ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্ক প্রসঙ্গে সুরাটের সন্ধি, পুরন্দরের সন্ধি, প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ, সলবাইয়ের সন্ধি, বেসিনের সন্ধি, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ, পুণার সন্ধি ও তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্ক
ঐতিহাসিক ঘটনা | ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্ক |
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ | ১৭৭৫-৮২ খ্রি: |
সলবাইয়ের সন্ধি | ১৭৮২ খ্রি: |
বেসিনের সন্ধি | ১৮০২ খ্রি: |
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ | ১৮০৩-০৫ খ্রি: |
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ | ১৮১৭-১৮ খ্রি: |
ভূমিকা :- ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ-এ মারাঠারা পরাজিত হলেও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় নি। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা উত্তর ভারতে পুনরায় নিজেদের শক্তিশালী করে তোলে। পেশোয়া বালাজি বাজিরাও-এর মৃত্যুর পর পেশোয়া হন তাঁর সুযোগ্য পুত্র প্রথম মাধব রাও। তাঁর নেতৃত্বে মারাঠারা পুনরায় সংগঠিত হয় ও শক্তি সঞ্চয় করে।
পেশোয়া নারায়ণ রাও
প্রথম মাধব রাও-এর মৃত্যুর পর পেশোয়া হন তাঁর পুত্র নারায়ণ রাও। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি নিজের পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-এর ষড়যন্ত্রে নিহত হন।
পেশোয়া রঘুনাথ রাও
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রঘুনাথ রাও নিজে পেশোয়া পদ দখল করেন। রঘুনাথ রাও ছিলেন নীতিজ্ঞানহীন ও স্বার্থপর।
পেশোয়া দ্বিতীয় মাধরাও
এই সময় নানা ফড়নবিশ নামে জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির নেতৃত্বে মারাঠা নায়করা রঘুনাথ রাও-এর পরিবর্তে নারায়ণ রাও-এর শিশুপুত্র মাধবরাও নারায়ণকে ‘পেশোয়া’ বলে ঘোষণা করেন। তিনি ‘দ্বিতীয় মাধব রাও’ নামে পরিচিত হন।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে সুরাটের সন্ধি
পদলোভী রঘুনাথ পেশোয়া পদ দখলের জন্য বোম্বাই-এর ইংরেজ সরকারের সাহায্যপ্রার্থী হন। তিনি ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই-এর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সাথে সুরাটের সন্ধি স্বাক্ষর করেন।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে সুরাটের সন্ধির শর্ত
সুরাটের সন্ধি অনুযায়ী স্থির হয় যে,
- (১) ইংরেজ সাহায্য নিয়ে রঘুনাথ রাও ‘পেশোয়া’-র গদিতে বসবেন।
- (২) ইংরেজরা রঘুনাথ রাও-কে আড়াই হাজার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে এবং তার যাবতীয় ব্যয় রঘুনাথ রাও-ই বহন করবেন।
- (৩) ইংরেজদের সাহায্যের বিনিময়ে রঘুনাথ রাও তাদের সুরাট ও ব্রোচ জেলাদ্বয়ের রাজস্বের একাংশ এবং সলসেট ও বেসিন ছেড়ে দেবেন।
- (৪) ইংরেজদের বিনা অনুমতিতে তিনি কোনও ইংরেজ-বিরোধী শক্তির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন না।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে পুরন্দরের সন্ধি
কলকাতার ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সুরাটের সন্ধিকে বাতিল ঘোষণা করে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মারাঠা সরকারের সাথে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ইংল্যান্ড-এ কোম্পানির পরিচালকসভা পুরন্দরের সন্ধিকে নাকচ করে সুরাটের সন্ধিকে সমর্থন করে।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে পুরন্দরের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্তানুসারে,
- (১) সুরাটের সন্ধি বাতিল বলে গণ্য হয়।
- (২) ইংরেজরা রঘুনাথ রাওয়ের পক্ষ ত্যাগ করে এবং দ্বিতীয় মাধব রাও-কে ‘পেশোয়া’ বলে মেনে নেয়।
- (৩) স্থির হয় যে, রঘুনাথ রাও গুজরাটের কোপারগাঁও-এ বাস করবেন এবং তিনি বছরে তিন লক্ষ টাকা বৃত্তি পাবেন।।
- (৪) সলসেট ও থানা ইংরেজরা পাবে এবং
