১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি বা ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি প্রসঙ্গে পটভূমি হিসেবে চুক্তি নবীকরণের প্রস্তাব বাতিল, জার ও মন্ত্রীসভার ক্ষোভ, রুশ মন্ত্রী কারকফের উদ্যোগ, জার্মানির আগ্ৰহ, রাশিয়ার ধারণা, ইংল্যান্ড-জার্মান মৈত্রীর আশঙ্কা, অপমানজনক মন্তব্য, ফ্রান্সের আগ্ৰহ, ফ্রান্সের সাহায্য, ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি স্বাক্ষর, চুক্তির গুরুত্ব হিসেবে ফ্রান্সের বিচ্ছিন্নতার অবসান, ফ্রান্সের কূটনৈতিক সাফল্য, শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার সূচনা ও ত্রিশক্তি চুক্তি গঠনের প্রথম পদক্ষেপ সম্পর্কে জানবো।
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি |
সময়কাল | ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ |
স্বাক্ষরকারী | ফ্রান্স ও রাশিয়া |
বিরোধী জোট | ত্রিশক্তি মৈত্রী |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা :- বিসমার্ক -এর পতনের পর জার্মানি এমন কতকগুলি কাজ করে, যার ফলে রাশিয়া ও ফ্রান্স কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তির পটভূমি
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তির পটভূমি ছিল নিম্নরূপ। –
(১) চুক্তি নবীকরণের প্রস্তাব বাতিল
জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়ম রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী বজায় রাখতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুভালভ জার্মানির কাছে রি-ইনসিওরেন্স চুক্তি (১৮৮৭) নবীকরণের প্রস্তাব দিলে মন্ত্রী ফ্রেডারিখ হলস্টাইন-এর পরামর্শে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম এই প্রস্তাব সরাসরি বাতিল করে দেন।
(২) জার ও মন্ত্রীসভার ক্ষোভ
চুক্তির নবীকরণ প্রস্তাব বাতিল হলে জার প্রবল অপমানিত বোধ করেন। ক্ষুব্ধ রুশ মন্ত্রীসভাও স্থির করে যে, জার্মানি অস্ট্রিয়া শক্তিজোটের বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য রক্ষার জন্য রাশিয়ার উচিত ফ্রান্সের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া।
(৩) রুশ মন্ত্রী কারকফের উদ্যোগ
রুশ মন্ত্রী কারকফ ছিলেন ফরাসি মৈত্রীর সমর্থক। তিনি জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে বোঝান যে, “রাশিয়ার কাঁধে চড়ে জার্মানি আজ এত বড়ো হয়েছে। অকৃতজ্ঞ জার্মানি এখন রাশিয়াকে পরিত্যাগ করেছে।”
(৪) ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি-অস্ট্রিয়া ইতালির মধ্যে ত্রিশক্তি মৈত্রী নবীকরণ হয়। এর ফলে রাশিয়ার ধারণা হয় যে, রাশিয়া নয়, জার্মানি অস্ট্রিয়ার সঙ্গেই মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী।
(৫) রাশিয়ার ধারণা
ইতিমধ্যে জার্মানি ইংল্যান্ড -এর সঙ্গে রাজনৈতিক আদান-প্রদান শুরু করেছিল। এর ফলে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইংল্যান্ড ও জার্মানি পরস্পরের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী।
(৬) ইংল্যান্ড-জার্মান মৈত্রীর আশঙ্কা
এই সময় তিব্বত, ইরান প্রভৃতি দেশ নিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার বিবাদ চলছিল। এছাড়া, কনস্টান্টিনোপল এলাকায় ইংল্যান্ড রুশ প্রাধান্যের বিরোধী ছিল। সুতরাং ইংল্যান্ড জার্মানির মৈত্রীর সম্ভাবনায় রাশিয়া আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
(৭) অপমানজনক মন্তব্য
কাইজারের মন্ত্রী ফ্রেডারিখ হলস্টাইন ছিলেন ঘোরতর রুশ বিরোধী। রাশিয়া সম্পর্কে তাঁর অপমানজনক মন্তব্যে রাশিয়ায় প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(৮) পূর্ব ইউরোপে জার্মান অনুপ্রবেশের আশঙ্কা
বুলগেরিয়ার সিংহাসনে এক জার্মান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে জার্মান সেনাপতিদের দিয়ে একটি বুলগেরিয় সেনাদল গঠনের চেষ্টা হয়। এতে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়, কারণ পূর্ব ইউরোপ -এ জার্মান অনুপ্রবেশ ঘটলে রুশ-স্বার্থ বিঘ্নিত হত।
