বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য রম্যরচয়িতা এবং ঔপন্যাসিক হলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭–১৯১৯)। তিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ব্যঙ্গ রচনার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে ডমরু-চরিত এবং কঙ্কাবতী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ত্রৈলোক্যনাথের রচনায় সমাজের অসঙ্গতি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি ব্রিটিশ ভারতের একটি পরিবর্তনশীল সমাজের প্রেক্ষাপটে হাস্যরসের মাধ্যমে মানবজীবনের গভীর সত্যকে তুলে ধরেছিলেন।
সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় |
জন্ম | ২২ জুলাই, ১৮৪৭ খ্রি |
জন্মস্থান | ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | সাহিত্যিক, ব্যঙ্গকার, ঔপন্যাসিক |
প্রধান রচনা | ডমরু চরিত, কঙ্কাবতী |
সাহিত্য ধারা | রম্যরচনা, ব্যঙ্গসাহিত্য |
বিশেষ উপাধি | আধুনিক বাংলা ব্যঙ্গ রচনার পথিকৃৎ |
মৃত্যু | ১৯১৯ খ্রি |
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
ভূমিকা :- ত্রৈলোক্যনাথের লেখক পরিচয়টুকুই সাধারণের কাছে পরিচিত। সকলে জানে তিনি ব্যঙ্গ ও কৌতুক রচনায় সিদ্ধহস্ত। কিন্তু কেবল এটুকুতেই তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। তাঁর আদর্শ জীবন-সাধনা, চরিত্র-পরিচয় যে কোন কর্মোদ্যোগী পুরুষের প্রেরণাস্থল। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে কঠিন বাস্তবের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে তিনি উন্নতির শীর্ষ অবস্থানে স্থাপন করেছিলেন। পিচ্ছিল চলার পথের বাধার ভ্রূকুটি তাঁকে কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারে নি। সকল অবস্থায় অচল অটল থেকে গভীর অধ্যবসায় ও একনিষ্ঠতা বলে তিনি নক্ষত্র-উজ্জ্বল এক গরিমাময় জীবন লাভ করেছিলেন। সত্যনিষ্ঠা ও একান্ত কর্মোদ্যোগ যে কখনও বিফল হয় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ত্রৈলোক্যনাথের জীবন।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম
বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার শ্যামনগরের কাছে রাহুতা গ্রামে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে জুলাই এক দরিদ্র পরিবারে ত্রৈলোক্যনাথের জন্ম। তাঁর পিতার নাম বিশ্বম্বর মুখোপাধ্যায়। মাতা ভবসুন্দরী দেবী।
সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাল্যকাল
ছয় ভাইয়ের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন সকলের বড়। বিশ্বম্বরের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। কায়ক্লেশে সংসারযাত্রা নির্বাহ হত। এই পরিবারে তাই বাল্যবয়স থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্যক পরিচয় ঘটে তাঁর। তখন থেকেই তাঁর মধ্যে সংগ্রামী মনোভাব জন্ম নেয়। উত্তরকালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবনসংগ্রামের এক দুর্বার সৈনিক।
লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষা
