পেশোয়া প্রথম মাধবরাও

পেশোয়া প্রথম মাধবরাও প্রসঙ্গে রণদক্ষতার পরিচয়, গৌরব মর্যাদা পুনরুদ্ধার, সুযোগ্য নেতৃত্ব, পূর্ব গৌরব প্রতিষ্ঠার কাজ, পেশোয়া পদ অক্ষুন্ন রাখা, নিজামকে পরাজিত, হায়দার আলীকে পরাজিত, মারাঠা সাম্রাজ্যে অমানিশা, গুণাবলী, চারিত্রিক ত্রুটি ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

পেশোয়া প্রথম মাধবরাও

পেশোয়াপ্রথম মাধব রাও
সময়কাল১৭৬১-১৭৭২ খ্রি
পূর্বসূরিবালাজি বাজীরাও
উত্তরসূরিনারায়ণ রাও
মৃত্যু১৭৭২ খ্রি
পেশোয়া প্রথম মাধবরাও

ভূমিকা :- পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের চরম বিয়োগান্ত পরিণতির হতাশায় বালাজি বাজিরাও-এর মৃত্যু হলে তাঁর সুযোগ্য দ্বিতীয় পুত্র প্রথম মাধব রাও ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া পদে অভিষিক্ত হন।

রণদক্ষতার পরিচয়

তিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে পেশোয়া পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন কিন্তু এই অল্পবয়সেই তিনি যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, কুটনীতি ও রণদক্ষতার পরিচয় দেন তাতে তাঁর পিতা ও পিতামহের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

গৌরব ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার

তাঁর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে কিছুকালের জন্য পুনরায় মারাঠাদের গৌরব ও মর্যাদা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মাত্র কয়েকবছরের শাসন দক্ষতায় মারাঠাদের গৌরব ও মর্যাদা তিনি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সুযোগ্য নেতৃত্ব

মারাঠাদের এই সময়কালে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা তিনি তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা মোকাবিলা করেন এবং ইতিহাসে চূড়ান্ত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাই গ্রান্ট-ডাফ লিখেছেন, “এই সুদক্ষ রাজার অকালমৃত্যু মারাঠা সাম্রাজ্যের স্বার্থের দিক থেকে পানিপথের পরাজয় অপেক্ষা আরও মারাত্মক হয়েছিল। “

পূর্ব গৌরব প্রতিষ্ঠার কাজ

প্রথম মাধব রাও পেশোয়া পদে অভিষিক্ত হলে তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-এর সহযোগিতায় মারাঠাদের পূর্ব গৌরব প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

পেশোয়া পদ অক্ষুন্ন রাখা

তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও প্রথম মাধব রাও-কে পেশোয়া পদ থেকে সরিয়ে স্বয়ং পেশোয়া পদ দখলের জন্য হায়দ্রাবাদের নিজাম ও হায়দার আলির সঙ্গে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে মারাঠা সাম্রাজ্যে নিজ কর্তৃত্ব অটুট রাখতে এবং পেশোয়া পদ অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনি সমর্থ হন।

নিজামকে পরাজিত

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া মাধব রাও রাক্ষসভুবনের যুদ্ধে নিজামকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন। যদিও পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-এর ষড়যন্ত্রে নিজাম পুনরায় এক উদার শর্তে সন্ধি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও রাক্ষসভুবনের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে নিজাম মারাঠা সাম্রাজ্য আক্রমণের প্রচেষ্টা ত্যাগ করেন।

হায়দার আলীকে পরাজিত

  • (১) মহীশূরের হায়দার আলি তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের শোচনীয় পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে মারাঠা রাজ্যের কয়েকটি সীমান্ত অঞ্চল দখল করেন এবং তুঙ্গভদ্রা-দোয়াব অঞ্চলে মারাঠা আধিপত্য বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেন।
  • (২) ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া মাধব রাও হায়দার আলিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। দ্বিতীয়বার রঘুনাথ রাও-এর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে হায়দার আলিকে পুনরায় যুদ্ধে পরাজিত করেন।
  • (৩) পেশোয়া মাধব রাও তৃতীয়বার ১৭৬৯-৭২ খ্রিস্টাব্দে রঘুনাথ রাও-এর পরিবর্তে ত্রিম্বকরাও-এর নেতৃত্বে শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে হায়দারকে পরাজিত করে তাঁর ক্ষমতা বিনষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া প্রথম মাধব রাও-এর অকালমৃত্যু ঘটায় মারাঠাদের উদ্যোগে ভাটা পড়ে।

মারাঠাদের গৃহযুদ্ধ

  • (১) মাধব রাও-এর মৃত্যুর পর মারাঠাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। মাধব রাও-এর পর পেশোয়া হন তাঁর ভাই নারায়ণ রাও। কিন্তু তাঁর ক্ষমতালোভী পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-এর চক্রান্তে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন।
  • (২) রঘুনাথ রাও পেশোয়া হন কিন্তু তাঁর পেশোয়া পদলাভে মারাঠা নায়কগণ অসন্তুষ্ট হন। ইতিমধ্যে নারায়ণ রাও-এর বিধবা পত্নী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলে মারাঠা সর্দারগণ এই সদ্যোজাত শিশুকে পেশোয়া নারায়ণ রাও-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন।
  • (৩) নাবালক পেশোয়ার অভিভাবক হন নানা ফড়নিশ নামক একজন কূটনীতিক ব্রাহ্মণ। রঘুনাথ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বোম্বাইয়ে ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। এরপর পুনা দরবারে উত্তরাধিকারের যুদ্ধ ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
  • (৪) এখানে উল্লেখ্য পেশোয়া মাধব রাও মারাঠাদের পূর্ব গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা মারাঠা সেনানায়কদের ঐক্যবদ্ধতার অভাবে বিনষ্ট হয়। রঘুনাথ নিজ স্বার্থে পরিচালিত হয়ে সামগ্রিকভাবে মারাঠা সাম্রাজ্যের স্বার্থকে বিপন্ন করেন।