(৯) ফ্রান্সের আগ্ৰহ
ইতিমধ্যে নিজ নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে ফ্রান্সও রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফরাসি মন্ত্রী ডেলক্যাসে রুশ মিত্রতার পক্ষে ছিলেন। তিনি এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।
(১০) ফ্রান্সের সাহায্য
রাশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার মোকাবিলা, রেলপথ নির্মাণ এবং শিল্পায়নের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল, ফ্রান্স তা মাত্র ৩% সুদে রাশিয়াকে মঞ্জুর করে।
(১১) ফ্রান্সের প্রতি বিদ্বেষ দূরিভূত
ফ্রান্স থেকে একটি নৌবহর রাশিয়ায় যায় এবং জার নিজে তার অভিবাদন গ্রহণ করেন। এরপর জার ফ্রান্স ভ্রমণ করেন। এইভাবে প্রজাতন্ত্রী ফ্রান্সের প্রতি রাজতন্ত্রী রাশিয়ার বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়।
ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্থির হয় যে, জার্মানি ও ইতালি এককভাবে বা যুগ্মভাবে ফ্রান্স আক্রমণ করলে রাশিয়া ফ্রান্সকে সেনা দিয়ে সাহায্য করবে। অপরদিকে, জার্মানি বা অস্ট্রিয়া এককভাবে বা যুগ্মভাবে রাশিয়া আক্রমণ করলে ফ্রান্স রাশিয়াকে সাহায্য করবে। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি এই চুক্তি অনুমোদিত হয়।
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি সম্পর্কে টেলরের মন্তব্য
অধ্যাপক টেলর বলেন যে, ফ্রান্স ও রাশিয়া একে অন্যকে পছন্দ করুক বা না করুক, তারা কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়।’
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি স্বাক্ষরে বিলম্বের কারণ
অধ্যাপক টেলর বলেন যে, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে, কিন্তু ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের আগে তাদের মধ্যে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় নি। এই বিলম্বের কারণ হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্সের সঙ্গে এই জাতীয় চুক্তির অনীহার কথাই বলা হয়েছে।
ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তির গুরুত্ব
ইউরোপের ইতিহাসে এই চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন –
(১) ফ্রান্সের বিচ্ছিন্নতার অবসান
এই চুক্তির ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে এবং সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে ফ্রান্স নিরাপত্তার আশ্বাস পায়।
(২) ফ্রান্সের কূটনৈতিক সাফল্য
এই চুক্তির দ্বারা জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করা বা আলসাস-লোরেন অঞ্চল পুনরুদ্ধারের কোনও সুযোগ ছিল না। কারণ, এই চুক্তিটি ছিল আত্মরক্ষামূলক। তা সত্ত্বেও এই চুক্তিটি ছিল ফ্রান্সের কূটনৈতিক সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য নজির।
(৩) শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার সূচনা
এই চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে ইউরোপে কোনও শক্তিসাম্য ছিল না। নবসৃষ্ট এই শক্তিজোট ইউরোপে শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার সূচনা করে।
(৪) বিরোধী শক্তি জোট গঠন
জার্মানির নেতৃত্বাধীন ত্রিশক্তি মৈত্রী ছিল একটি প্রবল শক্তিশালী গোষ্ঠী। নতুন ফরাসি-রুশ জোট বিসমার্ক-প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর উপর প্রথম আঘাত হানে। ত্রিশক্তি মৈত্রীর বিরুদ্ধে পাল্টা জোট ত্রিশক্তি চুক্তি বা আঁতাত গঠনের ব্যাপারে এই চুক্তি হল প্রথম পদক্ষেপ।
উপসংহার :- ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি বা ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি ইউরোপে শান্তির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল – কোনও পক্ষই কাউকে আক্রমণ করতে সাহসী ছিল না।
(FAQ) ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও রাশিয়া।
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।