পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অবস্থান, আসন সংখ্যা, মেয়াদ, সদস্য, নাম, গঠন, প্রথম অধিবেশন, সদস্যদের যোগ্যতা, নির্বাচন পদ্ধতি, আসন সংরক্ষণ, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে জানবো।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা
ধরণ | এককক্ষীয় |
আসন সংখ্যা | ২৯৫ |
মেয়াদসীমা | ৫ বছর |
অধ্যক্ষ | বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (৮ মে ২০২১ থেকে) |
ভূমিকা :- পশ্চিমবঙ্গের এককক্ষ বিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার নাম বিধানসভা। বর্তমানে অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বিবাদীবাগ এলাকায় হাইকোর্ট -এর দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনটি অবস্থিত।
বিধায়ক
বিধানসভার সদস্যদের বলা হয় বিধায়ক। তাঁরা পাঁচ বছরের মেয়াদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
আসন সংখ্যা
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মোট আসনসংখ্যা ২৯৫। এর মধ্যে ২৯৪টি আসনের বিধায়করা এক-আসনবিশিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন। এক জন সদস্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় থেকে সরাসরি নির্বাচিত হন।
মেয়াদ
সাধারণ ভাবে বিধানসভার মেয়াদ পাঁচ বছরের। তবে তার আগেই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যায়।
আইনসভা প্রতিষ্ঠা
১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন দ্বারা ১৮৬২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল ব্রিটিশ বঙ্গপ্রদেশে একটি বারো সদস্যবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠা করেন।
সদস্য
এই আইনসভার সদস্য ছিলেন বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর এবং কয়েকজন মনোনীত সদস্য। কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
নাম
প্রথম দিকে এই আইনসভাটিকে বেঙ্গল কাউন্সিল, লেফটেনান্ট গভর্নরের কাউন্সিল, বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি ইত্যাদি নামে ডাকা হত।
ছোটোলাটের দরবার সভা
প্রথম দিকে এই কাউন্সিলের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ছিল সীমাবদ্ধ। তাই সঠিক ভাবেই এই সভাকে ছোটলাটের দরবার সভা বলে অভিহিত করা হত।
কাউন্সিলের প্রভাব বৃদ্ধি
১৮৯২ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা কাউন্সিলের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা বেড়ে হয় ২০। এঁদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন নির্বাচিত।
১৯০৯ সালের আইন
১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের মাধ্যমে সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৫৩ করা হয়।
১৯১৯ সালের আইন
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১৩৯ করা হয়। এই আইন বলেই স্থাপিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল।
উদ্বোধন
১৯২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ডিউক অফ কনট আনুষ্ঠানিকভাবে এই সভার উদ্বোধন করেছিলেন।
১৯৩৫ সালের আইন
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভাকে দুটি কক্ষে বিভক্ত করা হয়। – লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ও লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি।
- (১) ২৫০ সদস্যবিশিষ্ট অ্যাসেম্বলির মেয়াদ ছিল সর্বাধিক পাঁচ বছর।
- (২) কাউন্সিল ছিল একটি স্থায়ী সংস্থা। এই সংস্থায় সদস্যসংখ্যা ৬৩ জনের কম ও ৬৫ জনের বেশি হত না।
- (৩) প্রতি তিন বছর অন্তর সভার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর নিতেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা গঠন
১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট ব্রিটিশ বঙ্গপ্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ৯০ টি কেন্দ্রের বিধায়ক ও দুজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সদস্য নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা।
প্রথম অধিবেশন
১৯৪৭ সালের ২১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম অধিবেশন বসে। এই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়, জ্যোতি বসু প্রমুখ।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট বিধানসভা
ভারতীয় সংবিধান -এ পশ্চিমবঙ্গের দ্বিকক্ষীয় বিধানসভা অনুমোদিত হয়। ১৯৫২ সালে ৫ জুন ৫১ সদস্যবিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদ গঠিত হয়।
সদস্য সংখ্যা
দুই জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সদস্য নিয়ে বিধানসভার সদস্য সংখ্যা হয় ২৪০। ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৫২ সালের ১৮ জুন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম অধিবেশন বসে।
বিধান পরিষদ অবলুপ্ত
২১ মার্চ ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধান পরিষদ অবলুপ্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়।এরপর ভারতীয় সংসদে পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদ (অবলুপ্তি) আইন পাস হয়। ১ আগস্ট ১৯৬৯ সালে বিধান পরিষদ অবলুপ্ত হয়।
বিধানসভার সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি
- (১) ১৭০ (১) নং ধারা অনুসারে কোনাে বিধানসভার সদস্য সংখ্যা ৫০০ -র বেশি বা ৬০ -এর কম হবে না। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা হল ২৯৪ জন।