মারাঠা সাম্রাজ্যে অমানিশা

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া মাধব রাও-এর অকালমৃত্যুতে মারাঠা সাম্রাজ্যে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসে।

গুণাবলী

  • (১) সকল ঐতিহাসিকই পেশোয়া মাধব রাও-এর গুণাবলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি অসাধারণ বুদ্ধি, কৌশল ও সামরিক দক্ষতার দ্বারা মৃতপ্রায় মারাঠা সাম্রাজ্যকে এক নতুন জীবন দান করেন।
  • (২) তিনি নর্মদা নদী অতিক্রম করে মালব ও বুন্দেলখণ্ডের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। জাঠ ও বুন্দেলাদের দমন করেন এবং রাজপুতদের চৌথ দিতে বাধ্য করেন। এরপর তিনি পুনরায় দিল্লি দখল করেন।
  • (৩) দিল্লির সম্রাট শাহ আলমকে নিজ নিয়ন্ত্রণে এনে দিল্লিতে আধিপত্য রক্ষা করার চেষ্টা করেন। মারাঠা বাহিনী শাহ আলমকে পুনরায় এলাহাবাদ থেকে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনে। দিল্লিতে শাহ আলমের উপর মারাঠাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে আপাতত ব্রিটিশ কূটনৈতিক চক্রান্ত কিছুকালের জন্য ব্যর্থ হয়।
  • (৪) অবশ্য প্রথম মাধব রাও-এর অকালমৃত্যুর ফলে উত্তর ভারতে মারাঠাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার তিনি অবকাশ পান নি। তবে তাঁর পথ ধরেই দিল্লিতে মারাঠাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন মহাদজি সিন্ধিয়া।
  • (৫) এর ফলে মারাঠাদের পুনরায় সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তাই মারাঠা ঐতিহাসিক সরদেশাই বলেছেন যে, “পানিপথের বিপর্যয়ে সদাশিব রাও যা হারিয়েছিলেন মারাঠারা তা পুনরুদ্ধার করেন”।

অকাল মৃত্যু

প্রকৃতপক্ষে পেশোয়া প্রথম মাধব রাও জীবিত থাকলে মারাঠারা পুনরায় ভারতীয় সাম্রাজ্য গঠন করতে পারত কিন্তু মাধব রাও-এর অকালমৃত্যু মারাঠাদের সে আশা পূর্ণ করতে দেয় নি এবং মাধব রাও-এর পর মারাঠাদের মধ্যে সেরকম সুযোগ্য নেতৃত্বের আবির্ভাবের অভাবে মারাঠাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা চিরতরে বিলুপ্ত হয়।

চারিত্রিক ত্রুটি

  • (১) সমকালীন সকল ঐতিহাসিকই মাধব রাও-এর গুণাবলির প্রশংসা করলেও তাঁর কতকগুলি চারিত্রিক ত্রুটির কথা উল্লেখ করা যায়। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের সময় মারাঠা সাম্রাজ্য যে মর্যাদা ও গৌরবের স্থান অধিকার করেছিল সেই মর্যাদা ও গৌরবের স্থানে পেশোয়া মাধব রাও মারাঠা সাম্রাজ্যকে পৌঁছে দিতে পারেন নি।
  • (২) এমনকি তিনি তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-কে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি। এমনকি তিনি উত্তরেও তাঁর আধিপত্য স্থায়ী করতে পারেন নি এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিতকে শক্ত করার জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কারও করতে পারেন নি।

রাজনৈতিক মর্যাদা আনয়ন

একথা স্বীকার করতে হবে যে তিনি মাত্র এগারো বছর পেশোয়া পদে থেকে যেটুকু সময় ও সুযোগ পেয়েছিলেন তার পূর্ণ সদ্‌ব্যবহার করে মারাঠা সাম্রাজ্যকে পানিপথের বিপর্যয়ের পর অভাবনীয় এক রাজনৈতিক মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন।

মৃত্যু

অল্পকালের মধ্যেই ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মারাঠাদের শেষ গৌরব-রবি অস্তমিত হয়।

উপসংহার :- এইসব দিক পর্যালোচনা করে গ্ৰান্ট ডাফ যথার্থই বলেছেন যে মাধব রাও-এর অকালমৃত্যু মারাঠাদের কাছে পানিপথের বিপর্যয়ের চেয়ে আরও বেশি দুর্ভাগ্যজনক ছিল।

(FAQ) পেশোয়া প্রথম মাধবরাও সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় মারাঠা পেশোয়া কে ছিলেন?

বালাজি বাজিরাও।

২. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর কে পেশোয়া হন?

প্রথম মাধবরাও।

৩. কোন পেশোয়া নিজাম ও হায়দার আলীকে পরাজিত করেন?

পেশোয়া প্রথম মাধবরাও।

৪. পেশোয়া প্রথম মাধবরাও এর সময়কাল কত?

১৭৬১-১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment