প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিবর্তন প্রসঙ্গে ভারতে জাতিপ্রথার উদ্ভব সম্পর্কে বির্তক, ভারতে জাতি ব্যবস্থার সূচনা ঋকবৈদিক যুগে, ভারতে জাতি ব্যবস্থার সূচনা পরবর্তী বৈদিক যুগে, ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের উপাদান, পরবর্তী বৈদিক যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন, প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন, মৌর্য যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন, মৌর্য-পরবর্তী যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন, গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী যুগে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন ও ভারতে জাতিভেদ প্রথায় মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব সম্পর্কে জানবো।
ভারতে প্রাচীন যুগে জাতিভেদ প্রথার বিবর্তন প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতে জাতিপ্রথার উদ্ভব সম্পর্কে বির্তক, ঋকবৈদিক যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব, প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের উপাদান, প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন, ভারতে মৌর্য যুগে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন ও গুপ্ত যুগে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন সম্পর্কে জানব।
প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিবর্তন
ঐতিহাসিক ঘটনা | প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিবর্তন |
সূচনা | ঋকবৈদিক যুগ |
সুস্পষ্ট রূপ | যজুর্বেদের যুগ |
সমাজ বহির্ভূত | ব্রাত্য ও নিষাদ |
পতিত ক্ষত্রিয় | শক, যবন, হুন |
পার্থিয়ান রাজা | গণ্ডোফারনেস |
শক রাজা | রুদ্রদামন |
ভূমিকা :- আর্যরা আজ থেকে প্রায় ৩৫০০ বছর আগে ভারতবর্ষ-এর সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসতির বিস্তার ঘটায়। ভারতে আগমনকালে আর্য সমাজে বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব ছিল কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।
ভারতে জাতিপ্রথার উদ্ভব সম্পর্কে বির্তক
- (১) প্রাচীন ভারতে কৃষ্ণাঙ্গ অনার্যদের থেকে নিজেদের প্রভেদ বজায় রাখার জন্য বৈদিক সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চতুর্বর্ণপ্রথার সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজে আরও বিভিন্ন ধরনের পেশার সৃষ্টি হয় এবং নতুন পেশাগুলিতে বহু মানুষ যুক্ত হয়। এ ছাড়াও, কালের নিয়মেই পূর্বতন চতুর্বর্ণ প্রথায় নানা সংমিশ্রণ দেখা দেয় এবং বিভিন্ন নতুন মিশ্রবর্ণের সৃষ্টি হয়।
- (২) এই বর্ণপ্রথা থেকেই ক্রমে জাতিপ্রধার উত্থান ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঋগ্বৈদিক যুগে বর্ণপ্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশেষ বিতর্ক না থাকলেও এই সময় ভারতে জাতিপ্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
ঋকবৈদিক যুগে ভারতে জাতি ব্যবস্থার সূচনা
- (১) কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, ঋগ্বৈদিক যুগের শুরু থেকেই আর্য সমাজে জাতিভেদপ্রথার অস্তিত্ব ছিল। তাদের মতে, ঋগবেদের পুরুষসূক্তে বংশানুক্রমে ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চারটি জাতির উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে।
- (২) তাঁদের মতে, কর্ম বা পেশার ভিত্তিতে নয়, আর্য সমাজে জন্মসূত্রেই বর্ণ বা জাতির অবস্থান সুনির্দিষ্ট হয়। কারণ, কোনো একজন বৈশ্যের উত্তরপুরুষ অন্য পেশা গ্রহণ করলেও জন্মগতভাবে সে বৈশ্য বলেই বিবেচিত হয়। এই বিচারে, ঋকবৈদিক যুগের চারটি বর্ণ প্রকৃতপক্ষে জন্মসূত্রে চারটি জাতি হয়ে ওঠে। এই চারটি জাতি থেকে পরবর্তীকালে আরও বহু জাতির সৃষ্টি হয়।
ভারতে জাতি ব্যবস্থার সূচনা পরবর্তী বৈদিক যুগে
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ পুরুষসূক্তের সৃষ্টিতত্ত্বকে অলীক কল্পনা আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, বৈদিক সমাজে জাতিভেদপ্রথার প্রচলন ঘটেছিল আরও পরে। তাদের মতামত হল –
(১) সামাজিক সম্পর্ক
ঋকবৈদিক যুগে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ছিল, তাদের মধ্যে মেলামেশায় বা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
