চীনের উপর আরোপিত অসম চুক্তি প্রসঙ্গে অসম চুক্তির ব্যাখ্যা, সময়কাল, বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন অসম চুক্তি হিসেবে নানকিং এর সন্ধি, বগ এর সন্ধি, ওয়াংঘিয়ার সন্ধি, হোয়ামপোয়ার সন্ধি, আইগুন-এর সন্ধি, তিয়েনসিনের সন্ধি, পিকিং এর সন্ধি, সিমনোশেকির সন্ধি ও বক্সার প্রোটোকল সম্পর্কে জানবো।
চীনের উপর আরোপিত অসম চুক্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | অসম চুক্তি |
প্রথম আফিম যুদ্ধ | ১৮৩৯-৪২ খ্রি |
নানকিং-এর সন্ধি | ১৮৪২ খ্রি |
তিয়েনসিনের সন্ধি | ১৮৫৮ খ্রি |
পিকিং-এর সন্ধি | ১৮৬০ খ্রি |
বক্সার বিদ্রোহ | ১৮৯৯-১৯০১ খ্রি |
বক্সার প্রোটোকল | ১৯০১ খ্রি |
ভূমিকা :- পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি দীর্ঘকাল ধরে চীন এবং জাপান-এর অভ্যন্তরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হলেও উনিশ শতক থেকে বহিরাগত দেশগুলির কাছে চিনে প্রবেশের কঠোরতা হ্রাস পেতে থাকে। এর ফলে পশ্চিমের বিভিন্ন শক্তি অনগ্রসর চিনে প্রবেশ করে দ্রুত নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
অসম চুক্তির ব্যাখ্যা
উনিশ শতকের ও বিশ শতকের শুরুতে চিনে কিং বা চিং বংশের শাসনকালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চিনকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে সেদেশে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের প্রসার ঘটায়। এই সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রায় প্রত্যেকটি যুদ্ধের পরই চিনের ওপর বিভিন্ন শোষণমূলক সন্ধি বা চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে অসম চুক্তি’ বা ‘বৈষম্যমূলক চুক্তি’ নামে পরিচিত।
অসম চুক্তির সময়কাল
মোটামুটিভাবে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের সঙ্গে এরূপ শোষণমূলক আচরণ চালাতে থাকে। এজন্য চিনের সঙ্গে পশ্চিমি শক্তিগুলির স্বাক্ষরিত অসম চুক্তিগুলিকে চিনের শতাব্দীব্যাপী অবমাননা বলে চিহ্নিত করা হয়। মোটামুটিভাবে বিংশ শতকের শুরু থেকে চিনের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কর্তৃক আরোপিত চুক্তিগুলিকে ‘অসম’ বা ‘বৈষম্যমূলক’ চুক্তি বলে অভিহিত করা শুরু হয়।
‘অসম’ চুক্তিগুলির বৈশিষ্ট্য
বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(ক) একতরফা চুক্তি
এই সব চুক্তি চিনা সরকারের সঙ্গে পশ্চিমি শক্তিগুলির পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয় নি। কোনো-না-কোনো যুদ্ধে পশ্চিমি শক্তিগুলির কাছে চিনের পরাজয়ের পর পশ্চিমি শক্তিগুলি চিনের ওপর একতরফাভাবে এই সব চুক্তি চাপিয়ে দেয়।
(খ) চিনের ভূখণ্ডে আধিপত্য
এই সব চুক্তির দ্বারা বিদেশি শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তার ফলে এই সমস্ত অঞ্চলে চিনা সরকার ও প্রশাসনের অধিকার ও ক্ষমতা লুপ্ত হয় বা হ্রাস পায়।
(গ) সার্বভৌমত্বে আঘাত
পশ্চিমি শক্তিগুলি কর্তৃক আরোপিত এই সব চুক্তি সরাসরি চিনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করে। এই সব চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে চিনের সার্বভৌমত্ব যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চিন প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমি শক্তিগুলির ‘আধা-উপনিবেশ’-এ পরিণত হয়।
(ঘ) ক্ষতিপূরণ আদায়
চিন ও পশ্চিমি শক্তিগুলির মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের জন্য চিনই একমাত্র দায়ী ছিল না। অথচ যুদ্ধের পর একতরফাভাবে আরোপিত বিভিন্ন চুক্তির অজুহাতে পশ্চিমি শক্তিগুলি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চিনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে বাধ্য করে।
(ঙ) সুবিধা আদায়
চিন বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কাছে নিজেদের বিভিন্ন বন্দর খুলে দিতে এবং বিভিন্ন অঞ্চল লিজ দিতে বাধ্য হয়। যেমন – চিনের হংকং বন্দর ব্রিটেনের জন্য এবং ম্যাকাও বন্দর পোর্তুগালের জন্য খুলে দেয়।
(চ) অন্যান্য
এ ছাড়াও বিদেশি শক্তিগুলি চিনকে আরও বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা দিতে বাধ্য করে। এইসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা চিনের ওপর আরোপিত এই চুক্তিগুলিকে ‘অসম’ বা ‘বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করা হয়।
