সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ধারণার আবির্ভাব, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কথাটির ব্যবহার, সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা, উপনিবেশিকতাবাদ, উপনিবেশের ধারণা, উপনিবেশিকতাবাদের সংজ্ঞা, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা, উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা, ভৌমিক সাম্রাজ্যবাদ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিষয়ে জানবো।
সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ
ঐতিহাসিক ঘটনা | সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ |
লাতিন ইম্পেরিয়াম | সাম্রাজ্যবাদ |
লাতিন কলোনিয়া | উপনিবেশিকতাবাদ |
ফরাসি সম্রাট | নেপোলিয়ন বোনাপার্ট |
প্রথম সাফল্য | পর্তুগাল ও স্পেন |
শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন | ইংল্যান্ড |
ভূমিকা:- সামরিক শক্তি, অর্থসম্পদ ও প্রযুক্তি বিষয়ে অধিকতর শক্তিশালী কোনো রাষ্ট্র যখন তার চেয়ে দুর্বল কোনো রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তখন সেই শক্তিশালী রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং দুর্বল রাষ্ট্রকে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির উপনিবেশ বলা হয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের ধারণা একে অপরের পরিপূরক।
সাম্রাজ্যবাদ ধারণার আবির্ভাব
এই ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারণা একদিনে আবির্ভূত হয়নি। মানুষের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা ও লোভ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতাবাদের জন্ম
সাম্রাজ্যবাদ
লাতিন ‘ইম্পেরিয়াম’ শব্দ থেকে ‘ইম্পেরিয়ালিজম’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। প্রথমদিকে এর অর্থ ছিল সামরিক কর্তৃত্ব। পরবর্তীকালে এর অর্থ দাঁড়ায় বৃহৎ রাষ্ট্রের দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
সাম্রাজ্যবাদ কথাটির ব্যবহার
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাজত্বের পরবর্তীকালে ইউরোপ-এ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি নিন্দাসূচক অর্থে ব্যবহার করা শুরু হয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ লেখকরা নিন্দাসূচক অর্থটি বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের নতুন অর্থ স্থির করেন। ক্রমে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ো যায়।
সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা
এই সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পণ্ডিতরা একমত হতে পারেন নি। যেমন –
- (ক) মরগ্যানথাউ বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্রের নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে অন্য রাষ্ট্রের ওপর ক্ষমতা বিস্তারের নীতিকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলা যায়।
- (খ) চার্লস হজেজ মনে করেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হল কোনো একটি দেশের দ্বারা অন্য কোনো দেশের ওপর প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
- (গ) চালর্স বেয়ার্ড বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্র দ্বারা অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল এবং দখল করা ভূখণ্ডে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার নীতিই হল সাম্রাজ্যবাদ।
উপনিবেশিকতাবাদ
লাতিন ‘কলোনিয়া’ শব্দ থেকে ‘কলোনি’ বা ‘উপনিবেশ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘উপনিবেশ’ শব্দটির মূল অর্থ হল ‘মানবসমাজের একটি স্থানান্তরিত অংশ’। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপনিবেশ বলতে বোঝায় –
(ক) দেশের সীমান্তের বাইরে কোনো রাষ্ট্রের বসতি স্থাপন। অথবা, (খ) রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ড, যে ভূখণ্ড উক্ত রাষ্ট্রের কাছে নির্দিষ্টভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে।
উপনিবেশের ধারণা
বর্তমান কালে উপরোক্ত দ্বিতীয় অর্থে উপনিবেশের ধারণা প্রকাশ করা হয়। উপরোক্ত প্রথম ধরনের উপনিবেশকে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে এবং দ্বিতীয় ধরনের উপনিবেশকে শোষণের জন্য দখল করা হয়।
উপনিবেশিকতাবাদের সংজ্ঞা
ঔপনিবেশিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। যেমন –
- (ক) জে. এ. হবসন বলেছেন যে, “ঔপনিবেশিকতা হল জাতীয় জনসমাজের প্রাকৃতিক ধারা। নতুন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে নিজেদের সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করার ক্ষমতাই হল ঔপনিবেশিকতার অস্তিত্বের প্রমাণ।”
- (খ) রুপার্ট এমারসন মনে করেন যে, “ঔপনিবেশিকতা হল কোনো বিদেশি জনসাধারণের ওপর দীর্ঘকাল ধরে শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা”।
ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদের সাফল্য শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই সাম্রাজ্যবাদ কথাটির সঙ্গে উপনিবেশের ধারণাটি সংযুক্ত হয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ধারণাটির প্রচলন ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক জনগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার বিষয়টি জড়িত থাকে।
ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা
- (১) সুদূর ঐতিহাসিক কাল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রয়োগ এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল। প্রাচীনকালে হিট্টাইট, ইনকা, গ্রিক, ম্যাসিডনীয় প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছিল।
- (২) তবে আধুনিক কালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে যে সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তা এককথায় অভূতপূর্ব।
- (৩) আধুনিক ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ শুরু হয় পঞ্চদশ শতকে সামুদ্রিক অভিযানের যুগ থেকে। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সমুদ্র অভিযানে খুবই দক্ষতা দেখায়।
পোর্তুগাল ও স্পেনের সাফল্য
- (১) সমুদ্রাভিযানে প্রথমদিকে সর্বাধিক সাফল্য দেখায় পোর্তুগাল ও স্পেন। শীঘ্রই সমুদ্র অভিযান নিয়ে পোর্তুগাল ও স্পেনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার এক ‘বুল’ বা নির্দেশনামার দ্বারা স্পেনের সামুদ্রিক অভিযান-এর এলাকা নির্দিষ্ট করে দেন।
- (২) কিন্তু এতে পোর্তুগাল আপত্তি জানালে শেষ পর্যন্ত ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে উভয় দেশের মধ্যে টরডিসিল্লাস-এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর দ্বারা আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্বদিক পোর্তুগালের এবং পশ্চিমদিক স্পেনের নৌ-অভিযানের এলাকা বলে চিহ্নিত হয়।
উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা
- (১) পোর্তুগাল এবং স্পেন ছাড়াও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে সমুদ্রাভিযানে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ বিশেষ সাফল্য দেখায়। এসব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি। নৌবিদ্যায় পারদর্শী এসব দেশ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন নতুন ভূখণ্ড ও জলপথ আবিষ্কার করে।
- (২) তারা আমেরিকা, আফ্রিকার উপকূল, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতবর্ষ, পূর্ব এশিয়া প্রভৃতি স্থানে পদার্পণ করে সেইসব স্থানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। পরবর্তীকালে আরও বহু স্থানের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ইউরোপীয়রা সেখানে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
ভৌমিক সাম্রাজ্যবাদ
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ইউরোপের স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভূখন্ড দখল করে সেখানে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এই সাম্রাজ্যবাদ ‘ভৌমিক সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। ভৌমিক সাম্রাজ্যবাদের ধারা ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা
- (১) পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের কাজে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ক্রমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। কিন্তু উপনিবেশের প্রসারকে কেন্দ্র করে শীঘ্রই ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
- (২) এই পরিস্থিতিতে অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স স্পেনের উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭০০-১০ খ্রি.), অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০-৪৮ খ্রি.), সপ্তবর্ষের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬০ খ্রি.) প্রভৃতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ফ্রান্সের শক্তি নাথেষ্ট পরিমাণে ক্ষয় হয়।
- (৩) এরূপ পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১৭৮৩ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ ইংল্যান্ডের একাধিপত্যের যুগ হিসেবে পরিচিত।
নবজাগরণ
পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ-এর উদ্ভব ঘটে তার আলোর ছটা সমগ্র ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়ে। এই নবজাগরণ ইউরোপের মানুষের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন আনে। নবজাগরণের প্রভাবে মানুষের জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করে এবং নতুন নতুন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়। ইতালির শহরগুলি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। কৌতূহল নিরসন ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ইউরোপের মানুষ সমুদ্রপথে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশায় মেতে ওঠে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন
পঞ্চদশ শতকের পূর্বে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূখন্ড মানুষের কাছে অজানা ছিল। অজানা ও অচেনা দেশকে জানা ও চেনার জন্য ইউরোপের কয়েকটি দেশ সর্বপ্রথম উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে ইউরোপীয় বণিকদের লক্ষ্য ছিল আবিষ্কৃত নতুন নতুন ভূখণ্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের বাণিজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করা।
উপসংহার :- নতুন দেশ আবিষ্কার ও নিজেদের বাণিজ্যিকে আরও সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নৌবিদ্যায় পারদর্শী ইউরোপীয় দেশগুলি ভৌগোলিক আবিষ্কার বা সামুদ্রিক অভিযান শুরু করে। এই ভৌগোলিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই সাম্রাজ্যবাদের সূত্রপাত ঘটে।
(FAQ) সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
লাতিন ইম্পেরিয়াম শব্দ থেকে।
লাতিন কলোনিয়া শব্দ থেকে।
পর্তুগাল ও স্পেন।