ রোধে কোন অংশে হিটলারের থেকে কম দক্ষ ছিলেন না। সোভিয়েত শাসনে যে পরিমাণ নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট স্টালিনের আমলেও নিহত হন জারের আমলে তার ঠিক দশমাংশও নিহত হয়েছেন কিনা সন্দেহ।

স্টালিনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ

  • (১) লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর স্টালিন জামানায় যে জোর জবরদস্তি ও বিবর্তনমূলক আটক আইনে গ্রেপ্তার তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। সোভিয়েত দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা সফল হয়নি।
  • (২) কিন্তু ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রলেটারিয়েৎ কথার অন্তরালে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা স্টালিন ভোগ করেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তার নির্যাতনের হাত থেকে কমিউনিষ্ট পার্টির প্রথম শ্রেণীর আদর্শবাদী নেতৃবর্গ থেকে সামরিক বাহিনীর সৎসাহসী সেনানীকূল কেউই বাদ যাননি।
  • (৩) সাইবেরিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাপম্পগুলি লক্ষ লক্ষ দাস বন্দী শ্রমিকের কাতরানির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থেকেছে। স্টালিনের আমলে সোভিয়েত উৎপাদন ব্যবস্থায় দাস শ্রম ব্যবস্থা প্রায় প্রাচীন গ্রিস-এর দাসশ্রম ব্যবস্থার সমমর্যাদায় ভূষিত হয়।

স্টালিন কর্তৃক দাস-শ্রম ব্যবস্থার প্রচলন

  • (১) আব্রাহাম লিঙ্কন, স্টানলি লিভিংস্টোন থেকে আরম্ভ করে হাজার হাজার পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবি ও খ্রিস্টিয় মিশনারীগণ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই দাস-শ্রম ব্যবস্থা ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় ও আমেরিকায় নিষিদ্ধ করেন।
  • (২) কিন্তু স্টালিনের আমলে কার্যত সোভিয়েত রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় রশিয়ার উন্নয়নে স্টালিন সেই একই ঘৃনিত ব্যবস্থা চালু করেন।
  • (৩) এছাড়া সমগ্র সোভিয়েত রাশিয়ায় কোথাও কোনো রাষ্ট্রীয় কল, কারখানা ও যৌথ খামারে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে সংঘটিত বা সংঘবদ্ধ হতে দেয়নি স্টালিন। ফলে স্টালিন জামানায় যে উন্নয়নের গতি তা যতখানি স্বতস্ফুর্ত তার থেকে অনেক বেশি জোর জবরদস্তি মূলক।

জনগণের কাছে স্টালিন ও হিটলার

  • (১) কিন্তু একটা বিষয় রাজনীতি বিজ্ঞানের ও ইতিহাসের গবেষকদের কাছে খুবই আশ্চর্যের যে যেখানে হিটলারের মৃত্যুর পর জার্মানীতে হিটলার চিহ্নিত হয়েছেন জার্মান জাতীয় কলঙ্ক হিসাবে; বিকৃত মানসিকতাযুক্ত এক নির্মম মহানায়ক হিসাবে।
  • (২) কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিনের মৃত্যুর পর এমন কি আজও রুশজনগণ স্টালিনের অত্যাচার ও অনাচারের প্রতিবাদে ততখানি মুখর হয়নি। স্টালিন বন্দনা হয়ত বন্ধ হয়েছে।
  • (৩) কিন্তু ক্রুশ্চেভ ছাড়া আর কোনো রুশ রাষ্ট্রপতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব -এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার মতমত প্রকাশ করেন নি। ক্রুশ্চেভ নিজে স্ট্যালিনের আমলে একটু একটু করে রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজের আসন দৃঢ় করেন। বহু দায়িত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করেন।
  • (৪) কিন্তু স্টালিনের মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই তিনি স্টালিনের ভজনার বদলে স্টালিনীয় সমালোচনায় আত্মনিয়োগ করেন। যদিও জীবনের সায়াহ্ন বেলায় ক্রুশ্চেভকে রুশ জনগণ এজন্য ক্ষমা করেনি। পতনের পর ব্রেজনেভের আগমন আবার সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে স্টালিনীয় লৌহযবনিকার প্রবর্তন ঘটায়।