বিভিন্ন অসম চুক্তি
চিনা ঐতিহাসিক ওয়াং ডং মনে করেন যে, ‘অসম চুক্তি’ কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বহুল প্রচলিত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এর সুস্পষ্ট অর্থের অভাব রয়েছে। তা ছাড়া কোন চুক্তিগুলিকে সঠিকভাবে ‘অসম’ বা ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দেওয়া উচিত, তা-ও পরিষ্কার ছিল না। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন ‘অসম’ চুক্তির উল্লেখ করে থাকেন। এই চুক্তিগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল –
(ক) নানকিং-এর অসম চুক্তি
প্রথম আফিমের যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ব্রিটিশদের সঙ্গে নানকিং-এর অসম সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা –
- (১) ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংগপো – চিনের এই পাঁচটি বন্দর ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই বন্দরগুলি ‘চুক্তি বন্দর’ নামে পরিচিত হয়।
- (২) এই বন্দরগুলিতে ইউরোপীয়রা নিজ নিজ কনসাল নিয়োগের অধিকার পায়।
- (৩) হংকং বন্দর চিরকালের জন্য ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
- (৪) ‘কো-হং’ প্রথা বাতিল হয় এবং চিনের সর্বত্র ইংরেজ বণিকদের পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের অধিকার স্বীকৃত হয়।
- (৫) চিনে ব্রিটিশ আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫% শুল্ক ধার্য হয়।
- (৬) ক্যান্টন বন্দরে ইংরেজদের আফিম ধ্বংস করার জন্য চিনের সরকার ইংরেজদের ৬ মিলিয়ন, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২ মিলিয়ন এবং ‘কো-হং’ বণিকদের ঋণ পরিশোধের জন্য ৩ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার দিতে বাধ্য হয়
- (৭) ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চিনের ওপর আরোপিত এই তীব্র ‘অসম’ বা ‘বৈষম্যমূলক’ চুক্তি চিনের সার্বভৌমত্বকে দারুণভাবে ব্যাহত করে।
(খ) বগ -এর অসম চুক্তি
ব্রিটিশ সরকার চিনের ওপর নানকিং-এর অসম চুক্তি চাপানোর কিছুকাল পর ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর বগ-এর সন্ধি নামে অপর একটি অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা ইংল্যান্ড চিনে কিছু ‘অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার’ লাভ করে। এই অসম চুক্তির দ্বারা –
- (১) চিনের ‘চুক্তি বন্দর’ গুলিতে বসবাসকারী চিনা ও ব্রিটিশ – সব অধিবাসীদের ওপর চিনের আইন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার লুপ্ত হয়ে ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার অধীনে আসে।
- (২) চিন অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে যেসব সুযোগসুবিধা দেবে সেগুলি ব্রিটেনকেও দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এই চুক্তির দ্বারা চিনের সার্বভৌমত্ব খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- (৩) নানকিং ও বগ-এর সন্ধির সূত্র ধরে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, আমেরিকা, রাশিয়া, পোর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নানান সুযোগসুবিধা আদায় করতে শুরু করে।
(গ) ওয়াংঘিয়ার অসম চুক্তি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৩ জুলাই চিনের ওপর ওয়াংঘিয়া-র অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তির দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনে বিভিন্ন অতি-রাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে। চিনের চুক্তি বন্দর গুলিতে বসবাসকারী বিদেশিরা আইনগত, বিচারবিভাগীয়, পুলিশসংক্রান্ত এবং করসংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
(ঘ) হোয়ামপোয়া-র অসম চুক্তি
ফোন্স ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর চিনের ওপর হোয়ামপোয়া-র অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা –
- (১) ফরাসি বণিকদের জন্য চিনের নতুন পাঁচটি বন্দর খুলে দেওয়া হয়।
- (২) চিনে ফরাসি নাগরিকদের অতি-রাষ্ট্রিক সুবিধা দেওয়া হয়।
- (৩) চিন ও ফরাসি বণিকদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নির্দিষ্ট হয়।
(ঙ) আইগুন-এর সন্ধি
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে চিনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে চিন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগে প্রতিবেশী রাশিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে চিনের ওপর আইগুন-এর সন্ধি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা –
- (১) চিনের উত্তরাংশের বেশ কিছু ভূখণ্ডে রাশিয়া নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
- (২) চিনের আমুর, উসুরি ও সংঘুয়াজিয়াং নদীতে একমাত্র রাশিয়া ও চিনের নৌ-চলাচল স্বীকৃত হয়।
(চ) তিয়েনসিনের অসম চুক্তি
নানকিং-এর সন্ধির পরও ইউরোপীয় শক্তিগুলি তৃপ্ত ছিল না। দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধে চিন পরাজিত হলে চিনের ওপর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিয়েনসিনের অসম সন্ধি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা –
- (১) চিন সরকার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়।
- (২) বিদেশি বণিকদের জন্য চিনের আরও ১১টি বন্দর খুলে দেওয়া হয়।
- (৩) রাজধানী পিকিং-এ (বর্তমান বেইজিং) বিদেশি দূতাবাস স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- (৪) ছাড়পত্রের মাধ্যমে বিদেশিরা চিনের অভ্যন্তরে অবাধ ভ্রমণের এবং খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা চিনে বসবাস ও ধর্মপ্রচারের অনুমতি পায়।
- (৫) বিদেশি বণিকদের সুবিধার্থে বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস করা হয়।
- (৬) চিনে নির্দিষ্ট শুল্কের বিনিময়ে আফিমের ব্যাবসা বৈধ বলে স্বীকৃত হয়।
- (৭) চিনের অভ্যন্তরে বিদেশি বণিকদের অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার স্বীকৃত হয়।
(ছ) পিকিং-এর সন্ধি
তিয়েনসিনের সন্ধির শর্তগুলি চিনকে চরম দুরবস্থায় ফেলে দেয়। এজন্য চিন সরকার এই চুক্তি অনুমোদনে টালবাহানা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে চিন আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের সঙ্গে পিকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ঐতিহাসিক ইমান্যুয়েল সু বলেন, যে, “প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি চিন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিমের কাছে পুরোপুরি পরাজিত ও অপমানিত হয়।”
(জ) শিমোনোসেকির সন্ধি
চিনের প্রতিবেশী জাপান ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লু-চু দ্বীপপুঞ্জ দখল করে দীর্ঘদিন ধরে কোরিয়ার প্রতি আগ্রাসন চালাতে থাকে। কোরিয়াকে কেন্দ্র করে ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে চিন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে জাপানের কাছে বৃহদাকার চিন পরাজিত হলে চিনের ওপর জাপান ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে শিমনোশেকি-র সন্ধি চাপিয়ে দেয়।
(১) সন্ধির শর্তাবলি
শিমনোশেকি-র সন্ধি অনুসারে,
- [i] কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দানে বাধ্য হয়।
- [ii] চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডোরেস, তাইওয়ান, লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার লাভ করে।
- [iii] জাপানকে চিন ২০০ মিলিয়ন কিউপিং টেল ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।
- [iv] চিন তার বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়।
(২) চিনে বিদেশিদের প্রভাবাধীন অঞ্চল
চিনে জাপানের সাফল্যে ইউরোপীয় শক্তিগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সের চাপে জাপান লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার চিনকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ইউরোপীয় শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অংশে নিজ নিজ প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তুলে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। যেমন –
- [i] ইংল্যান্ড ইয়াংসি কিইয়াং উপত্যকায় ও দক্ষিণ চিনে,
- [ii] জার্মানি শাংটুং, হ্যাং-কাও এবং তিয়েনসিনে,
- [iii] রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া ও বহির্মঙ্গোলিয়ায়,
- [iv] ফ্রান্স ইউনান, কোয়াংসি এবং কোয়াং টুং অঞ্চলে,
- [v] জাপান ফু-কিয়েন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
(৩) চিনা তরমুজের খন্ডীকরণ
ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক এই অবস্থাকে ‘চিনা তরমুজের খণ্ডীকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। খাওয়ার জন্য তরমুজকে যেমন খন্ড খন্ড করে কাটা হয়, পাশ্চাত্য দেশগুলি সেইভাবে চিনকে টুকরো টুকরো করে আত্মসাৎ করে।
(ঝ) বক্সার প্রোটোকল
(১) বক্সার বিদ্রোহ
চিং বা কিং বংশের (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.) শাসনকালে চিনে বিদেশি শক্তিগুলির শোষণ, নির্যাতন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে ‘আই হো চুয়ান’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি বক্সার বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০১ খ্রি.) শুরু করে। বিদ্রোহীরা ধ্বনি তোলে “বিদেশি দানবদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করো”, “বিদেশি শয়তানদের ধ্বংস করো, চিংদের রক্ষা করো। “বিদ্রোহীরা ব্যাপকভাবে বিদেশিদের হত্যা, রেলপথ, টেলিগ্রাফ, গির্জা প্রভৃতি ধ্বংস করতে থাকে। তারা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে পিকিং-এ অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলি অবরোধ করে সেখানকার কর্মীদের ওপর তীব্র অত্যাচার চালায়।
(২) বিদ্রোহ দমন
ছয় সপ্তাহ অবরোধের পর ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান, ইতালি প্রভৃতি আটটি দেশের সম্মিলিত বাহিনী বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হয়। দূতাবাসগুলি অবরোধমুক্ত (১৪ আগস্ট) করার পর বিদেশি বাহিনী পিকিং-এ ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও লুঠতরাজ চালায়। চিনের সম্রাজ্ঞী জু-সি পাত্রমিত্র-সহ পিকিং ত্যাগ করেন।
(৩) শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর
শেষপর্যন্ত দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর ১১টি বিদেশি শক্তি ‘বক্সার প্রোটোকল’ নামে এক চুক্তির মাধ্যমে চিনের ওপর বিভিন্ন কঠোর নীতি চাপিয়ে দেয়।
(৪) চুক্তির শর্তাবলি
বক্সার প্রোটোকলের শর্তানুসারে,
- [i] বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ১২ জন রাজপুরুষের প্রাণদণ্ড হয় এবং শতাধিক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
- [ii] চিনের ওপর বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়।
- [iii] পিকিং-এর বিদেশি দূতাবাসগুলি রক্ষার জন্য সেখানে স্থায়ী বিদেশি সেনা মোতায়েন করা হয়।
- [iv] চিনের ২৫টি দুর্গ ভেঙে ফেলা হয় এবং ১২৫টি রেলওয়ে স্টেশন ইউরোপীয় সেনাদের দখলে রাখা হয়।
- [v] পরবর্তী দু-বছরের জন্য চিনে অস্ত্র নির্মাণ ও আমদানি নিষিদ্ধ হয়।
- [vi] চিন সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় যে, বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে ৫ শতাংশের বেশি শুল্ক আদায় করা হবে না।
উপসংহার :- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব-এর পরবর্তীকালে চিনের কাছ থেকে বিভিন্ন অসম চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত সুযোগসুবিধা সোভিয়েত রাশিয়া ত্যাগ করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে চিনা জাতীয়তাবাদীরাও পশ্চিমি শক্তিগুলির কাছ থেকে শুল্ক আদায়ে সক্ষম হয়। কিন্তু চিনে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যেসব অতি-রাষ্ট্রিক সুযোগসুবিধা লাভ করেছিল, তা অন্তত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় থাকে। চিনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে হংকং-এর ওপর এবং পোর্তুগাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকাও-এর ওপর তাদের দাবি ত্যাগ করে।
(FAQ) চীনের উপর আরোপিত অসম চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে চিন ও ইংল্যান্ড।
চিন ও ইংল্যান্ড।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৯৯-১৯০১ খ্রিস্টাব্দে।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে।