স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব হিসেবে নবযুগের সূচনা, কঠিন আত্মোৎসর্গ, ভাবধারার প্রভাব, জাতীয় জনজীবন নিয়ন্ত্রণ, গান্ধীজীর ওপর প্রভাব, আত্মোপলব্ধি, ইংরেজ শাসন সম্পর্কে মোহভঙ্গ, সর্বভারতীয় আন্দোলন, ঐক্য ও সহযোগিতা, প্রকৃত জাগরণ, জাতীয় গণসংগ্রাম, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, প্রকাশ প্রকাশ্যে লক্ষ্য ঘোষণা, সর্বশ্রেণীর আন্দোলন, সাংস্কৃতিক জাগরণ ও নতুন চেতনার সৃষ্টি সম্পর্কে জানবো।
স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে কেবলমাত্র রাজনৈতিক গণ্ডীর সীমাবদ্ধ নয়, সারা ভারতের জনজীবনে প্রতিটি স্থানে, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প সর্বত্র প্রভাব বিস্তার, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী গণজাগরণ, গান্ধীজির উপর স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব, স্বদেশী প্রতিষ্ঠানের উত্থান, সাংস্কৃতিক জাগরণ, গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা, গঠনমূলক স্বদেশী ও স্বদেশী আন্দোলনের ফলে নতুন চেতনা সৃষ্টি সম্পর্কে জানব।
স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব (Importance of the Swadeshi Movement)
ঐতিহাসিক ঘটনা | স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব |
বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা | লর্ড কার্জন |
আন্দোলনের সূচনা | ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ |
উল্লেখযোগ্য নেতা | অরবিন্দ ঘোষ বিপিন চন্দ্র পাল লালা লাজপৎ রায় |
তাৎক্ষণিক ফল | বঙ্গভঙ্গ রদ |
ভূমিকা :- ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে-র মতে, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলন ছিল এক দিকচিহ্ন।
বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে ম্যাকলেন -এর অভিমত
ঐতিহাসিক জে. ম্যাকলেন (J. Mclane) বলেন যে, “ভারতের আধুনিক ইতিহাস-এ বঙ্গভঙ্গ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন-রেখা।’
স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব
ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন –
(১) নবযুগের সূচনা
এই আন্দোলন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। এবং নানা দিক থেকে তা ছিল পূর্ববর্তী ‘মডারেট’ বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
(২) কঠিন আত্মোৎসর্গ
এক নতুন আবেগ, উন্মাদনা, ভাবাদর্শ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ এবং আত্মোৎসর্গের কঠিন প্রেরণা নিয়ে শত শত বীর যুবক এই আন্দোলনে সামিল হয়, যার সঙ্গে গতানুগতিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনও মিলই ছিল না।
(৩) ভাবধারার প্রভাব
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যে ভাবধারা ও আদর্শবাদের উদ্ভব হয় তা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশবাসীর জীবনধারাকে প্রভাবিত করে।
(৪) জাতীয় জনজীবন নিয়ন্ত্রণ
ডঃ সুমিত সরকার বলেন যে, এই আন্দোলনের মধ্যে অন্তত ভ্রুণ আকারে উপস্থিত ছিল বিভিন্ন ধারা ও শক্তি, যা ভারতীয় জনজীবনকে ১৯৪৭ বা তার পরবর্তীকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করেছিল।
(৫) গান্ধীজীর ওপর প্রভাব
স্বদেশী আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগের কৌশল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সমিতির ধারণা, রাজনীতি প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন, উচ্চকোটি বা ‘এলিট’-দের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব দূর করতে ধর্মের ব্যবহার, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদের ব্যবহার।
(৬) আত্মোপলব্ধি
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতি সর্বপ্রথম উপলব্ধি করে যে, ইংরেজ ও ভারতবাসীর স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী। এতদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন, সভ্যতা ও তার উপকারিতা সম্পর্কে ভারতবাসীর যে মোহ ছিল, এই আন্দোলন তা দূর করে এবং ভারতবাসীকে আত্মনির্ভর হবার শিক্ষা দেয়। তারা উপলব্ধি করে যে ব্রিটিশের সদাশয়তার প্রতি আস্থা নয়—নিজের উন্নতি নিজের চেষ্টাতেই করতে হবে।
(৭) ইংরেজ শাসন সম্পর্কে মোহভঙ্গ
বিপ্লবী নায়ক অরবিন্দ ঘোষ বলেন যে, বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতের জাতীয় জীবনে বিধাতার বৃহত্তম আশীর্বাদ। কার্জনের স্বৈরাচারী নীতির ফলেই ভারতবাসী দীর্ঘদিনের মোহনিদ্রা থেকে জেগে উঠেছিল। তাঁর মতে, ইংরেজ শাসন হল ‘মায়া ও বন্ধন’ (‘Maya and bondage’)। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কার্জন সেই মোহ ভঙ্গ করেন (“…Lord Curzon dispelled the illusion.”)।
(৮) সর্বভারতীয় আন্দোলন
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলন এক কর্মচঞ্চল অধ্যায়ের সূচনা করে। এই আন্দোলন কেবলমাত্র বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারতে এই আন্দোলন পরিব্যাপ্ত হয় এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ বলবতী হয়ে ওঠে।
(৯) ঐক্য ও সহযোগিতা
গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেন যে, এই আন্দোলনই প্রথম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও পারস্পরিক সহানুভূতি সৃষ্টি করে এবং সমবেতভাবে জাতির প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তিনি বলেন যে, “বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব থেকে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ফল হল এই যে, এর মধ্য থেকেই সমস্ত দেশ শক্তির একটি উৎস খুঁজে পেয়েছিল। এ জন্য গোটা ভারতবর্ষের ঋণ বাংলার কাছে।”
(১০) প্রকৃত জাগরণ