স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। লেখাপড়ার সময় মনোযোগের ঘাটতি হত না। ছিল প্রখর বুদ্ধি ও সাহস। একবার যা পড়তেন তা কখনও ভুলতেন না। করবেন বলে স্থির করলে সে কাজে কোনও অবস্থাতেই পিছপা হতেন না। গ্রামের পাঠশালাতেই পড়াশুনা শুরু হয়েছিল তাঁর। তারপর চুচুড়ায় ডাফ সাহেবের স্কুলে ও পরে তেলেনিপাড়া স্কুলে শিক্ষা প্রাপ্ত হন। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত টানা পড়াশুনার মধ্যেই ছিলেন একরকম।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ
সেই কালে বাংলার গ্রামে প্রবল ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত রোগভোগে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে রাহুতা গ্রামেও দেখা দিল কালান্তক ম্যালেরিয়া। এই সময়ে কিছু দিনের ব্যবধানে মড়কে একে একে ত্রৈলোক্যর ঠাকুরমা, বাবা ও মা মারা গেলেন। তিনি তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। এই ভাগ্যবিপর্যয়ে দরিদ্র সংসারের অবস্থা তছনচ হয়ে গেল। তাঁর পক্ষে আর লেখাপড়া চালানো সম্ভব হল না। কঠিন বাস্তব তাঁকে পথে নামিয়ে আনল। শুরু হল জীবন-সংগ্রাম।
কাজের সন্ধানে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
- (১) সংসারের অনটনের চাপে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন ত্রৈলোক্য। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে কাজ? পুরুলিয়ার মানভূমে থাকতেন এক আত্মীয়-শশিশেখর। কাজ পাবার আশায় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কাছেই রওনা হলেন ত্রৈলোক্যনাথ।
- (২) একরকম নিঃসম্বল অবস্থাতেই রেলপথে রানীগঞ্জ পর্যন্ত গেলেন। এরপর যেতে হবে তিনদিনের হাঁটা পথ। তখনকার দিনে যাতায়াত ব্যবস্থার সুব্যবস্থা ছিল না। পথঘাট তৈরি হয় নি। জঙ্গল আর পাহাড়ের পথ পাড়ি দিতে হবে ত্রৈলোক্যকে। পথে হিংস্র জন্তুর, দস্যুতস্করের ভয়। সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করে অজানা পথে নেমে পড়লেন তিনি।
- (৩) খাবারদাবার সঙ্গে কিছুই ছিল না। ক্ষুধাতৃষ্ণায় একমাত্র জলই ছিল ভরসা। এইভাবে টানা পথচলে একসময় দামোদর নদী অতিক্রম করলেন। সেই সময় পথে তাঁর আলাপ হল এক হিন্দুস্থানী চাপরাশির সঙ্গে। লোকটি আসামে কুলি পাচার করবার ঠিকাদারি করত। পরিচয় গোপন করে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে সে নানা গ্রাম থেকে কুলি সংগ্রহ করত।
- (৪) ত্রৈলোক্য এসব কিছুই জানতেন না। সরল মনে নিজের দুরবস্থার এবং কর্মসন্ধানের কথা তাকে জানালেন। আসানসোলে গিয়ে চাকরি দেবার নাম করে লোকটি তাঁকে রানীগঞ্জে নিয়ে গেল। আরও কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে চাপরাশি যখন এখান থেকে আসামের পথে রওনা হয়েছে, তখন ব্যাপারটা তাঁর কাছে আর অপরিষ্কার রইল না।
- (৫) ত্রৈলোক্য পালাবার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে সুযোগ করে দিল চাপরাশির রক্ষিতা। মাঝপথে তিনি ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন এবং অতি কষ্টে পুরুলিয়ার পথ ধরে মানভূমে শশিশেখরের বাড়িতে পৌঁছলেন।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ফার্সি শিক্ষা লাভ
আত্মীয়টি ত্রৈলোক্যকে সহৃদয়তার সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁর সকল দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিলেন। তাঁর সহায়তায় ত্রৈলোক্য স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হবারও সুযোগ পেলেন। প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পড়তেই ত্রৈলোক্য ফার্সি ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এক মৌলবীর কাছে ফার্সি শিখে অল্প দিনের মধ্যেই সমৃদ্ধ পারসিক সাহিত্য পড়ে ফেললেন। পারস্য সাহিত্যের বেস্তা, পান্দনামা, আমদানা, গোলেস্তাঁ ইত্যাদির মধুর আস্বাদ তাঁকে পারসিক গোলাপ খুশবুর মতোই মোহিত করল।
