আকবরের সাহিত্য অনুরাগ

মুঘল সম্রাট আকবরের সাহিত্য অনুরাগ প্রসঙ্গে আধুনিক ইতিহাস চর্চার যুগ, ইতিহাস গ্রন্থ, আইন-ই-আকবরী, কাব্যগ্রন্থ, বদায়ুনির ভূমিকা, মৌলিক গ্রন্থ, ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাস রচনা, হিন্দি কবিতা সাহিত্য ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের সাহিত্য অনুরাগ

বিষয়আকবরের সাহিত্যানুরাগ
আবুল ফজলআকবরনামা
কলহনরাজতরঙ্গিনী
আব্বাস সেরওয়ানিতারিখ-ই-শেরশাহী
আগ্ৰার চারণ কবিসুরদাস
মুঘল সম্রাট আকবরের সাহিত্য অনুরাগ

ভূমিকা :- আকবর-এর রাজত্বকালকে ভারতীয় সাহিত্য-ইতিহাসের সুবর্ণযুগ বলা যেতে পারে। আকবরের রাজত্বকালে নবজাগরণ-এর সূচনা হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না।

আকবরের পৃষ্ঠপোষকতা

মুঘল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের মানসিক ও বৌদ্ধিক সংস্কৃতি চরম বিকাশলাভ করে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস-সাহিত্য ও শিল্পকলা সমৃদ্ধির উচ্চস্তরে উন্নীত হয়। আকবর ফারসি ও হিন্দি উভয় ভাষার প্রতি সমান অনুরাগ দেখিয়েছিলেন। তাঁর সময় সংস্কৃতও অবহেলিত ছিল না।

আকবরের রাজত্বকাল আধুনিক ইতিহাসচর্চার যুগ

আধুনিক ইতিহাস চর্চার যুগ তার আমলেই শুরু হয়। তাঁর সময়ের ঐতিহাসিক উপাদানের অভাব নেই। প্রত্যেকটি ঘটনার আনুপূর্বিক ধারাবাহিক সাল-তারিখ সহ বিবরণ পাওয়া যায়।

আকবরের রাজত্বকালে রচিত ইতিহাস গ্ৰন্থ

(১) তাঁর রাজত্বকালে ফারসি ভাষায় রচিত ইতিহাস গ্রন্থ হল মুন্না দাউদের তারিখ-ই-আলফী, মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী ও আকবরনামা, বদাউনির মুন্তাখাব-উৎ-তওয়ারিখ বা তারিখ-ই-বদায়ুনী। আকবর সম্পর্কে বদায়ুনির দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট সমালোচনামূলক।

(২) খাজা নিজামউদ্দিন আহম্মদ-এর তবকাত-ই-আকবরী গ্রন্থটি তিনখণ্ডে রচিত। ইনায়াতুল্লার তকবীল-ই-আকবরনামা এবং আবদুল হকের তারিখ-ই-হকী আকবরের রাজ্যকাল অবলম্বনে রচিত।

(৩) ফৈজি সিরহিন্দির হুমায়ুনশাহী ও আকবরনামা প্রকৃত তথ্যমূলক ইতিহাস। আবদুল বাকির মসির-ই-রহিমী গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু ফারসি গ্রন্থ আছে, যেগুলির পরিচয় পূর্বে দেওয়া হয়েছে।

আকবরের আমলে রচিত আইন-ই-আকবরী

ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লিখিত আইন-ই-আকবরী শুধু আকবরের রাজত্বকালের নয়, সমগ্র মধ্যযুগের একটি বিশদ তাৎপর্যপূর্ণ জ্ঞানকোষ বিশেষ। ব্লকম্যান আইন-ই-আকবরীকে উৎকর্ষের দিক দিয়ে ফারসি ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক রচনাগুলির মধ্যে অদ্বিতীয় বলে ঘোষণা করেছেন।

বাদশাহ আকবরের আমলে রচিত কাব্যগ্ৰন্থ

  • (১) কাব্যগ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে খিলজি, ফৈজি, মহম্মদ হোসেন নাজির প্রমুখের নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। খিলজি সুফি ভাবাপন্ন এবং ফৈজির মতো আকবরের অন্যতম সভাসদ ছিলেন। তিনি মিরাৎ-উল-কাইনাৎ, নাকসি-ই-বাদিদ, ইসার-ই-মকতুব প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
  • (২) ফৈজি আরবি ভাষায় অত্যন্ত ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে মসনবী-নল-ও-দমন, খরকাজ-ই আদওয়ার মাওয়ারিদ-উল-কলা ও সওয়াতী-উল-ইলহাম-এর নাম করা যেতে পারে।
  • (৩) মহম্মদ হোসেন নাজির গজল রচনার জন্য খ্যাত ছিলেন। আকবরের আদেশে বহু সংস্কৃত কাব্য ফারসি ভাষায় অনুদিত হয়। বদায়ুনি বাল্মীকির রামায়ণ ও অংশত মহাভারত এবং হাজি ইব্রাহিম সিরহিন্দি অথর্ব বেদ ও ফৈজি লীলাবতী ফারসিতে অনুবাদ করেন।
  • (৪) আইন-ই-আকবরী থেকে আমরা জানতে পারি ঊনষাট জন বিখ্যাত পারস্যের কবি আকবরের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। কাশ্মীরের ইতিহাস গ্রন্থ কলহনের রাজতরঙ্গিণী ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন মুল্লা শাহ মহম্মদ।
  • (৫) হরিবংশ পুরাণ অনুবাদ করেন মৌলানা শেরি। আবুল ফজল স্বয়ং অনুবাদ করেন পঞ্চতন্ত্র। এছাড়া ফৈজি ফারসিতে অনুবাদ করেন নল-দময়ন্তী। সংস্কৃত সাহিত্য যে ফারসি ভাষার মতো উচ্চস্তরের ভাষা এবং একটা জাতির সম্পদ, তাও মহামতি আকবর উপলব্ধি করতে ভুল করেন নি।

