ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমচন্দ্র কানুনগো প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, কর্মজীবন, অরবিন্দ ঘোষের গুপ্ত সমিতিতে, বোমা কারখানার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তৈরি তিনটি বোমা, ইংল্যান্ড গমন, হেমচন্দ্র কানুনগোর বোমা তৈরির ফর্মুলা শিক্ষা লাভ, ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় পতাকার স্কেচ তৈরি, রচিত গ্ৰন্থ, শেষ জীবন ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমচন্দ্র কানুনগো
ঐতিহাসিক চরিত্র | হেমচন্দ্র কানুনগো |
জন্ম | ৪ আগস্ট ১৮৭১ খ্রি |
পিতা | ক্ষেত্রমোহন কানুনগো |
পরিচিতি | ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী |
রাজনৈতিক দল | অনুশীলন সমিতি |
কীর্তি | জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি |
মৃত্যু | ৮ এপ্রিল ১৯৫১ খ্রি |
ভূমিকা :- বাংলার প্রথম বোমার কারিগর, ভারত-এর প্রথম পতাকা এঁকেছিলেন তিনিই, কিন্তু আজ সেই মানুষটাই ইতিহাসে উপেক্ষিত। তাই বিস্মৃতি সরিয়ে চলুন ফিরে দেখি অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য হেমচন্দ্র কানুনগো কে।
হেমচন্দ্র কানুনগোর জন্ম
৪ আগস্ট ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার রাধানগর গ্রামে হেমচন্দ্র কানুনগো জন্মগ্ৰহণ করেন। তার আসল নাম হেমচন্দ্র দাস কানুনগো।
হেমচন্দ্র কানুনগোর বংশ পরিচয়
তার পিতার নাম ক্ষেত্রমোহন কানুনগো। তাদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল ওড়িশার জাজপুরে এবং পদবি ছিল ‘দাস’। জমি জরিপের কাজে তারা এখানে আসেন আর সেকারণে তাদের পদবি হয় ‘কানুনগো’।
হেমচন্দ্র কানুনগোর শিক্ষা
তিনি মেদিনীপুর টাউন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। সেখানে মেদিনীপুর কলেজে এফ.এ ক্লাসে পড়বার সময় অভিভাবকদের জোরাজোরিতেই ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশব থেকেই তার ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল। শেষে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে এবং বউবাজার আর্ট গ্যালারিতে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর কর্মজীবন
তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক এবং কলেজে রসায়নে ডেমনস্ট্রটরের চাকরি নেন। কিন্তু তার স্বাধীনতা স্পৃহা তাকে টেনে নিয়ে আসে ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের আঙিনায়।
হেমচন্দ্র কানুনগোর দুই সত্তা
একদিকে আঁকার হাত অপরদিকে রসায়ণ, দুটিকেই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন স্বাধীনতার বিপ্লবে।
অরবিন্দ ঘোষের গুপ্ত সমিতিতে হেমচন্দ্র কানুনগোর যোগদান
হেমচন্দ্র ১৯০২ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সংস্পর্শে আসেন এবং তার মাধ্যমেই অরবিন্দ ঘোষ-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইংরেজবিদ্বেষ বশত ইংরেজ তাড়ানোর উদ্দেশ্যে অরবিন্দ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কিছু লাট-বেলাটকে হত্যার জন্য যে গুপ্তসমিতি গঠন করেছিলেন, হেমচন্দ্র তাতে যোগ দিয়েছিলেন।
বোমা কারখানার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হেমচন্দ্র কানুনগো
তিনি কলকাতার নিকটে মুরারিপুকুরে অনুশীলন সমিতির এক বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করেন। সেই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো, অরবিন্দ ঘোষ এবং তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।
হেমচন্দ্র কানুনগোর তৈরি তিনটি বোমা
মুরারিপুকুরে তার তৈরি তিনটি বোমার প্রথমটি ফরাসি চন্দননগরের মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় কিন্তু মেয়র অল্পের জন্য বেঁচে যান। দ্বিতীয়টি বইয়ের আকারের এবং তাতে স্প্রিং লাগানো ছিল। যথা সময়ে বই না খোলাতে কিংসফোর্ড বেঁচে যান। তৃতীয় বোমাটি ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী মুজাফফরপুরে ব্যবহার করেছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর উপলব্ধি
বারীণ ঘোষের বাংলা ও আসামে নানাস্থানে অপরিণত পরিকল্পনা প্রসূত ব্যর্থ অভিযানের সঙ্গে যুক্ত এই নায়ক অনুধাবন করলেন যে, যথার্থ বিপ্লবের জন্য যে সংগঠন আর হাতিয়ার দরকার তা তাঁদের নেই। এমনকি, এই অভাব বোধটুকুও নেতা উপনেতার কারোর নেই।
বিশ্ব সোশালিস্ট কংগ্রেসের অধিবেশনে হেমচন্দ্র কানুনগোর যোগদান
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে বিশ্ব সোশালিস্ট কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয় তাতে মাদাম ভিকাজি কামার সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর ইংল্যান্ড গমন
