ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি প্রসঙ্গে পটভূমি হিসেবে ইংল্যান্ডের নিঃসঙ্গতার নীতি শিথিল, ইংল্যান্ডের ভীতি, ইংল্যান্ড ও রাশিয়া বিরোধ, জার্মানির প্রত্যাখ্যান, ইঙ্গ-জাপান চুক্তি, ফ্রান্সের উপলব্ধি, ফ্রান্সের প্রকৃত শত্রু জার্মানি, দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি স্বাক্ষর, চুক্তির শর্তাবলী, চুক্তির গুরুত্ব হিসেবে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিচ্ছিন্নতার অবসান ও ফ্রান্সের নিরাপত্তা বর্ধিত সম্পর্কে জানবো।

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি

ঐতিহাসিক ঘটনাইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি
সময়কাল৮ এপ্রিল, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ
স্বাক্ষরকারীইংল্যান্ডফ্রান্স
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ
ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি

ভূমিকা :- ত্রিশক্তি চুক্তি গঠনের পরবর্তী পদক্ষেপ হল ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি। এই চুক্তি সহজসাধ্য ছিল না। কারণ, দু’পক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য ছিল। এই কারণে ইঙ্গ-ফরাসি মিত্রতা প্রতিষ্ঠার জন্য আরও এক দশক অপেক্ষা করতে হয়।

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তির পটভূমি

এই ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তির পটভূমি ছিল নিম্নরূপ। –

(১) ইংল্যান্ডের নিঃসঙ্গতার নীতি শিথিল

ইতিমধ্যে ইউরোপীয় রাজনীতির জটিলতার ফলে ইংল্যান্ডের ‘নিঃসঙ্গতা’-র নীতি ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছিল।

(২) ইংল্যান্ডের ভীতি

জার্মানির বিশ্ব সাম্রাজ্য স্থাপনের ঘোষণা, নৌশক্তি বৃদ্ধি, উপনিবেশ স্থাপন ইংল্যান্ডের মনে ভীতির সঞ্চার করে। ইংল্যান্ড মানে করে যে জার্মান আক্রমণে একদিন ইংল্যান্ডের নৌশক্তি, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

(৩) ইংল্যান্ড-রাশিয়া বিরোধ

আফগানিস্তান, তিব্বত, পারস্য ও মাঞ্চুরিয়া নিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ ছিল।

(৪) ইংল্যান্ড-ফ্রান্স বিরোধ

মিশর ও মরক্কো নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিরোধ ছিল। এই অবস্থায় ইংল্যান্ডের অনেকেই ফ্রাঙ্কো-রুশ জোটের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-জার্মান জোট গঠনের দ্বারা শক্তিসাম্য রক্ষার কথা বলেন।

(৫) জার্মানির প্রত্যাখ্যান

ব্রিটিশ মন্ত্রী চেম্বারলেইন এবং ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড হলডেন অন্তত তিনবার কাইজারের কাছে মিত্রতার প্রস্তাব পাঠান। কাইজার তাদের আবেদনে কোনও সাড়া না দিলে তাঁরা হতাশ হন। ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে যে, ইংল্যান্ডের ‘গৌরবময় বিচ্ছিন্নতা’ ক্রমে ‘ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতা’-য় পরিণত হতে চলেছে।

(৬) ইঙ্গ-জাপান চুক্তি

দূর প্রাচ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিবাদ ছিল। দূর প্রাচ্যের এই রুশ বিরোধিতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার শত্রু জাপানের সঙ্গে ইঙ্গ-জাপান মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির দ্বারা ইংল্যান্ড জাপানকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে প্রয়াসী হয়।

(৭) ফ্রান্সের উপলব্ধি

ইতিমধ্যে নবনিযুক্ত ফরাসি বিদেশমন্ত্রী থিওফিল ডেলক্যাসে উপলব্ধি করেন যে, একই সঙ্গে ইংল্যান্ড ও জার্মানির বিরুদ্ধাচারণ করা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তার এবং আলসাস-লোরেন অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ডের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়া উচিত।