আকবরের রাজত্বকালে ঐতিহাসিক বদাউনির ভূমিকা

  • (১) একটা বিষয় উল্লেখ্য, বদায়ুনি সর্বত্র আকবরের বিরুদ্ধ-মৌলবাদী ঐতিহাসিক হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্য এই বদায়ুনিই মহাভারত’ ও ‘রামায়ণ’ ফারসিতে অনুবাদ করেছিলেন। ‘মহাভারত’ ও ‘রামায়ণ’ যে মহাকাব্য, একথা বদায়ুনি মনে হয় সেই যুগেও তাঁর পাণ্ডিত্যের দ্বারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
  • (২) তাই বদায়ুনি সম্পর্কে আমাদের নতুন করে গবেষণার প্রয়োজন আছে। সংস্কৃত ভাষাও তিনি মাতৃভাষার মতো শিখেছিলেন। ফৈজি, আবুল ফজল, বদায়ুনি প্রত্যেকেই সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।

আকবরের আমলে মৌলিক রচনা

  • (১) ফারসি ভাষায় মৌলিক রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সাহিত্যই আকবরের রাজত্বকালে প্রথম স্থান দখল করে আছে। আকবর ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে ভারতবর্ষ-এ আধুনিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।
  • (২) তাঁর রাজত্বকালে মৌলিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ফারসিতে রচিত হয়। আকবরই গুলবদন বেগমকে হুমায়ুননামা লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
  • (৩) আকবর যে কতটা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পূজারি ছিলেন, তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল – বাবরের তুজুক-ই-বাবরী গ্রন্থটি বৈরাম-পুত্র ‘খান-ই-খানান’ আবদুর রহিমকে দিয়ে ফারসিতে অনুবাদ করা।
  • (৪) জৌহর রচিত তাজ-কিরাৎ-উল-ওয়াকিয়াং এবং আব্বাস সেরওয়ানি রচিত তারিখ-ই-শেরশাহী গ্রন্থ তাঁরই প্রচেষ্টায় লেখা হয়েছিল।

আকবর কর্তৃক ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাস রচনার নির্দেশ

প্রকৃতপক্ষে আকবর ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাস রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং নাকিব খান, মুন্না মহম্মদ ও জাফর বেগকে এরকম একটি গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য নিয়োগ করেন। বইটি আবুল ফজলের ভূমিকাসহ যথাসময়ে প্রকাশিত হয় এবং এই বইটি তারিখ-ই-আলফী নামে পরিচিত হয়।

আকবরের আমলে হিন্দি কবিতা সাহিত্য

  • (১) আকবরের রাজত্বকালকে হিন্দি-কবিতা-সাহিত্যেরও স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। তাঁর গৌরবময় রাজত্বকালের সময় তিনি হিন্দুদের শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, এই অভিযোগ যে যথার্থ নয়, তা তাঁর সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষার প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ দেখেই বোঝা যায়।
  • (২) তাঁর রাজত্বকালে এমন কিছু বিখ্যাত কবি হিন্দি ভাষায় কবিতা ও কাব্য রচনা করেন, যেগুলি আজও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে পরিণত। হিন্দি কবিদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন তুলসীদাস, সুরদাস, আবদুর রহিম খান-ই-খানান’, রামদাস ও বীরবল।
  • (৩) প্রতিভার দিক দিয়ে হিন্দি সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তুলসীদাস। তিনি পঁচিশটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চস্তরের কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় কাব্যের ক্ষেত্রে তুলসীদাসের মহৎ অবদান অতুলনীয় ও অবিস্মরণীয়।
  • (৪) রামচন্দ্রের জীবন নিয়ে সাতখণ্ডে লেখা রামচরিতমানস গ্রন্থটি ভারতবর্ষের এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। গ্রন্থটি ‘রামায়ণ’ নামেই বিশেষ পরিচিত।
  • (৫) সুরদাসের লেখা সুরসাগর এক অনবদ্য রচনা। অনেকে সুরদাসকে তুলসীদাসের থেকেও মহান লেখক বলে মনে করেন। তিনি আকবরের রাজসভায় ছিলেন। তাঁর পিতা রামদাস, তিনিও আকবরের সভাকবি ছিলেন। সুরদাস আগ্রার অন্ধ চারণ কবি নামে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে হিন্দি-কবিতার অভাবনীয় উন্নতি ঘটে।

আকবরের আমলের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য

এই যুগের সাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র রাজসভার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। এই সাহিত্যচর্চা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বহু কবি দেশের বিভিন্ন স্থানীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য রচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন।

উপসংহার :- এই সব দিক বিবেচনা করেই মিত্র বন্ধু বিনোদ ও রামচন্দ্র শুক্লা হিন্দী সাহিত্যকা-ইতিহাস গ্রন্থে আকবরের হিন্দি সাহিত্যচর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং এই যুগকে হিন্দি-কবিতা ও কাব্য রচনার ক্ষেত্রে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের সাহিত্য অনুরাগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরনামা গ্ৰন্থের রচয়িতা কে?

আবুল ফজল।

২. আগ্ৰার অন্ধ চারণ কবি নামে জনপ্রিয় কে ছিলেন?

সুরদাস।

৩. রামচরিত মানস কাব্যের রচয়িতা কে?

তুলসীদাস।

৪. হুমায়ুন নামা গ্ৰন্থের রচয়িতা কে?

গুলবদন বেগম।

Leave a Comment