ফারুখসিয়রের ফরমান প্রসঙ্গে প্রেক্ষাপট, ফরমান জারি, ফরমানের বক্তব্য, কোম্পানির দিক থেকে ফলাফল, ভারতের দিক থেকে ফলাফল ও ফরমানের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
ফারুখসিয়রের ফরমান
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফারুখসিয়রের ফরমান |
সময়কাল | ১৭১৭ খ্রি: |
প্রদানকারী | সম্রাট ফারুখসিয়র |
প্রাপক | ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি |
চরম পরিণতি | পলাশির যুদ্ধ |
ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য দ্রুত প্রসারলাভ করে। এর মূলে ছিল ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফারুখসিয়র কর্তৃক কোম্পানিকে প্রদত্ত রাজকীয় সনদ।
ফারুখসিয়রের ফরমান প্রদানের প্রেক্ষাপট
মোগল বাদশাহ ফারুখসিয়র কর্তৃক ফরমান প্রদানের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –
(১) স্যার জন সুরমানের দৌত্য
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফারুখসিয়রের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। এই দলের নেতা ছিলেন স্যার জন সুরমান। এই দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল সম্রাটের কাছ থেকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা।
(২) ইংরেজদের প্রতি ফারুখসিয়রের কৃতজ্ঞতা
ঘটনাচক্রে সেই সময় ফারুখসিয়র রোগাক্রান্ত ছিলেন। ইংরেজ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ড. হ্যামিলটন। তিনি সম্রাটের ব্যাধির উপশম করতে সক্ষম হন। ফলে কৃতজ্ঞ সম্রাট ইংরেজের প্রতি সদয় হন।
ফারুখসিয়রের ফরমান জারি
ইংরেজদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত সম্রাট ফারুখসিয়র ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজকীয় সনদ জারি করে ইংরেজদের বাংলায় বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা দান করেন। এটি ফারুখসিয়রের ফরমান নামে পরিচিত।
ফারুখসিয়রের ফরমানের বক্তব্য
এই রাজকীয় সনদ বা ফরমান অনুযায়ী-
- (১) ইংরেজ বণিকরা বার্ষিক মাত্র ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য করার অধিকার পায়।
- (২) কলকাতার সন্নিহিত ৩৮টি গ্রাম সামান্য অর্থের বিনিময়ে কেনার অধিকার পায়।
- (৩) স্থির হয়, কোম্পানি তার মাদ্রাজি মুদ্রা বাট্টা ছাড়াই বাংলায় ব্যবহার করতে পারবে।
- (৪) কোম্পানির কাছে ঋণী কোনো ব্যক্তি পলায়নের চেষ্টা করলে তাকে ইংরেজ কুঠিয়ালের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
- (৫) কোম্পানির কুঠির প্রধান ‘দস্তক’ বা ছাড়পত্র প্রদান করবেন। মালবাহী জাহাজ এই দস্তক দেখালে নবাবের কোনো কর্মচারী ওই জাহাজ পরীক্ষা করবেন না।
- (৬) কোম্পানি মুর্শিদাবাদ-এর টাঁকশাল ব্যবহার করতে পারবে।
- (৭) সুরাটে কোম্পানি এককালীন দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করবে।
- (৮) হায়দ্রাবাদে বাণিজ্যের জন্য তাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না।
কোম্পানির দিক থেকে ফারুখসিয়ারের ফরমানের ফলাফল
ইতিহাসে ফারুখশিয়ারের ফরমান এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। যেমন –
(১) ইংরেজদের কূটনৈতিক সাফল্য
ঐতিহাসিক সি আর উইলসনের বলেছেন যে, এই ফরমান লাভ ছিল কোম্পানির একটি সত্যিকারের কূটনৈতিক সাফল্য। ফারুখশিয়ারের ফরমানের লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দস্তক লাভ বাংলায় বাণিজ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(২) বাণিজ্যিক অধিকারে আইনত স্বীকৃতি
ফারুখশিয়ারের ফরমান লাভের পরবর্তীতে ভারত-এ কোম্পানির বাণিজ্য আইনত স্বীকৃতি লাভ করে।
(৩) রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সুবিধা
ফারুখশিয়ারের ফরমান লাভ করার ফলে ভারতে ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। তাই ঐতিহাসিক ওমর ফারুখশিয়ারের ফরমানকে ‘মহাসনদ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
(৪) অতিরিক্ত সুযােগ সুবিধা ভােগ
কোম্পানি এখন থেকে বিশেষ কিছু অতিরিক্ত সুযােগসুবিধা ভােগ করতে শুরু করে। কোম্পানির প্রাপ্ত এই অতিরিক্ত সুযােগ সুবিধা গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইংরেজ বাণিজ্যকুঠির প্রধান তার মনােনীত বাণিজ্য প্রতিনিধিকে দস্তক বা বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অনুমতিপত্র প্রদান করবে, যা দেখালে নবারের কোনাে কর্মচারী ইংরেজদের কোনাে জাহাজ পরীক্ষা করবে না।
(৫) বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অগ্রগতি
দস্তকের ব্যবহারের সুযােগ নিয়ে ইংরেজ কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউরোপের অন্যান্য বণিক কোম্পানিগুলির তুলনায় অনেক এগিয়ে যায়। ইংরেজ কোম্পানির মতাে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করতে না পেরে দেশীয় বণিকগােষ্ঠী বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতায় পিছিয়ে পড়ে এবং তারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারতের দিক থেকেফা রুখসিয়ারের ফরমানের ফলাফল
ফারুখসিয়রের ফরমানের ফলে ভারতের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ফল লক্ষ্য করা যায় –
(১) রাজস্বক্ষতি
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুল্ক ছাড়ের সুযােগ নেয়। এর ফলে নবাব তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। আর এই কারণেই আদায়িকৃত রাজস্বের মােট পরিমাণ হ্রাস পায়।
(২) দেশীয় বাণিজ্যের ধ্বংসসাধন
স্বভাবতই বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকার না পাওয়ায় দেশীয় বণিকগােষ্ঠী বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতায় এমনিতেই পিছিয়ে পড়ে। তার ওপর আবার কোম্পানির কর্মচারীরাও ব্যক্তিগত বাণিজ্যে শুল্ক ছাড়ের সুযােগ নিতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রসার ঘটে ও দেশীয় বাণিজ্যের সর্বনাশ সাধিত হয়।
(৩) পলাশির যুদ্ধ
বাণিজ্যে এই ছাড়পত্র বা দস্তকের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে নবাব সিরাজ উদদৌলার আমলে নবাব ও কোম্পানির সম্পর্ক তিক্ততার চরমে পৌঁছােয়। আর এরই চরম পরিণতি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধ।
ফারুখসিয়রের ফরমানের গুরুত্ব
বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এই ফরমানের গুরুত্ব অপরিসীম। এর দ্বারা কোম্পানি আগে থেকে যেসব সুযোগসুবিধা ভোগ করছিল সেগুলি অনুমোদন পায়। সেই সঙ্গে আরো নতুন কিছু সুযোগসুবিধা কোম্পানি লাভ করে।
ফারুখসিয়রের ফরমানের ফরমান সম্পর্কে সুকুমার ভট্টাচার্যের মন্তব্য
ড. সুকুমার ভট্টাচার্য ফারুকশিয়ারের ফরমানকে বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের ‘ম্যাগনা কাটা’ (Magna Carta) বলে উল্লেখ করেছেন।
ফারুখসিয়রের ফরমানের ফরমান সম্পর্কে উইলসনের মন্তব্য
সি.আর উইলসন-এর মতে, এই ফরমান ছিল ইংরেজের কূটনৈতিক জয়ের প্রতীক।
উপসংহার :- বস্তুত ফারুখসিয়রের ফরমানের লাভের ফলে কোম্পানির বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও ভারতীয় বণিকদের তুলনায় তারা অনেক বেশি ‘সুবিধাভোগী’ শ্রেণিতে পরিণত হয়। তাদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি দ্রুত বাড়তে থাকে।
(FAQ) ফারুখসিয়রের ফরমান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়র।
১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে।
স্যার জন সুরমান।
ডঃ হ্যামিল্টন।