- (২) সংবিধান অনুসারে বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিটি রাজ্যকে কতকগুলি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়, যা ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ভােটদাতাকে নিয়ে গঠিত হয়।
- (৩) প্রত্যেক কেন্দ্র থেকে ১ জন করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। বিধানসভায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব না থাকলে রাজ্যপাল অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য থেকে ইঙ্গ- ভারতীয় সম্প্রদায়ের একজন করে প্রতিনিধি মনােনীত করতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৩৩৩)।
বিধানসভার সদস্যদের যােগ্যতা
পশ্চিমবঙ্গ-সহ যে কোনাে রাজ্যের বিধানসভার সদস্য হতে গেলে নিম্নলিখিত যােগ্যতা থাকা দরকার। –
- (১) ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
- (২) কমপক্ষে ২৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।
- (৩) কোনো সরকারি লাভজনক পদে নিযুক্ত থাকা চলবে না।
- (৪) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া বা বিকৃত মস্তিষ্ক ঘােষিত ব্যক্তি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না।
- (৫) একইসঙ্গে বিধানসভা ও পার্লামেন্টের (সংসদ) সদস্য থাকা চলবে না।
বিধানসভার সদস্যদের আসন সংরক্ষণ
২০০৯ সালে ৯৫ তম সংবিধান-সংশোধনের মাধ্যমে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিধানসভা নির্বাচনে তপশিলি জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ
সংবিধানের ১৭৮ নং ধারা অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্য বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ (স্পিকার) এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ (ডেপুটি স্পিকার) হিসেবে নির্বাচন করে থাকেন।
বিধানসভার সদস্যদের কার্যকাল
বিধানসভার সদস্যদের সাধারণ কার্যকালের স্থিতিকাল ৫ বছর হলেও তার আগেই রাজ্যপাল বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন।
সদস্যদের বেতন ও ভাতা
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি আইনের মাধ্যমে স্থির করা হয় বিধানসভার সদস্যদের মাসিক বেতন বর্তমানে ১৭৫০০ টাকা করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সযােগসুবিধাও তারা ভােগ করে থাকেন।
বিধানসভার অধিবেশন
পশ্চিমবঙ্গ সহ সব রাজ্যের রাজ্যপাল রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করতে বা স্থগিত রাখতে পারেন। বছরে অন্তত দু-বার বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। একটি অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের সূচনার মধ্যে ৬ মাসের কম ব্যবধান থাকতে হবে।
বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
প্রতিটি বিধানসভাকে নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। –
(১) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা
বিধানসভার প্রথম ও প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা। সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী রাজ্য তালিকাভুক্ত যে-কোনাে বিষয়ে বিধানসভা আইন প্রণয়নে এককভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকারী।
(২) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাজ্য বিধানসভা হল রাজ্যের অর্থ সম্পদের অতন্দ্র প্রহরী। তাই রাজ্য বিধানসভার সম্মতি ব্যতীত সরকারের আয় ব্যয় সংক্রান্ত কোনাে প্রস্তাব কার্যকরী হতে পারে না।
(৩) শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ক্ষমতা
সংবিধান অনুযায়ী সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য রাজ্য মন্ত্রিসভা বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব বিধানসভার উপর নির্ভরশীল।
(৪) সংবিধান-সংশোধন বিলের অনুমােদন সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাজ্য বিধানসভা সংবিধান-সংশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
(৫) সংবাদ ও তথ্য প্রদান সংক্রান্ত ক্ষমতা
জনসাধারণকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে সংবাদ ও তথ্য প্রদান সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে বিধানসভা কাজ করে থাকে।
(৬) নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন (ভারতের রাষ্ট্রপতি )-এর জন্য গঠিত নির্বাচক সংস্থায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা অংশগ্রহণ করতে পারে। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যসভার সদস্যগণকে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযােগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে থাকে।
উপসংহার :- ভারতবর্ষের রাজ্য-রাজনীতিতে বিধানসভা একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য আইনসভা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কক্ষ রূপে পরিচিত বিধানসভার স্বতন্ত্র গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিদ্যমান।
(FAQ) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বিধানসভা ভারতের রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ (দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ক্ষেত্রে) বা একমাত্র কক্ষ (এক কক্ষীয় আইনসভার ক্ষেত্রে)।
২৯৫ টি।
পাঁচ বছর।
২৫ বছর।
বিধায়ক।