প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব প্রসঙ্গে জার্মানির বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে জার্মানির প্ররোচনা, ওয়েল্ট পলিটিক নীতি, রি ইনসিওরেন্স চুক্তি বাতিল, বলকানে আগ্ৰাসী নীতি, অস্ট্রিয়ার উপর চাপ, জার্মানি একা দায়ী নয় হিসেবে যুদ্ধ এড়াবার আন্তরিক চেষ্টা, আঁতাত জোটের বেষ্টনী, সব শক্তির দায়িত্ব, প্রকৃত কারণ হিসেবে পরস্পর বিরোধী শিবির, ইঙ্গ-ফরাসি মনোভাব, বলকান সমস্যার দায়িত্ব, জার্মানির একক দায়িত্ব নয় ও গর্ডন ক্রেইগের মন্তব্য সম্পর্কে জানবো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব |
সময়কাল | ১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান জোট | ত্রিশক্তি মৈত্রী ও ত্রিশক্তি চুক্তি |
ত্রিশক্তি মৈত্রী | জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি |
ত্রিশক্তি চুক্তি | ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া |
ভূমিকা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী কে? – এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। একদা যুদ্ধ সৃষ্টির সব দায়িত্ব জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়মকে এর জন্য দায়ী করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে অভিযোগ
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। যেমন –
(১) জার্মানির প্ররোচনা
জার্মান ঐতিহাসিক ইম্যানুয়েল জাইস বলেন যে, জার্মানির প্ররোচনার ফলেই সেরাজেভো ঘটনা থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
(২) ফিশারের মন্তব্য
জার্মান ঐতিহাসিক ফ্রিৎস ফিশার-এর মতে, ১৯১১ থেকেই জার্মানি যুদ্ধ চেয়েছে, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১৪-তে যুদ্ধ বাধাবার ব্যবস্থা করেছে। পিনসন-ও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন।
(৩) ওয়েল্ট পলিটিক নীতি
দ্বিতীয় উইলিয়ম ‘ওয়েন্ট পলিটিক’ বা বিশ্ব-রাজনীতিতে জার্মানির একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিসমার্ক -এর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি পরিত্যাগ করে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন।
(৪) রি-ইনসিওরেন্স চুক্তি বাতিল
কাইজার রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির রি-ইনসিওরেন্স চুক্তি বাতিল করে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তির পথ সুগম করে দেন।
(৫) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরোধিতা
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। জার্মানির নৌ-শক্তি বৃদ্ধি ইংল্যান্ডের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বুয়োরদের সাহায্য দানের চেষ্টা করেন এবং মরক্কোয় ফরাসিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামেন।
(৬) বলকানে আগ্ৰাসী নীতি
কাইজার নিজ স্বার্থে বলকানে তুরস্ক-এর সঙ্গে সমঝোতায় আসেন এবং অস্ট্রিয়াকে বলকানে আগ্রাসী নীতি গ্রহণে প্রণোদিত করেন।
(৭) অস্ট্রিয়ার উপর জার্মানির চাপ
অস্ট্রিয়া হয়তো সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড আপসে মিটিয়ে নিত, কিন্তু জার্মানির চাপেই তা সম্ভব হয় নি।
(৮) রাশিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে রাশিয়া সার্বিয়ার পাশে দাঁড়ায়। এই কারণে জার্মানিই ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট রাশিয়া এবং ৩রা আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে আলাপ-আলোচনার সব পথ বন্ধ হয়ে যায় ।
(৯) ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা
জার্মান পুঁজিপতি, শিল্পপতি ও সমরনায়কদের উন্মাদনা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। কাইজার ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা করলে আদৌ এ যুদ্ধ হত না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি একা দায়ী নয়
বলা বাহুল্য যুদ্ধ-সৃষ্টির দায়িত্ব এককভাবে জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায় হবে। কারণ,
(১) যুদ্ধ এড়াবার আন্তরিক চেষ্টা
মার্কিন ঐতিহাসিক জন ফে তাঁর ‘Origins of the First World War’ গ্রন্থে বলেন যে, ভার্সাই চুক্তিতে মিত্রজোট যেভাবে কাইজারের উপর যুদ্ধের সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়, তা ঠিক নয়। তাঁর মতে, যুদ্ধের পূর্ব-মুহূর্তে জার্মানি আন্তরিকভাবে যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা করে।
(২) আঁতাত জোটের বেষ্টনী
এগমন্ট জেচলিন বলেন যে, আঁতাত শক্তিজোট যেভাবে চারদিক থেকে জার্মানিকে বেষ্টন করতে চেয়েছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে আত্মরক্ষার তাগিদে জার্মানি অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়।
(৩) সব শক্তির দায়িত্ব
অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর-এর মতে, যুদ্ধের জন্য সব শক্তিই দায়ী ছিল। জার্মান ঐতিহাসিক উলফগ্যাং হেইগ বলেন যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া কোনওভাবেই জার্মানির মতো একটি নতুন রাষ্ট্রের উত্থান সহ্য করতে পারে নি এবং এই কারণেই তারা জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক নীতি গ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রকৃত কারণ
যুদ্ধ-সৃষ্টির জন্য কখনোই জার্মানিকে একা দায়ী করা যায় না এবং কেবল কাইজারের আগ্রাসী নীতির জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে নি। যেমন –
(১) পরস্পর বিরোধী শিবির
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম যখন সিংহাসনে বসেন তখনই ইউরোপ দুটি পরস্পর-বিরোধী শিবিরে বিভক্ত ছিল। কুটকৌশলী বিসমার্ক সেই বিরোধকে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
(২) ইঙ্গ-ফরাসি মনোভাব
সামরিক শক্তির দিক থেকে ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষ অস্ট্রো-জার্মান পক্ষ অপেক্ষা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল এবং ইঙ্গ-ফরাসি মনোভাবে জার্মানিও আতঙ্কিত ছিল।
(৩) বলকান সমস্যার দায়িত্ব
বলকান সমস্যার জন্য কেবল জার্মানি নয়-সার্বিয়া, রাশিয়া এবং ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষেরও দায়িত্ব কম ছিল না। ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষই রাশিয়াকে আক্রমণাত্মক কাজে প্ররোচিত করে।
(৪) জার্মানির একক দায়িত্ব নয়
উগ্র জাতীয়তাবাদ, গোপন সামরিক চুক্তি, বলকান সমস্যা বা ইউরোপের দুই শিবিরে বিভাজন – এগুলির জন্য কখনোই জার্মানি একা দায়ী নয়।
(৫) গর্ডন ক্রেইগের মন্তব্য
অধ্যাপক গর্ডন ক্রেইগ বলেন যে, বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি একা দায়ী নয়। আলসাস-লোরেন পুনরুদ্ধারের জন্য ফ্রান্সের উগ্র মনোভাব, বলকানে অস্ট্রো-রুশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্রিটেনের নৌ-আধিপত্য ও উপনিবেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রভৃতি কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনে ক্রিয়াশীল ছিল।
উপসংহার:- অধ্যাপক ডেভিড টমসন-এর মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য এককভাবে কোনও ব্যক্তি বা জাতিকে দায়ী করা যায় না। এই যুদ্ধ ছিল ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া ঘটনা প্রবাহের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি।
(FAQ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৪ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ।
ত্রিশক্তি মৈত্রী বা ট্রিপল অ্যালায়েন্স ও ত্রিশক্তি চুক্তি বা ত্রিশক্তি আঁতাত।
জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালি।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া।
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম।