বোরিস পাস্তেরনাক

রাশিয়ান কবি, ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক হলেন বোরিস পাস্তেরনাক (Boris Pasternak)। তিনি ১৯৫৮ সালে তাঁর উপন্যাস “ডক্টর জিভাগো”-র জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, যদিও সোভিয়েত সরকার তাঁকে এটি গ্রহণ করতে বাধা দেয়। পাস্তেরনাকের সাহিত্যকর্মে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং প্রেমের গভীর উপলব্ধি ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতা এবং উপন্যাস সোভিয়েত যুগের চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামকে প্রকাশ করে। তিনি বিশ্বসাহিত্যে তাঁর সৃজনশীলতা এবং নৈতিক দৃঢ়তার জন্য স্মরণীয়।

রুশ লেখক বোরিস পাস্তেরনাক

ঐতিহাসিক চরিত্রবোরিস পাস্তেরনাক
পুরো নামবোরিস লিওনিদ ওসিপোভিচ পাস্তেরনাক
জন্ম১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯০ খ্রি
জন্মস্থানমস্কো, রাশিয়া
পেশাকবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক
বিখ্যাত কাজ‘ডক্টর জিভাগো’ (১৯৫৭)
সাহিত্যিক ধারাআধুনিকতাবাদ, রোমান্টিক বাস্তববাদ
উল্লেখযোগ্য অনুবাদউইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও জার্মান কবিদের রচনা
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার১৯৫৮ খ্রি
মৃত্যু৩০ মে ১৯৬০ খ্রি
বোরিস পাস্তেরনাক

ভূমিকা :- অনন্য সাহিত্যকীর্তি যে কজন প্রতিভাবান লেখককে বিশ্ব সাহিত্যক্ষেত্রে চিরস্থায়ী আসন দান করেছে রুশ সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কথাশিল্পী বোরিস পাস্তেরনাক তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

বোরিস পাস্তেরনাকের জন্ম

রাশিয়ার মস্কো শহরে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ১০ই ফেব্রুয়ারী জন্মেছিলেন বোরিস। সময়টা একটা সন্ধিলগ্ন-উনবিংশ শতকের সমাপ্তি এবং বিংশ শতকের প্রারম্ভ। আবির্ভাবের এই ঐতিহাসিক পটভূমি তাঁর জীবন ও সাহিত্যে ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে।

কবি বোরিস পাস্তেরনাকের পরিবার

বোরিসের পিতা লিওনিদ ওসিপোভিচ পাস্তেরনাক ছিলেন একজন দক্ষ এবং বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। অপরদিকে মা রোজালিয়া ইসাদোরোভগা-এর ছিল পিয়ানো বাদনে পারদর্শিতা। ফলে বাড়ির পরিবেশে মিশেছিল এক আবেগময় শৈল্পিক প্রণোদনা। আর এই পরিবেশেই বোরিসের শিল্পীসত্তা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল।

তলস্তয়ের সংস্পর্শে বোরিস পাস্তেরনাক

রাশিয়ার ঋষিতুল্য অমর কথাশিল্পী লিও তলস্তয় ছিলেন বোরিসের বাবা লিওনিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তলস্তয়ের গল্পের ছবি আঁকতেন তিনি। ফলে বাল্যবয়স থেকেই তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছেন বোরিস। স্বপ্নে কল্পনায় এই আশ্চর্য মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্তর্লীন প্রেরণার উৎস।

বোরিস পাস্তেরনাকের লেখক হবার বাসনা

বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেও তাঁরই মত বিখ্যাত চিত্রকর হয়ে উঠুক। তার জন্য তাঁর যত্নেরও ত্রুটি ছিল না। বাবার ছবি আঁকার সময় তলস্তয়কে মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করতেন বোরিস। দেখে দেখে মনের অবচেতনে কখন অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল লেখক হবার বাসনা তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন নি।

কবি বোরিস পাস্তেরনাকের সঙ্গীতের পাঠ

অপরদিকে মায়ের পিয়ানো বাজানো শুনে শুনেই বয়স বেড়ে উঠেছিল। ফলে সঙ্গীতের প্রতিও জন্মে গিয়েছিল ভালবাসা। পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু হয়েছিল সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া।

বোরিস পাস্তেরনাকের শিক্ষা

স্কুলের গন্ডী পার হবার পর দর্শন নিয়ে পড়া আরম্ভ করলেন। প্রথমে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে জার্মানির মারবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কবি বোরিস পাস্তেরনাকের প্রথম কবিতা

লিরিকা নামের পত্রিকায় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বরিসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এভাবেই লেখক বরিস পাস্তেরনাক-এর সাহিত্যাঙ্গনে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। সাহিত্য জীবনকেই উপজীব্য করবার প্রেরণা পান তিনি এই সময় থেকেই।

সৈন্যবাহিনীতে বোরিস পাস্তেরনাক

পরের বছর সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় হলেও পায়ে ত্রুটি থাকার কারণে তাঁর আর যুদ্ধে যোগ দেওয়া হয় নি। সৈন্যবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

বোরিস পাস্তেরনাকের সমকাল

প্রথমে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার শ্রমিক বিপ্লব, জারতন্ত্রের পতন এবং পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঐতিহাসিক এই চরম অস্থিরতা ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বরিসের শৈশব এবং যৌবন অতিক্রান্ত হয়। অক্টোবর বিপ্লবের পর সংঘাতপূর্ণ রাশিয়ায় এল ঐতিহাসিক রূপান্তর। কার্ল মার্কস-এর ভাবাদর্শে প্রাণিত লেনিন এবং স্তালিন এলেন বলশেভিকদেব নেতৃত্বে। দেশ থেকে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা উঠে গেল, সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসেরও ঘটল অবলুপ্তি। এলো গৃহযুদ্ধ। কাতারে কাতারে সাধারণ মানুষ প্রাণ হারালো। এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-স্তালিনগ্রাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, হিটলার-এর পতন এবং স্তালিনোত্তর যুগে ক্রুশ্চেভের আবির্ভাব। সামাজিক ও রাজনৈতিক এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলেছেন পাস্তেরনাক।

কবি বোরিস পাস্তেরনাকের সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে লাইউভার্স চাইল্ডহুড গল্পগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান তিনি। ইতিপূর্বে প্রকাশিত মাই সিস্টারস লাইফ কাব্যগ্রন্থও যথেষ্ট খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে। ফলে আর্থিক সঙ্গতির আশ্বাস পেয়ে মনেপ্রাণে লেখক জীবনকেই বেছে নিলেন।

বোরিস পাস্তেরনাকের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ

পাস্তেরনাকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে অ্যাবাব দ্য বেরিয়ারস এবং মাই সিস্টারস লাইফ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল থিমস অ্যান্ড ভেরিয়েশনস, সেকেণ্ড বার্থ, আরলি ট্রেনস এবং দ্য ভাস্ট আর্থ। তাঁর সর্বশেষ কবিতার বই হোয়েন দ্য স্কাইস ক্লিয়ার।

অনুবাদ কর্মে বোরিস পাস্তেরনাক

কবিতা এবং গল্প উপন্যাস রচনার পাশাপাশি অনুবাদ কর্মেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। ইংরাজি, জার্মান ও ফরাসী ভাষা ভাল জানতেন। ফলে বিদেশী সাহিত্যের সেরা সম্ভার নিয়ে এলেন রাশিয়ান সাহিত্যে। শেকসপীয়ারের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতিলাভ করলেন।