নিজ বাড়িতে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের আগমন
বাড়ির জন্য মন ছটফট করছিল। তাই একদিন মানভূম ছেড়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁকে খাটিয়ে নেবার মতলবে এই সময় এক আত্মীয় যশোরে কোটচাঁদপুরে কাজ দেবার নাম করে নিয়ে এল। আত্মীয়টি সেখানে কন্ট্রাকটরের কাজ করত। কাজ পাবার আশা নিয়ে এলেও আত্মীয়টির ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে ত্রৈলোক্য আবার বাড়ি ফিরে এলেন। দুর্ভাগ্য যেন তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল তাঁকে।
বর্ধমানে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
আবার কাজের সন্ধানে নেমে এলেন বর্ধমান-এ। হরকালী মুখোপাধ্যায় নামে এক আত্মীয়ের কাছে। হরকালী ছিলেন বর্ধমানের স্কুল সমূহের ডেপুটি ইনসপেক্টর। সদয় হয়ে তিনি ত্রৈলোক্যকে স্কুল শিক্ষকের কাজের জন্য পাঠালেন কাটোয়ায়। সেখানে ব্যর্থ হলে, বীরভূম-এর কীর্ণাহার ও পরে রামপুরহাটেও চেষ্টা হল। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে কোথাও চাকরি জুটল না। একটি কাজের আশায় পাগলের মতো স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটেছেন ত্রৈলোক্য। সঙ্গে সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। লজ্জাবশতঃ আত্মীয় হরকালীর কাছেও পয়সাকড়ি চাইতেন না। চলার পথে অচেনা মানুষের বাড়ি অতিথি হয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতেন।
অপরাজেয় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
ভাগ্যের এমন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কখনও ভেঙ্গে পড়েন নি তিনি। অদম্য মনোবল আর দুর্জয় সাহসে ভর করে কঠিন অবস্থার মোকাবিলা করেছেন। পথের দুর্গমতাই ত্রৈলোক্যকে অপরাজেয় করে তুলেছিল। জীবন সংগ্রামের রূঢ় বাস্তবতা থেকে যে দুর্লভ বস্তু এ সময়ে তিনি লাভ করেছিলেন তা হল মানুষ ও জগৎ সম্বন্ধে গভীর অভিজ্ঞতা। যা উত্তরকালে তাঁর সাহিত্য রচনার কাজে সহায়ক হয়েছিল।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের দুর্ভাগ্য
দুর্ভাগ্যের তাড়নায় পথে নেমেও বারবার ব্যর্থ হলেন ত্রৈলোক্য। তবু দমলেন না। একটু দম নেবার জন্য বর্ধমান রওনা হলেন। রামপুরহাট থেকে হাঁটাপথে সিউড়ি পৌঁছলেন। অনাহারে পথ চলে সেই সময় ধুঁকছেন তিনি। আশ্রয় ও আহারের আশায় এক স্কুলেব হেডমাস্টার নবীনচন্দ্র দাসের শরণাপন্ন হলেন। সৌভাগ্যবশতঃ দুইই জুটল। পরদিন রওনা হলেন বর্ধমানের পথে। নিঃসম্বল অবস্থায় পথে নেমে এই সময় তাঁকে তেঁতুল পাতা চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়েছে। সম্বল বলতে সঙ্গে ছিল একটি ছাতা। মগরায় পৌঁছে এতটাই অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত এক দোকানদারের কাছে ছাতাটি বন্ধক রেখে আহার্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
শিক্ষক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