উপযুক্ত বোমা তৈরি, বাস্তব বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য তিনি বিদেশযাত্রা করেছিলেন। ইংল্যান্ড-এ কিছুকাল কাটিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন যে পরিবেশ মোটেই অনুকূলে নেই। তখনকার প্রবাসী ভারতীয়রাও বিশ্বাস করতে পারতেন না যে, ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা সম্ভব।
প্রথম ভারতীয় হিসেবে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গমন
সম্ভবত তিনিই প্রথম বিপ্লবী ছিলেন যিনি ভারত থেকে সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তিনি ফ্রান্স সাম্রাজ্য-এর প্যারিস থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর বোমা তৈরির ফর্মুলা শিক্ষা লাভ
অবশেষে একজন বিদেশী বিপ্লবীর পরামর্শে তিনি ফ্রান্সে যাওয়া স্থির করলেন। হেমচন্দ্র প্যারিসে নানাভাবে প্রচেষ্টার ফলে আসল বিপ্লবীদের গুপ্তসমীতির সদস্য হতে পেরেছিলেন এবং শক্তিশালী বোমা তৈরির ফর্মুলা শিখেছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগো কর্তৃক ভারতের বিপ্লবীদের বোমা তৈরির শিক্ষা প্রদান
যথাযোগ্য শিক্ষাগ্রহণের পর দেশে ফিরে কোমর বেঁধে দেশের কাজে ব্রতী হন। সেই শিক্ষা তিনি দেশের বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগো কর্তৃক বোমা তৈরির শিবির গঠন
বিদেশ থেকে বোমা তৈরি শিখে এসে তিনি কলকাতা ও চন্দননগরে বোমা তৈরির শিবির করেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর দ্বীপান্তর
আলিপুর বোমা মামলার অন্যতম রূপকার এই হেমচন্দ্র কানুনগোই। তাঁর শিষ্য ক্ষুদিরাম বসুর হাতেও বোমা তুলে দিয়েছিলেন। আলিপুর বোমা মামলায় তাঁর দ্বীপান্তর হয়।
হেমচন্দ্র কানুনগো কর্তৃক ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় পতাকার স্কেচ তৈরি
- (১) তিনিই বিপ্লবী ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় পতাকার স্কেচ তৈরি করেন বিদেশের মাটি থেকে। সময়টা ১৯০৭ সাল। জার্মানির স্টুয়ার্টগার্টে সেই পতাকা তুলে ধরেছিলেন ভিকাজী রুস্তম মাদাম কামা, একজন ভারতপ্রেমী স্বাধীনতা সংগ্রামী পার্সি মহিলা।
- (২) কথিত আছে যে, হেমচন্দ্র চিত্রশিল্পী ছিলেন বলে মাদাম কামার অনুরোধে লাল, গেরুয়া ও সবুজ রঙের তেরঙ্গা পতাকা তৈরি করেন এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্ট প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মেলনে মাদাম কামা সেই পতাকা উত্তোলন করে সারা বিশ্বে নজর কাড়েন।
- (৩) পতাকার মধ্যেও ছিল বিভিন্ন বার্তা ও তথ্য। তবে বেঙ্কাইয়ার জাতীয় পতাকার রূপ দিয়ে পরিবর্তন করে মাঝে সাদা রঙে চরকার জায়গায় অশোক চক্র আঁকেন। তা গৃহীত হয় ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই।
হেমচন্দ্র কানুনগোর নির্বাসন পরবর্তী জীবন
কারাবাস শেষ করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেদিনীপুর ফিরে আসেন। কিছুদিন ছবি অঙ্কন করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। পরবর্তী জীবনে ভীষণ ‘সিনিক’ হয়ে উঠেন। এরপর তিনি কিছুকাল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দলের সংগে কাজ করার চেষ্টা করেন।
হেমচন্দ্র কানুনগো রচিত গ্ৰন্থ
১৯২৮ সালে তার বই ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলার প্রথম সশস্ত্র রাজনৈতিক বিপ্লব-প্রচেষ্টার ইতিহাস নিরপেক্ষ বিশ্লেষণসহ তিনি এই পুস্তকে বিবৃত করেছেন। এছাড়াও তার রচিত ‘অনাগত সুদিনের তরে’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য
হেমচন্দ্র কানুনগোর শেষ জীবন
১৯২০ সালে দীর্ঘ ১১ বছর পর আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে রাধানগর গ্রামে নিজের তৈরি বাড়িতেই শেষ জীবন অতিবাহিত করেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর মৃত্যু
১৯৫১ সালে ভারতমায়ের এই কৃতি সন্তানের মৃত্যু হয়।
উপেক্ষিত হেমচন্দ্র কানুনগো
ত্রিবর্ন রঞ্জিত পতাকা, গেরুয়া, সাদা, সবুজ। ভারতের জাতীয় পতাকা। কিন্তু এই ত্রিবর্ণ পতাকার প্রথম রূপ দিয়েছিলেন এক বাঙালি। কে মনে রেখেছেন হেমচন্দ্র কানুনগো কে? কেউ না। কেউ জানলই না মানুষটাকে। তাই হেমচন্দ্র থেকে যান উপেক্ষিতই।
উপসংহার :- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
(FAQ) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমচন্দ্র কানুনগো সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হেমচন্দ্র কানুনগো।
হেমচন্দ্র কানুনগো।
৪ আগস্ট ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে।
৮ এপ্রিল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।