স্টালিন প্রবর্তিত সমাজব্যবস্থা

  • (১) স্টালিন প্রবর্তিত সমাজব্যবস্থা নিঃসন্দেহে রুশ জনগণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমী গণতন্ত্রী দেশগুলির তুলনায় অনেক অনেকগুণে কম ভোগ্যপণ্য, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি দান করেছে।
  • (২) তা সত্ত্বেও আজও গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিন, প্রমুখ নেতাদের পক্ষেও সোভিয়েত শাসনে স্টালিনীয় নির্যাতনের তথ্য বেশি ব্যক্ত করা সম্ভব হয় নি। কারণ সোভিয়েত মানুষ স্টালিনের গুণগুলির কথা আলোচনা করতে যতটা আগ্রহী তাঁর সমালোচনায় তত আগ্রহী নহে।

স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব স্টালিন

হিটলারের থেকেও দীর্ঘকাল ধরে চরম নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার প্রতিভূ হয়েও স্টালিন কিন্তু আজও সাধারণ সোভিয়েত নাগরিকের কাছের মানুষ। তারা স্টালিনের আমলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, সাইবেরিয়ার দাসশ্ৰম ব্যবস্থা, শিক্ষা সংস্কৃতিতে রঙজলাভূমি সৃষ্টি ও লৌহযবনিকার প্রবর্তনের কথা স্বীকার করে কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত দুর্বলতায় স্টালিন আজও এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

স্টালিনের দৃঢ় নেতৃত্ব

  • (১) অস্বীকার করা যায় না যে স্টালিনের দৃঢ় নেতৃত্ব সোভিয়েত রাশিয়াকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতি সুচতুর স্টালিনের নির্দেশেই এশিয়ায়, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার পরাধীন বা সদ্যস্বাধীন দেশগুলিতে সফলভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
  • (২) স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া যে অনেক সময়ই মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। ফলে সোভিয়েত জনগণ ধর্মের স্বাধীনতায় বঞ্চিত হয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। কিন্তু সামান্যবাদের সাম্য ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্টালিনীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে সফলভাবে।

স্টালিনের নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব

জোসেফ স্টালিনের আমলে যুদ্ধেবিধ্বস্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় যে দেশ গঠন ও নির্মাণকর্ম সপ্তবার্ষিকী পরিকল্পনায় জরুরী ও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলেছে তা পরবর্তী প্রজন্ম অনেকাংশেই প্রশংসাসূচক সহানুভূতিতে মেনে নিয়েছে। সোভিয়েত সাতসালা পরিকল্পনা ও সপ্তবার্ষিকী উন্নয়ন পর্বগুলি নিঃসন্দেহে স্টালিনের নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে।

জোসেফ স্টালিনের নিষ্পেষন

  • (১) বিশেষ করে উৎপাদন ব্যবস্থায় ও শিক্ষা প্রসারে সোভিয়েত সরকার স্টালিনের আমলে জোর-জবরদস্তি মূলক ভাবে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে গিযে যে লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় তা সকলেই স্বীকার করেন।
  • (২) এছাড়া কৃষি উৎপাদনে অভিজ্ঞতার অভাবজনিত বহু বিপর্যয় সোভিয়েত রাশিয়াকে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিতে পীড়িত করে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, হত্যা, আত্মহত্যার কারণ স্টালিনের নিষ্পেষন।

স্টালিন সম্বন্ধে জনগণ বিতরাগ নয়

  • (১) সিক্রেট পুলিশের কর্তা বেড়িয়া সাহেব নিহত হয়েছে, ধিকৃত হয়েছেন তাঁর সিক্রেট পুলিশের সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। কিন্তু যে বেড়িয়া স্টালিনের ছায়াসঙ্গী ছিল স্টালিনের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি রেহাই পাননি জনরোষ থেকে।
  • (২) তাঁর মৃত্যু যেন সারা সোভিয়েত রাশিয়ায় এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিতেও যেন এক স্বস্তি ও শান্তির বায়ু প্রবাহিত করে। কিন্তু যে স্টালিনের নির্দেশে বেড়িয়ার সিক্রেট পুলিশ পরিচালিত হত সেই স্টালিন সম্বন্ধে মানুষ কিন্তু ততখানি বিতরাগ নহেন।

উপসংহার :- স্টালিন জামানায় যত ভুল হয়েছে তার জন্য সাবেক সোভিয়েত সমাজ কমিউনিস্ট পার্টিকে যতটা সমালোচনা করেছে স্টালিনকে ততখানি নহে।

(FAQ) জোসেফ স্টালিন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জোসেফ স্টালিন কে ছিলেন?

জর্জীয় সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ স্টালিন ছিলেন ১৯২৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা।

২. সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে দীর্ঘতম নেতা কে ছিলেন?

জোসেফ স্টালিন।

৩. স্তালিনবাদ ও সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের প্রবক্তা কে ছিলেন?

জোসেফ স্টালিন।

৪. লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কে ছিলেন?

জোসেফ স্টালিন।

Leave a Comment