ততদিনে ভাগ্য কিছুটা প্রসন্ন হয়েছিল। বর্ধমানে ফিরে আসার কিছুদিন পরে হিতৈষী হরকালীবাবুর চেষ্টায় বীরভূমের দ্বারকার স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেলেন ত্রৈলোক্যনাথ। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর রানীগঞ্জের উখড়ায় এক স্কুলে মাসিক আঠারো টাকা মাইনেতে দ্বিতীয় শিক্ষকের কাজে নিযুক্ত হলেন।
দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখনী
সময়টা ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভিক্ষ অবস্থা। এই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি পরে লিখেছেন, “রাত্রিদিন লোকের ক্রন্দনে, কৃষ্ণবর্ণ শীর্ণকায় নর-নারী বালক বালিকাদের অবস্থা দেখিয়া বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। দুর্ভিক্ষের ফলে জিনিসপত্র মহার্ঘ। বাড়িতে চার-চারটি ভাই। এই আঠারো টাকায় প্রবাসে নিজের অন্নবস্ত্রের সংস্থান। তার উপর গ্রামের বাড়ীতে ভাইদের প্রতিপালন প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িত। নিজের জন্য যৎসামান্য রাখিয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারীর দুঃখমোচনের চেষ্টা করিতাম আর বাড়িতে পাঠাইতাম।”
জমিদারি স্কুলের ঈক্ষক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
তাঁর আত্মকথা থেকে জানা যায় পরবর্তী কালে তিনি শাহজাদপুরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জমিদারি স্কুলে পঁচিশ টাকা মাইনেতে শিক্ষক নিযুক্ত হন।
লোকহিতব্রতী ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
- (১) ত্রৈলোক্যনাথ বরাবরই ছিলেন লোকহিতব্রতী। নিজে অপরিসীম দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের মধ্যে বড় হয়েছিলেন বলে দুঃখীর ব্যথা-যন্ত্রণা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। সময় সুযোগ মতো সাধ্যানুযায়ী লোকের উপকার করার চেষ্টা করতেন তিনি। তাঁর চরিত্রের এই পরিচয় দুর্ভিক্ষের বর্ণনাতেও পাওয়া যাবে।
- (২) শাহবাজপুর অঞ্চল বর্ষাকালে জলে ডুবে যেত। নৌকো ছাড়া সেই সময় স্থানান্তরে যাতায়াতের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ত্রৈলোক্য তখন সেখানে পরিচিত শিক্ষকমশায়। একবার বর্ষাকালে এক অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়লেন।
- (৩) নৌকোয় যাওয়ার পথে তাঁর চোখে পড়ল তিন বৃদ্ধা এক মাটির ঢিবিতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সঙ্গে কোন জিনসপত্র নেই। চারদিকে জল। তাদের উদ্ধার করার জন্য কাছে এসে পরিচয় ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তরই পেলেন না। দেখা গেল তারা তিন জনই দৃষ্টিহীন, কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না।
- (৪) কোথা থেকে এই হতভাগ্য তিন বৃদ্ধা সেখানে এসেছে, কে তাদের নিয়ে এল, কিছুই জানার উপায় ছিল না। ত্রৈলোক্যনাথ অসহায় তিনটে মানুষকে ওরকম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে রেখে আসতে পারলেন না। নিজেদের নৌকোয় তুলে শাহবাজপুরে নিয়ে এলেন।
- (৫) ঠাকুরবাড়ির জমিদারির নায়েবমশাই কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথের এই কাজে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। জাতিগোত্র জানা নেই, অজ্ঞাতকুলশীল, হোক না দুর্গত অসহায়, মুমূর্ষু এই মানুষগুলো মারা যাবার পর মৃতদেহ কে পরিষ্কার করবে?