এই আন্দোলন সম্পর্কে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বলেন যে, “বঙ্গভঙ্গের পরেই ভারতের প্রকৃত জাগরণের সূচনা হয়।”তাঁর মতে বঙ্গভঙ্গ থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর ভাঙ্গনের সূচনা হয়।” তিনি আরও বলেন যে, স্বদেশী আন্দোলন বাংলায় যে সংগ্রামী চেতনার সঞ্চার করে তা উত্তরে পাঞ্জাব ও দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়।
(১১) জাতীয় গণসংগ্রাম
ডঃ আদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন যে, “স্বদেশী আন্দোলন ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় গণ-সংগ্রামের প্রথম পর্যায় মাত্র। ”উইল ডুরান্ট (Will Durant)-এর মতে, “১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতবর্ষে বিপ্লবের সূচনা।”
(১২) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে প্রথম গতিশীল সংগ্রামমুখী আন্দোলনের সূচনা হয়। আবেদন-নিবেদন, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি নয়—স্বদেশী ও বয়কট-এর অস্ত্র হাতে নিয়ে আত্মোৎসর্গ ও আত্মদানের মাধ্যমে জাতি সেদিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-এ অবতীর্ণ হয়।
(১৩) প্রকাশ্যে লক্ষ্য ঘোষণা
প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় যে, জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য ‘স্বরাজ’ লাভ—কিস্তিবন্দি সংস্কার নয়। গান্ধীজি পরবর্তীকালে লিখেছিলেন যে, “বঙ্গভঙ্গের পর দেশের মানুষ বুঝেছিল যে শুধু আবেদন-নিবেদনে কোনও কাজ হবে না, কিছু জোর খাটাতেই হবে এবং তার জন্য ক্লেশ বরণেও অভ্যস্ত হতে হবে।”
(১৪) বাস্তব রাজনীতি
ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “স্বদেশী আন্দোলন জাতীয়তাবাদকে তত্ত্ব ও আবেগের রাজ্য থেকে বাস্তব রাজনীতির জগতে নিয়ে আসে।
(১৫) সর্বশ্রেণীর আন্দোলন
স্বদেশী আন্দোলনই প্রথম জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের বৈঠকি রাজনীতির স্বল্প পরিসর থেকে মুক্ত করে ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও নারীসমাজ—এক কথায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রসারিত করে।
(১৬) পরবর্তী আন্দোলনে প্রভাব
পরবর্তীকালে গান্ধীজির নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন—এ সবই স্বদেশী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
(১৭) জাতীয় আত্মসচেতনতা
জি. সুব্রহ্মণ্য আয়ার (G. Subramania Aiyar) বলেন যে, “কংগ্রেস শিক্ষিত ভারতবাসীকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় আত্মসচেতনার বীজ বপন করেছিল স্বদেশী আন্দোলন।
(১৮) সামগ্রিক জাতীয় আন্দোলন
ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, “বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ছিল সামগ্রিক ধরনের একটি জাতীয় আন্দোলন, এটি মাত্র কোনও একটি বিশেষ শ্রেণীগত আন্দোলন রূপে আবির্ভূত হয় নি।”
(১৯) গঠনমূলক স্বদেশী
স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে গঠনমূলক স্বদেশীর প্রচার হয়, অর্থাৎ গ্রাম সংগঠন, গ্রামীণ আদালত গঠন, মাতৃভাষায় জাতীয় শিক্ষা, কুটির শিল্পের প্রসার এবং ‘স্বদেশী’ ও ‘বয়কট’ -এর আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
(২০) স্বদেশী প্রতিষ্ঠানের উত্থান
দেশের অভ্যন্তরে নানা স্বদেশী শিল্প, কারখানা, ব্যাঙ্ক, জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ -এর স্বদেশী সমাজ’-এর চিন্তাধারা এবং গঠনমূলক স্বদেশীর আদর্শ গান্ধীবাদী কলাকৌশলের ইঙ্গিত দেয়। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ‘জাতীয় শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
(২১) বিপ্লবী আন্দোলন
এই সময় থেকেই ভারতে বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা হয়। ব্রিটিশ দমননীতির চাপে ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন ব্যর্থ হলে বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র বৈপ্লবিক কর্মপ্রয়াস শুরু হয়।
(২২) গুপ্ত সমিতি গঠন
বাংলা ও বাংলার বাইরে বহু গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনায় ‘অনুশীলন সমিতি‘ ও ‘যুগান্তর দল’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
(২৩) সাংস্কৃতিক জাগরণ
কেবলমাত্র রাজনৈতিক দিকই নয়—স্বদেশী আন্দোলন বাংলা সাহিত্য, নাটক, বিজ্ঞান, শিল্প, সংগীত ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন উদ্দীপনা ও প্রাণ-চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। স্বদেশী আন্দোলন বাঙালির জীবন ও মননে এক অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। অধ্যাপক সুমিত সরকার বলেন যে, আমাদের জাতীয় আন্দোলনের আর কোনও পর্বে এমন সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জাগরণ দেখা যায় নি।
(২৪) নতুন চেতনার সৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মুকুন্দ দাস, ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ, অসিত হালদার ও নন্দলাল বসুর অনবদ্য সৃষ্টি সমূহ জাতির প্রাণে নতুন চেতনার সৃষ্টি করে।
উপসংহার :- এক কথায় বলা যায় যে, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলন সত্যই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ডঃ আদিত্য মুখোপাধ্যায়-এর মতে “এই শতাব্দীর সূচনায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন একলাফে অনেকখানি এগিয়ে যায়।” ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, “বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক বিরাট বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
(FAQ) স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
লর্ড কার্জন।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন বা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন।
বঙ্গভঙ্গ রদ।