(৮) ফ্রান্সের প্রকৃত শত্রু জার্মানি

তিনি স্পষ্টই বলেন যে, ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিরোধের বিষয়গুলি গুরুত্বহীন এবং জার্মানির সঙ্গে তার বিরোধ হল মৌলিক। ফ্রান্সের প্রকৃত শত্রু ইংল্যান্ড নয়, জার্মানি। তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে জোট গঠনের পক্ষে জোর সওয়াল করেন।

(৯) দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

এই ব্যাপারে ইংল্যান্ডের আগ্রহও কম ছিল না। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড-রাজ সপ্তম এডওয়ার্ড ফ্রান্স ভ্রমণে গেলে বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতিও ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি স্বাক্ষর

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ই এপ্রিল ইঙ্গ-ফরাসি ঘনিষ্ঠ মৈত্রী বা আঁতাত করডিয়েল গড়ে ওঠে।

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তির শর্তাবলী

এই মিত্রতার দ্বারা স্থির হয় যে,

  • (১) উভয় দেশ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের সব বিরোধ মিটিয়ে নেবে।
  • (২) মিশরে ইংল্যান্ড এবং মরক্কোয় ফ্রান্সের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনও বাধা দেওয়া হবে না।
  • (৩) শ্যামদেশ, মাদাগাস্কার, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে উভয় দেশ নিজ নিজ প্রভাব বলয় বা কর্তৃত্বের এলাকা স্থির করে নেবে।
  • (৪) ভূমধ্যসাগরে ফরাসি নৌবহর এবং ইংলিশ চ্যানেল ও উত্তর সমুদ্রে ব্রিটিশ নৌবহর দ্বারা জার্মানির বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
  • (৫) এই সন্ধির একটি গোপন শর্তে স্বাক্ষরকারী দুই দেশ সন্ধির শর্তাবলী কার্যকর করার ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তির গুরুত্ব

ইঙ্গ-ফরাসি আন্তরিক চুক্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যেমন –

(১) পারস্পরিক বোঝাপড়া

এটি কোনও সামরিক চুক্তি ছিল না। এর লক্ষ্য কাউকে আক্রমণ করা নয়। এটি ছিল উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বোঝাপড়া মাত্র।

(২) বন্ধুত্বের সম্পর্ক

এই চুক্তি দ্বারা ইউরোপ -এ শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। দুই রাষ্ট্র -এর মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ায় উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।

(৩) ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিচ্ছিন্নতার অবসান

এই চুক্তির ফলে ইংল্যান্ডের শতাব্দীব্যাপী গৌরবময় বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। ইংল্যান্ড জার্মান-বিরোধী শিবিরে যোগদান করে। এটি ছিল ত্রিশক্তি চুক্তি গঠনের পথে দ্বিতীয় পদক্ষেপ।

(৪) ফ্রান্সের নিরাপত্তা বর্ধিত

এই চুক্তিটি ফ্রান্সের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। এর দ্বারা জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের নিরাপত্তা বর্ধিত হয়।

উপসংহার :- এই চুক্তিটি দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটিয়ে দুই দেশের মধ্যে মিত্রতার সূচনা করে। তাই অনেকে একে ‘কূটনৈতিক বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।

(FAQ) ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কখন কাদের মধ্যে ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়?

৮ এপ্রিল, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স।

২. ত্রিশক্তি চুক্তি গঠনের প্রথম পদক্ষেপ কি ছিল?

ফ্রান্স-রাশিয়া চুক্তি (১৮৯৪)।

৩. ত্রিশক্তি চুক্তি গঠনের দ্বিতীয় পদক্ষেপ কি ছিল?

ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি (১৯০৪)।

৪. ত্রিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

Leave a Comment