- (৬) এই নিয়ে প্রবল কথাকাটাকাটি হল। রূঢভাষায় অভিযোগ শুনতে হল ত্রৈলোক্যনাথকে তাঁব এই মানবিক বাবহারের জন্য। নায়েবমশাই হুকুম করলেন, মানুষগুলো যেখানে ছিল ত্রৈলোক্যনাথ যেন সেখানেই তাদের রেখে আসেন। কেউ তাকে কোনরকম সাহায্য করবে না।
- (৭) ত্রৈলোক্য কিন্তু হুকুম গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। নিজ দায়িত্বেই তিনি রেখে দিলেন তিন বৃদ্ধাকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পরদিন বুড়িদের দেখা পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজখবর করেও তিনি ব্যর্থ হলেন। এই ব্যাপার নিয়ে সেসময় তাঁর সঙ্গে শাহবাজপুর জমিদারির সম্পর্ক ছেদ হল। এককথায় স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন।
দীনবন্ধু মিত্রের সাথে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরিচয়
বাড়ি ফেরার পথে পাটনায় তাঁর সঙ্গে নীলদর্পণখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র-এর পরিচয় হয়েছিল। ফের কর্মহীন বেকারত্ব। মাথায় দুর্ভাবনা। কিছুতেই দমবার পাত্র নন তিনি। সারাজীবন ধরে সব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলবার শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন। তাই হতাশার অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলোর সন্ধানে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
কটকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
- (১) কিছুদিন পরে জানতে পারলেন তাঁর হিতৈষী আত্মীয় হরকালীবাবু কটকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে রয়েছেন। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ত্রৈলোক্য উপস্থিত হলেন কটকে। এই যাত্রায় তাঁকে মহানদী পার হতে হয়েছিল সাঁতার কেটে। শেষ পর্যন্ত হরকালী মশায়ের চেষ্টায় ত্রৈলোক্যনাথ পুলিশের সাব ইনসপেক্টরের কাজ পেলেন।
- (২) সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দেবার পর এতদিনে একটু যেন নির্ভরতার আশ্রয় পাওয়া গেল। বস্তুতঃ এই কাজ পাবার পর থেকেই তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। কঠিন অধ্যবসায় ও নিষ্ঠানিবিড় কর্মোদ্যোগের পুরস্কার অর্জন করলেন তিনি।
- (৩) কটকে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে পুলিশের কাজে থেকে ওড়িয়া ভাষা ভালভাবে শিখলেন ত্রৈলোক্যনাথ। এখানে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ওড়িয়া মাসিকপত্র উৎকল শুভকরী।
হান্টার সাহেবের সাহচর্যে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
- (১) এই সময়ে ত্রৈলোক্যর সুপ্রসিদ্ধ সিভিলিয়ান ঐতিহাসিক ডব্লু ডব্লু হান্টার সাহেবের সাহচর্যে আসার সুযোগ ঘটে। তাঁর কর্মনিষ্ঠা ও জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে হান্টার সাহেব তাঁকে নিজের অধীনে কলকাতায় নিয়ে এলেন। বেঙ্গল গেজেটিয়ার সংকলনের কাজে নিযুক্ত হলেন তিনি।
- (২) কর্মদক্ষতা গুণে এখানে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে হান্টার সাহেবের সহযোগী হয়েছিলেন। দশখণ্ডে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকেল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল সঙ্কলন তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং হান্টার সাহেবের উদ্যোগে পরে প্রকাশিত হয়েছিল।
কেরানি পদে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
- (১) এর পরে ত্রৈলোক্যনাথ পশ্চিম ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগে প্রধান কেরানীর পদে যোগ দেন। পরে বিভাগীয় ডিরেক্টরের একান্ত সহযোগী পদে উন্নীত হন। এই কাজে থাকাকালে ত্রৈলোক্যনাথ স্বাধীনভাবে দেশহিতকর কাজ করার সুযোগ পান।