- (৫) যুদ্ধের ব্যর হিসেবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ১২ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
এরপর বোম্বাই ও বাংলার ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মিলিতভাবে পুনার মারাঠা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এইভাবে শুরু হয় ‘প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ’ (১৭৭৫-৮২ খ্রিঃ)।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে সলবাই-এর সন্ধি
শেষ পর্যন্ত ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে মহাদজি সিন্ধিয়ার মধ্যস্থতায় মারাঠা ও ইংরেজের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সলবাইয়ের সন্ধি।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে সলবাই-এর সন্ধির শর্ত
সলবাই-এর সন্ধির শর্ত অনুসারে –
- (১) ইংরেজরা সলসেট ও ব্রোচ লাভ করে। বেসিন মারাঠাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- (২) দ্বিতীয় মাধবরাও পেশোয়া হিসেবে স্বীকৃতি পান। রঘুনাথ রাওকে বার্ষিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়।
- (৩) উভয় পক্ষ যাতে সন্ধির শর্তাবলি মান্য করে, তা দেখার দায়িত্ব পান মহাদজি সিন্ধিয়া।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে সলবাই-এর সন্ধির গুরুত্ব
সাধারণভাবে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ এবং সলবাই-এর সন্ধি ছিল গুরুত্বহীন। কিন্তু এই যুদ্ধের পরোক্ষ ফল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- (১) সলবাই -এর সন্ধির ফলে পরবর্তী কুড়ি বছর ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয় নি।
- (২) এই সুযোগে ইংরেজরা ভারতের অন্যান্য শক্তি যেমন হায়দ্রাবাদের নিজাম, অযোধ্যার নবাব, মহীশূরের টিপু সুলতান প্রমুখকে পরাজিত করে সারা ভারত-এ নিজেদের কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে।
সলবাই-এর সন্ধি সম্পর্কে লুয়ার্ড-এর মন্তব্য
কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক লুয়ার্ড-এর মতে, “সলবাই-এর সন্ধি নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হিসেবে ইংরেজদের উত্থান ঘটিয়েছিল।”
সলবাই-এর সন্ধি সম্পর্কে ডাফ-এর মন্তব্য
ঐতিহাসিক গ্রান্ট ডাফ সলবাই-এর চুক্তিকে ইংরেজের কূটনৈতিক জয় বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
পেশোয়ার কর্তৃত্ব সংকটাপন্ন
পরবর্তী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ছিলেন ব্যক্তিত্বহীন। ফলে সিন্ধিয়া, হোলকার প্রমুখ মারাঠা সর্দার ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত হলে পেশোয়ার কর্তৃত্ব সংকটাপন্ন হয়।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে বেসিনের সন্ধি
এই সময় গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন লর্ড ওয়েলেসলি। মারাঠাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে তিনি পেশোয়াকে ‘বেসিনের সন্ধি‘ (১৮০২ খ্রিঃ) দ্বারা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির চুক্তিতে আবদ্ধ করেন।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে বেসিনের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির দ্বারা
- (১) পেশোয়া ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হন।
- (২) পেশোয়াকে রক্ষার জন্য পুণায় ৬ হাজার ইংরেজ সৈন্য রাখার ব্যবস্থা হয়।
- (৩) ইংরেজ সেনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি নিজ রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেন।
- (৪) পেশোয়া কোম্পানিকে বেসিন, সুরাট এবং তাপ্তি ও নর্মদার মধ্যবর্তী অঞ্চল ও আরও কিছু স্থান ছেড়ে দেন।
- (৫) কোম্পানির বিনা অনুমতিতে অপর কোনও শক্তির সঙ্গে মিত্রতা না করার অঙ্গীকার করেন।
- (৬) কোম্পানির অনুমতি ভিন্ন সেনাদলে কোনও ইউরোপীয়কে নিয়োগ না করার অঙ্গীকার করেন এবং
- (৭) নিজাম, গায়কোয়াড় প্রভৃতি শক্তির সঙ্গে বিরোধ বাধলে তিনি ইংরেজদের মধ্যস্থতা মেনে নিতে সম্মত হন।
বেসিনের চুক্তি সম্পর্কে এডোয়ার্ডস-এর মন্তব্য
ঐতিহাসিক এডোয়ার্ডস-এর মতে, বেসিনের সন্ধির ফলে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ‘ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে’ পরিণত হয়।
মারাঠা নেতাদের বেসিনের সন্ধি অস্বীকার
পেশোয়া আইনত মারাঠা রাষ্ট্রসংঘের প্রধান হলেও, কার্যত মারাঠা সর্দারদের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই সিন্ধিয়া, ভোঁসলে প্রমুখ মারাঠা নেতা অপমানকর বেসিনের চুক্তি মানতে অস্বীকার করেন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
কিছুদিনের মধ্যে পেশোয়া স্বয়ং নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্রিটিশ বিরোধী গোপন কার্যকলাপে লিপ্ত হন। তাঁর প্ররোচনায় মারাঠা নায়েকরা একযোগে ইংরেজের রাজ্য আক্রমণ করেন। শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-১৮০৫ খ্রিঃ)।
ব্রিটিশ বাহিনীর জয়লাভ
দুর্ভাগ্যক্রমে জাতির এই সংকট মুহূর্তেও সমস্ত মারাঠানেতা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন নি। ফলে ব্রিটিশবাহিনী বিজয়ী হয়।
ভোঁসলে ও সিন্ধিয়ার পশ্চাৎ প্রসরন
ভোঁসলে ইংরেজের সঙ্গে ‘দেওগাঁও’-এর সন্ধি স্বাক্ষর করে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ান। সিন্ধিয়া ‘অর্জুনগাঁও’-এর সন্ধি (১৮০৩ খ্রিঃ) দ্বারা ইংরেজের সাথে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হন। গঙ্গা-যমুনার দোয়াব তিনি ইংরেজের হাতে ছেড়ে দেন।
লর্ড লেক এর দিল্লী আগমন
এই সময় লর্ড লেক দিল্লিতে এসে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকেও ইংরেজের কর্তৃত্ব মানতে বাধ্য করেন।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে ইংরেজ বিরোধী জোট গঠন
মারাঠাদের পক্ষে ইংরেজের অধীনতা দীর্ঘদিন সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই পেশোয়ার নেতৃত্বে তারা আবার ইংরেজ-বিরোধী জোট গঠন করে।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে পুণার সন্ধি
নতুন গভর্নর-জেনারেল লর্ড হেস্টিংস ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাজীরাও কে আরো কঠোর শর্তে পুনার সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এই সন্ধির অপমান দ্বিতীয় বাজীরাওকে দগ্ধ করে।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে পুণার সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্ত অনুসারে,
- (১) পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও মারাঠা সাম্রাজ্যের নেতৃপদ ত্যাগ করেন।
- (২) রাজ্যের একাংশ ইংরেজদের ছেড়ে দেন এবং
- (৩) ইংরেজদের বিনা অনুমতিতে কোনও বহিঃশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিরত হতে বাধ্য হন। বলা বাহুল্য, এই চুক্তি পেশোয়ার কাছে মৃত্যুশেলের সমান ছিল।
ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্কে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
অপমানে জর্জরিত দ্বিতীয় বাজীরাও আকস্মিক কির্কির ব্রিটিশ দূতাবাস আক্রমণ করলে তৃতীয় ইা-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮ খ্রিঃ) শুরু হয়।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের সমাপ্তি
পেশোয়ার সঙ্গে যোগ দেন হোলকার ও নাগপুরের আপ্পা সাহেব। কিন্তু কির্কি, অসতি ও কোরেগাঁও-এর যুদ্ধে পেশোয়া পরাস্ত হন। তিনি ইংরেজের কাছে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
উপসংহার :- ইংরেজ কোম্পানি পেশোয়ার রাজ্য পুরোপুরি দখল করে নেয় এবং পেশোয়া-পদ বিলোপ করা হয়। দ্বিতীয় বাজীরাওকে কানপুরের কাছে বিঠুরে নির্বাসিত করা হয়। তাঁকে বাৎসরিক ভাতা দানের ব্যবস্থা করা হয়। মারাঠা রাজ্যের প্রকৃত অধীশ্বর হয় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ।
(FAQ) ইঙ্গ-মারাঠা সম্পর্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৭৫-৮২ খ্রিস্টাব্দ।
সলবাই এর সন্ধি, ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮০৩-১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দে।