বোরিস পাস্তেরনাকের উপন্যাস

পাস্তেরনাক-এর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ডঃ জিভাগো প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে বেরয় ইতালিয় সংস্করণ। পরে মূল রুশ সংস্করণ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই চমকপ্রদ আলোড়ন সৃষ্টি করল এই বই। ডঃ জিভাগো পৃথিবীর প্রায় সবকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রাশিয়ার শাসকশ্রেণীর সমালোচনা করে লেখা পাস্তেরনাকের এই একমাত্র উপন্যাস সঙ্গত ভাবেই রাশিয়া জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল।

নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত বোরিস পাস্তেরনাক

পরের বছরেই, ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর সুইডিশ একাডেমির ঘোষণায় জানা গেল সেই বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে রুশ সাহিত্যিক বোরিস পাস্তেরনাককে তাঁর ডঃ জিভাগো উপন্যাসের জন্য। রাজনৈতিক কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এই পুরস্কার গ্রহণ করতে পারলেন না পাস্তেরনাক।

বোরিস পাস্তেরনাকের রচনা

লেখকের বিখ্যাত রচনাগুলি হল With my sister’s life (1922) Themes and variations sublime, Maladay, krf the year, Aerial ways (1925) In Early Trains এবং একমাত্র উপন্যাস Doctor Zhivago

কবি বোরিস পাস্তেরনাকের মৃত্যু

১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে মে মানবতাবাদী এই মহান লেখকের জীবনাবসান হয়।

উপসংহার :- বোরিস পাস্তেরনাক ছিলেন একাধারে একজন মহান কবি, ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক, যিনি রাশিয়ার সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর রচনা, বিশেষত “ডক্টর জিভাগো”, সোভিয়েত শাসনের অধীনে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবিক অনুভূতির গভীর চিত্রায়ণ করেছে। তাঁর সাহিত্যে প্রেম, সংগ্রাম, এবং জীবনের জটিল দিকগুলো অত্যন্ত শিল্পিতভাবে ফুটে উঠেছে। সোভিয়েত সরকারের চাপ সত্ত্বেও, পাস্তেরনাকের সৃজনশীলতা এবং সাহিত্যে তাঁর অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। মৃত্যুর পর তিনি আরও সম্মানিত হন এবং তাঁর কাজগুলো নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। বোরিস পাস্তেরনাক একটি যুগের প্রতীক, যাঁর সাহিত্য মানবিক মূল্যবোধের অমর গাথা হয়ে থাকবে।

(FAQ) বোরিস পাস্তেরনাক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বোরিস পাস্তেরনাক কে ছিলেন?

বোরিস পাস্তেরনাক ছিলেন একজন প্রখ্যাত রাশিয়ান কবি ও ঔপন্যাসিক, যিনি তাঁর উপন্যাস “ডক্টর জিভাগো” এবং কবিতার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

২. বোরিস পাস্তেরনাকের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা কোনটি?

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো “ডক্টর জিভাগো”, যা রাশিয়ার বিপ্লব ও যুদ্ধপরবর্তী জীবনের এক মহাকাব্যিক চিত্র তুলে ধরে।

৩. কেন তিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?

সোভিয়েত সরকারের চাপে তিনি ১৯৫৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

৪. তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রধান থিম কী ছিল?

তাঁর রচনাগুলোতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, প্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, জীবন ও মৃত্যুর দর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

৫. বোরিস পাস্তেরনাকের অনুবাদকর্মগুলো কী ছিল?

তিনি শেক্সপিয়ারের নাটকসহ বহু জার্মান ও ইংরেজি সাহিত্যকর্ম রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন।

৬. তিনি কীভাবে রাশিয়ার সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন?

পাস্তেরনাক আধুনিকতাবাদী ধারার সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান এবং মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

৭. পাস্তেরনাকের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছিল?

হ্যাঁ, মৃত্যুর পর তাঁর কাজগুলো রাশিয়া ও বিশ্বজুড়ে নতুন করে স্বীকৃতি পায়। “ডক্টর জিভাগো” রাশিয়ায় প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।

Leave a Comment