- (২) তাঁরই প্রত্যক্ষ উদ্যোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত নানান কুটিরজাত শিল্পদ্রব্য ও শিল্পীসম্প্রদায় পাশ্চাত্য জগতে পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বহু পূর্ব থেকে কারুকার্য করা নানান শিল্পদ্রব্য তৈরি হত।
- (৩) রাজদরবারে এবং সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে এসকল শিল্পদ্রব্যের খুবই সমাদর ছিল। ইংরাজ রাজত্বেও রাজকর্মচারীরা শিল্প সমৃদ্ধ কাশীর রেশম কাপড়, পিতলের কাজ, লখনৌ-এর চিকন, সূচীদ্রব্য, সোনা-রূপার অলঙ্কার, বিদরীর কাজ, মোরাদাবাদের পিতলের মিঞা কলম, নগীনার কাঠের কাজ ইত্যাদির সমাদর অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু এসব শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করা ছিল এক দুরূহ কাজ।
- (৪) দক্ষ শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে এসব কাজ করতেন। তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্যের নির্দিষ্ট কোন বাজার না থাকাতে ক্রেতার অভাবে দিন দিনই শিল্পীরা হীন অবস্থার শিকার হয়ে চলেছিলেন। অন্নসংস্থানের তাড়নায় অনেক শিল্পীই বংশগত পেশা পরিত্যাগ করে অন্য পেশায় নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছিলেন। এভাবে ভারতের মহামূল্যবান কুটিরজাত শিল্প অবলুপ্ত হতে বসেছিল।
- (৫) স্বদেশপ্রাণ ত্রৈলোক্যনাথ সুযোগ পেয়েই পরাধীন জাতির অবহেলিত শিল্পীসম্প্রদায়ের লুপ্ত গৌরব উদ্ধার ও সংরক্ষণের প্রয়াসে তৎপর হলেন। সরকারের এক উচ্চপদস্থ ইংরাজ কর্মচারী বকসাহেবের কাছ থেকে তিনি পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করলেন এবং এলাহাবাদে একটি হোটেলে সেসব প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন।
- (৬) স্টেশনের সন্নিকটবর্তী এই হোটেলে বিলেতগামী সাহেব মেমদের আনাগোনা ছিল। দেশীয় শিল্পদ্রব্য তাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য জগতে পরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্য ছিল ত্রৈলোক্যনাথের। তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ হল না। হু হু করে বিক্রি হতে লাগল এই সব শিল্পসম্ভার।
- (৭) শ্বেতাঙ্গ ক্রেতাদের আগ্রহ দেখে হোটেলমালিক এবার নিজেই ব্যবসায় নেমে পড়লেন। প্রদর্শনীর অবিক্রিত মালপত্র নিজের টাকাতেই কিনে নিলেন। ত্রৈলোক্যনাথ বকসাহেবের ঋণের টাকা পরিশোধ করে দিলেন।
- (৮) দেশীয় কুটীর শিল্পের প্রচার ও প্রসার কল্পে ত্রৈলোক্যনাথের এই উদ্যোগের ফলে অচিরেই তার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ফলে দেশের নানা প্রান্তের ব্যবসায়ীগণ উৎসাহিত হয়ে ভারতীয় কারুশিল্পের ব্যবসায় এগিয়ে এল। দেশে ও বিদেশে সমাদর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় দুঃস্থ শিল্পীদের অন্নসংস্থানের সুযোগ সুবিধাও ফিরে এল।
হরিদ্বারে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
মানুষের দুঃখে প্রাণ কাঁদত বলে দেশহিতকর নানা কাজের সঙ্গে সকল সময়ই যুক্ত থাকতেন ত্রৈলোক্যনাথ। এসকল কাজে বিপদ বাধা বা ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিকে কোন কালেই তিনি বড় করে দেখতেন না। একবার হরিদ্বারের কাছে রাজঘাটে এসেছেন ত্রৈলোক্যনাথ। সেই সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ অবস্থা চলছে। খাদ্যশস্যের ফলনের ব্যাপক অপ্রতুলতা হেতু দুর্ভিক্ষপীড়িত বহু মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাচ্ছিল। মানুষের দুরবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। ব্যক্তিগত অর্থে যব কিনে বিতরণ শুরু করলেন। সঙ্গের সমস্ত অর্থই ফুরিয়ে গেল।
এলাহবাদে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
এদিকে ফিরতে হবে এলাহাবাদে। শেষ পর্যন্ত কোনও রকমে তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলেন। বিপত্তির ওখানেই শেষ হল না। পথে সঙ্গের বাক্স, জামাকাপড় ও দামী জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেল। একরকম সর্বস্ব খুইয়েই এলাহাবাদে ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু অন্ততঃ কিছু মানুষের উপকার করতে পেরেছেন ভেবে সব ক্ষতিই অগ্রাহ্য করলেন।
গাজর চাষ সম্পর্কে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ
সেবারেই তিনি গ্রামে ঘোরার সময় জানতে পারলেন খাদ্যাভাবের সময়ে গাজর খাইয়ে মানুষের প্রাণরক্ষা সম্ভব হতে পারে। ১৮৭৭-‘৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজর চাষের উপকারিতা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করলেন। সরকার তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং সরকারী নির্দেশ ও উৎসাহে জেলায় জেলায় ব্যাপকভাবে গাজর চাষের ব্যবস্থা হতে লাগল। এই ব্যবস্থার উপকার পাওয়া গেল দু বছর পরেই। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে রায়বেরিলী ও সুলতানপুর জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কেবলমাত্র গাজর খেয়ে হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচল।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে আনর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী
সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের কৃষি-বাণিজ্য বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে বদলি হলেন। এই সুযোগে তিনি কেবল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নয় সারা ভারতের কারুশিল্পের সর্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টায় বিশেষভাবে উদ্যোগী হলেন। তাঁর আগ্রহে ও চেষ্টায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীর। সেই প্রদর্শনীতে ত্রৈলোক্যনাথ হলেন কয়েকটি বিষয়ের অধ্যক্ষ।
বিলেতে যেতে ব্যর্থ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
সেই বছরেই বিলেতে যে আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী হল তাতে যোগ দেবার জন্য ত্রৈলোক্যনাথকে ভারত সরকারের প্রতিনিধি মনোনীত করা হল। কিন্তু সেকালে এদেশীয় গোঁড়া হিন্দু সমাজ বিলাত গমনের বিরোধী ছিলেন। ম্লেচ্ছ দেশে গেলে ব্রাহ্মণের জাত যেত এবং তাদের সামাজিক বয়কটের শিকার হতে হত। আত্মীয়-স্বজনের আপত্তির ফলে সেবার আর তাঁর বিলেত যাওয়া সম্ভব হল না।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ইউরোপ ভ্রমণ
শিল্পের প্রসার ও উন্নতি বিষয়ে ত্রৈলোক্যনাথের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সরকার সবিশেষ অবগত ছিলেন। তাই তিন বছর পরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ঔপনিবেশিক শিল্প প্রদর্শনীতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ভারত সরকার। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও সকল সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অগ্রাহ্য করে সেবারে তিনি বিলেত পাড়ি দিলেন। সেবারে ইংল্যান্ড-এর বহু জায়গা ছাড়াও ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি প্রভৃতি দেশে পরিভ্রমণ করে দেশে ফিরে এলেন। তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা পরে প্রকাশ করেছেন বই আকারে। তাঁর রচিত এ ভিজিট টু ইউরোপ অন্যতম বিখ্যাত বই।
কলকাতা জাদুঘরে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব বিভাগ ছেড়ে তিনি যোগ দিলেন কলকাতা জাদুঘর বা মিউজিয়ামের সহকারী কিউরেটর পদে। এই কাজে থাকার সময়ে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য শিল্পদ্রব্যের বিবৃতিমূলক তালিকাপুস্তক Ar Manufacturers of India রচনা করেন।
সাহিত্যে হাস্যরসের প্রবর্তক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
আজীবন সরকারী পদে চাকরি করলেও বাংলাদেশ-এ প্রধানত হাস্যরসাত্মক সাহিত্য রচয়িতা হিসেবেই ত্রৈলোক্যনাথের সমধিক পরিচিতি। উদ্ভট হাস্যরসের প্রবর্তক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। উপন্যাস, কবিতা ও বিজ্ঞানবিষয়ের পুস্তক রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রচনাবলী
ব্যঙ্গ উপন্যাস কঙ্কাবতী রচনা করে তিনি লেখক খ্যাতি লাভ করেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর রচিত বিখ্যাত বাংলা গ্রন্থ ভূত ও মানুষ, ফোকলা দিগম্বর, মুক্তমালা, মডেল ভগিনী, কালাচাঁদ, নেড়া হরিদাস, ময়না কোথায়, মজার গল্প, পাপের পরিণাম, ডমরু চরিত প্রভৃতি। এছাড়া ভারতীয় বিজ্ঞানসভা, A Descriptive Catalogue of Prod- ucts. A Hand Book of Indian Products. A list of Indian Economic Products প্রভৃতি তাঁর বহুপ্রশংসিত রচনা। বিজ্ঞানবোধ সহ কয়েকটি স্কুল পাঠ্য বইও তিনি লিখেছিলেন। সেকালের বিখ্যাত কয়েকটি পত্রিকা যেমন বঙ্গবাসী, জন্মভূমি প্রভৃতি এসবের তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন।
ছাপাখানা স্থাপনে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের অবদান
ভ্রাতা রঙ্গলালের সহযোগিতায় তিনি একসময় নিজের গ্রামে একটি ছাপাখানাও করেছিলেন। বিশ্বকোষ রচনাকালে তিনি রঙ্গলালকে সাহায্য করেন। দুজনের সম্পাদনায় বিশ্বকোষের কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। Wealth of India পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের শেষ জীবন
শেষ জীবনে ত্রৈলোক্যনাথ সাহিত্য সাধনাতেই ব্যাপৃত ছিলেন। সে যুগের বরেণ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বর্তমান কালেও তাঁর সরস রচনাগুলি সমান ভাবে সমাদৃত।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু
এক চিরঅপরাজেয় পরিপূর্ণ সংগ্রামী মানুষ ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ। তাঁর জীবন-সংগ্রামের কাহিনী সকল মানুষেরই প্রেরণার স্থল। এই মহৎ প্রাণ ত্রৈলোক্যনাথের কর্মময় জীবনের অবসান হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।
উপসংহার :- ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য প্রতিভা, যিনি তাঁর রম্য ও ব্যঙ্গ রচনার মাধ্যমে সাহিত্যকে নতুন দিক দিয়েছিলেন। সমাজের অসঙ্গতি, কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁর তীক্ষ্ণ ও ব্যঙ্গাত্মক লেখা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে। তিনি শুধু বিনোদনমূলক রচনা করেন নি, বরং সমাজকে সচেতন করার জন্য হাস্যরস ও ব্যঙ্গকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর লেখার সরলতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অমর করে রেখেছে। ত্রৈলোক্যনাথের সাহিত্যকীর্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পাঠ ও চিন্তার মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
(FAQ) ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যঙ্গ রচয়িতা ও ঔপন্যাসিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ হাস্যরসের মাধ্যমে লেখালেখি করেছিলেন।
ত্রৈলোক্যনাথের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে ডমরু-চরিত এবং কঙ্কাবতী উল্লেখযোগ্য।
ত্রৈলোক্যনাথের লেখায় সমাজের অসঙ্গতির উপর ব্যঙ্গ, গভীর বিশ্লেষণ এবং তীক্ষ্ণ হাস্যরসের সমন্বয় দেখা যায়। তিনি প্রথাগত চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করতেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ব্যঙ্গ রচনার সূচনা করেন এবং রম্যরচনার মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ত্রৈলোক্যনাথ তাঁর রচনায় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, এবং সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেছেন।
ত্রৈলোক্যনাথের রচনা পাঠকদের সমাজের অসঙ্গতি চিনতে এবং সেগুলোর সমাধানে যুক্তিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করত।