(২) পেশা বংশানুক্রমিক ছিল না
তা ছাড়া, যে পেশার ভিত্তিতে আর্যদের বর্ণ নির্ধারিত হয়েছিল সেই পেশাও বংশানুক্রমিক ছিল না। তাই ড. এ. এল. বাসাম মনে করেন যে, ঋকবৈদিক যুগের সমাজে শ্রেণি-বৈষম্য থাকলেও জাতি-বৈষম্য ছিল না।
(৩) নেশন-এর ধারণা অনুপস্থিত
প্রকৃতপক্ষে আধুনিক কালে ‘নেশন’ (Nation) বলতে যে জাতিগত ধারণাকে বোঝানো হয় তার অস্তিত্ব ঋকবৈদিক যুগে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
(৪) বর্ণ ও জাতিপ্রথার যোগসূত্র
কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা বলাই যায় যে, বর্ণ ও জাতিপ্রথার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র বর্তমান এবং জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবে বর্ণপ্রথার যথেষ্ট অবদান ছিল।
(৫) সুস্পষ্ট জাতিভেদ প্রথা
পরবর্তী বৈদিক যুগ-এ পূর্ব ভারতে আর্য বসতির প্রসার ঘটতে থাকলে সমাজে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তখনই অর্থাৎ যজুর্বেদের যুগে সমাজে জাতিভেদপ্রথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন।
ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের উপাদান
প্রাচীন ভারতে কোন কোন উপাদান বা বিষয়গুলি জাতি প্রথার উদ্ভবে সহায়তা করেছিল সে সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। যেমন –
(১) বর্ণপ্রথার ভূমিকা
- (i) ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব সম্পর্কে ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ঋকবৈদিক সমাজে পেশাগত ভিত্তিতে যে বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটেছিল পরবর্তীকালে তা থেকেই জাতিভেদপ্রথার উদ্ভব ঘটে। ঐতিহাসিক ড. ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে আর্য সমাজের বিভিন্ন উপজাতিগুলি ভেঙে পড়তে থাকে এবং তখনই জাতিভেদপ্রথার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
- (ii) ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন যে, আর্যদের “এই চতুর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কারণ ভারতবর্ষে এই চতুর্বর্ণের বাইরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কৌম ছিল। প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কৌমের ভিতরে আবার ছিল অসংখ্য স্তর, উপস্তর।” এই সব স্তর, উপস্তর থেকেই ভারতে জাতিপ্রথার উদ্ভব ঘটে।
(২) রিজলের অভিমত
হার্বাট রিজলে ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবে কয়েকটি সহায়ক উপাদানের উল্লেখ করেছেন, যার কোনো-না-কোনো উপাদান জাতি গঠনে সহায়তা করেছিল। এই উপাদানগুলি হল –
- (i) নির্দিষ্ট পেশার ভিত্তিতে কোনো উপজাতি বা তার অংশবিশেষের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ,
- (ii) বংশানুক্রমিক পেশার পরিবর্তন করে জাতির পরিবর্তন,
- (iii) ধর্মের ভিত্তিতে জাতি নির্ধারণ,
- (iv) ভাষার ভিত্তিতে জাতির নির্ধারণ প্রভৃতি।
ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
উৎপত্তির পর থেকে ভারতীয় জাতিভেদ প্রথায় নানা বিবর্তন ঘটেছিল। যেমন –
(ক) পরবর্তী বৈদিক যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
পরবর্তী বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৬০০ অব্দ) রচিত বিভিন্ন সংহিতায় সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি জাতির অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। উক্ত চারটি জাতি ছাড়াও আর্য সমাজের বাইরে অবস্থানকারী ‘ব্রাত্য’ ও ‘নিষাদ’ নামে দুটি অস্পৃশ্য জাতির কথা জানা যায়। অথর্ববেদ, শতপথ ব্রাহ্মণ প্রভৃতিতে এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে এবং আরও পরবর্তীকালে এই দুটি জাতির স্থান শূদ্রদের চেয়েও নীচে নেমে যায়। তখন তারা চণ্ডাল নামে পরিচিত হয়।
(১) ব্রাত্য
কেউ কেউ মনে করেন যে, ‘ব্রাত’ শব্দটি থেকে ‘ব্রাত্য’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘রাত’ শব্দের অর্থ হল ‘দল’। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, ব্রাত্যরা সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যধর্ম-বহির্ভূত আর্য ছিল। তবে তারা বেদের বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধিবিধান মানত না বা কোনো যজ্ঞানুষ্ঠান পালন করত না। তারা শৈবধর্মের অনুগামী ছিল। অধ্যাপক দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন যে, ব্রাত্যরা পতিত অর্থাৎ বিধিবিরোধী গোষ্ঠী। যাই হোক, কৃষিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ না করে আর্যদের আদি পেশা পশুপালন এবং যাযাবর জীবনধারাকেই ব্রাত্যরা গ্রহণ করেছিল। তারা সারাবছর ধরে পশুর পাল চরিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত।
(২) নিষাদ
এই নিষাদ জাতি ছিল অনার্য। বর্তমান কালের ‘ভিল’ উপজাতিগোষ্ঠীকে বৈদিক যুগের নিষাদ জাতির সঙ্গে অভিন্ন বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন। নিষাদরা বনেজঙ্গলে বা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করত। তারা চাষবাস করত না। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল বনেজঙ্গলে পশুপাখি শিকার করা। তারা বন্য পশুপাখির উৎপাত থেকে গ্রামের কৃষিজমি ও ফসল রক্ষা করত। তাদের প্রধান খাদ্য ছিল পশুপাখির মাংস ও বনের ফলমূল। অর্থাৎ নিষাদরা তখনও প্রকৃত খাদ্য-উৎপাদনকারী জনগোষ্ঠী (Food Producing Man) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে নি। তাই তাদের খাদ্যসংগ্রহকারী মানুষ (Food Gathering Man) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তারা নিজেরাই ছিল নিজেদের সমাজের শাসক। তারা বৈদিক ধর্ম-এর বিধিবিধান পালন করত না। তারা নিজেদের প্রাচীন ধর্ম পালন করত।
(খ) প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
বর্ণপ্রথা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন-এর যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দ) বংশানুক্রমিক জাতিপ্রথায় রূপান্তরিত হয়। এই সময় আরও কয়েকটি হীনজাতির উদ্ভব ঘটে।
(গ) মৌর্য যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস মৌর্য যুগে ভারতীয় সমাজে সপ্তজাতিতত্ত্ব বা সাতটি জাতির অস্তিত্বের উল্লেখ করেছেন। এই সাতটি জাতি হল দার্শনিক, কৃষক, পশুপালক ও শিকারি, কারিগর ও শিল্পী, সৈনিক, গুপ্তচর বা পরিদর্শক, মন্ত্রণাদাতা।
(ঘ) মৌর্য-পরবর্তী যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
মৌর্য যুগের পরবর্তীকালে একদিকে যেমন বিভিন্ন নতুন জাতির উত্থান ঘটে অন্যদিকে তেমনি শক, গ্রিক, কুষাণ, পহ্লব প্রভৃতি বিদেশি জাতিগুলি ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব
মৌর্য-পরবর্তী যুগে মনুস্মৃতিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। তারা অন্য সকল বর্ণের উপর নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই যুগে শূদ্রদের উপর নানা বাধানিষেধ আরোপ করা হয়।
(২) পতিত ক্ষত্রিয় বা যবন, শক, হুন
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(i) বৈদেশিক জাতির আগমন
মৌর্য-পরবর্তী যুগের ভারতীয় সমাজেও বৈদিক যুগের চতুর্বর্ণ প্রথার অস্তিত্ব ছিল। তবে এই সময় বিভিন্ন বিদেশি অনার্য জাতি ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে সমাজজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে যায়। বহিরাগত এই অনার্য জাতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যবন বা ব্যাকট্রীয় গ্রিক, শক, হুন, কুষাণ প্রভৃতি।
(ii) সমাজে স্থান
এই জাতিগুলি জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হলেও ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মে তারা ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা লাভ করতে পারে নি। বরং ভারতীয় সমাজে তাদের স্থান শূদ্রদের সমগোত্রীয় হয়ে গিয়েছিল। আবার এর ফলে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে শূদ্রদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় শাস্ত্রকাররা শেষপর্যন্ত এদের ক্ষত্রিয় জাতিভুক্ত করেন। এভাবে যবন, শক, হুন, কুষাণ প্রভৃতি বিদেশি জাতিগুলি ভারতীয় সমাজে ‘পতিত ক্ষত্রিয়’ নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রাচীন শাস্ত্রকার মনু এই বহিরাগত জাতিগুলিকে ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
(৩) ভারতে যবন, শক ও হুনদের শাসন
বহিরাগত যবন, শক ও হুন জাতি প্রাচীনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ নিজ রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যেমন –
(i) যবন শাসন
ব্যাকট্রিয়া ও পার্থিয়ার শাসকরা ভারতে মৌর্য শাসনকালে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দ পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়াসহ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে এই বিদেশিরা ‘যবন’ নামে পরিচিত। ভারতে যবনদের শাসন মূলত দুইভাগে বিভক্ত ছিল – বাহ্লিক বা ব্যাকট্রিয় গ্রিক বা ইন্দো-গ্রিক শাসন এবং পহ্লব বা পার্থিয়ান শাসন। ইন্দো- গ্রিক রাজাদের মধ্যে মিনান্দার এবং পার্থিয়ান রাজাদের মধ্যে গন্ডোফারনেস ছিলেন শ্রেষ্ঠ শাসক।
(ii) শক শাসন
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে মোয়েস বা মোগ নামে জনৈক শক রাজার কথা জানা যায়। তাছাড়া মহারাষ্ট্র ও তার সংলগ্ন অংশে ক্ষহরত শাখার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশের রাজধানী ছিল নাসিক ও শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন নহপান। পশ্চিম ভারতে উজ্জয়িনীতে চস্টন নামে জনৈক ব্যক্তি কার্দমক শাখার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন মহাক্ষত্রপ উপাধিধারী রুদ্রদামন (১৩০-১৫০ খ্রি.)
(iii) হুন শাসন
স্কন্দগুপ্ত-এর পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে হুন নেতা তোরমান ও তাঁর পুত্র মিহিরকুল পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের রাজধানী ছিল সাকল বা শিয়ালকোট।
(ঙ) গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে ভারতে জাতিভেদ প্রথায় বিবর্তন
ব্রাহ্মণ জাতির প্রতিপত্তি গুপ্ত যুগে (২৭৫-৫০০ খ্রি.) আরও বৃদ্ধি পায়। স্মৃতিশাস্ত্রগুলি বিভিন্ন জাতির উপর নানা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে অসবর্ণ বিবাহের সূত্রে সমাজে বিভিন্ন মিশ্রজাতির সৃষ্টি হয়। পরবর্তী আদি-মধ্য যুগে জাতি ব্যবস্থায় একই প্রবণতা চলতে থাকে। এই সময় চণ্ডাল ও অন্যান্য অস্পৃশ্য বিভিন্ন জাতি ছিল যারা জনবসতির বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসবাস করত।
ভারতে জাতিভেদ প্রথায় মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(ক) সামাজিক একাত্মতা
পতিত ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত যবন, শক, হুন, কুষাণ ও অন্যান্য বিদেশি জাতিগুলি ভারতে এসে দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় সমাজে বসবাস করায় এখানকার সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। তারা একদিকে যেমন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন রীতিনীতি গ্রহণ করে অন্যদিকে তেমনি তাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু রীতিনীতিও ভারতীয় সংস্কৃতিতে যুক্ত করতে সমর্থ হয়। এভাবে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ফলে ভারতে মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়।
(খ) হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্তি
বিদেশি এই জাতিগুলি ভারতীয় ধর্ম, ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি গ্রহণ করে হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। হিন্দু দেবদেবীর আরাধনা শুরু করে এবং ভারতীয়দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারা সম্পূর্ণ ভারতীয় হয়ে যায়।
(গ) সাংস্কৃতিক সমন্বয়
ব্যাকট্রীয়-গ্রিক রাজা মিনান্দার ও কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক এদেশের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। মিনান্দার ও বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে যে দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয় তা পালি ভাষায় রচিত ‘মিলিন্দ পনহো’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ভারতীয় জাতিগুলির উন্নত সংস্কৃতি ও বহিরাগত জাতিগুলির বীরত্বের সংমিশ্রণে এদেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়।
উপসংহার :- পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী বলেছেন যে, “যারা ভারতবর্ষ অধিকার করতে এসেছিল, হিন্দুসমাজ তাদেরকেই অধিকার করে নেয়।”
(FAQ) প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিবর্তন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
যজুর্বেদের যুগে।
ব্রাত্য ও নিষাদ।
গণ্ডোফারনিস।