সাতবাহন যুগের বাণিজ্য

সাতবাহন যুগের বাণিজ্য প্রসঙ্গে বাণিজ্য ও উপনিবেশ , সামন্ত শ্রেণির আধিপত্য হ্রাস, বাণিজ্য কেন্দ্র, অন্তর্বাণিজ্য বৃদ্ধি, বহির্বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার, শক-সাতবাহন বাণিজ্য, ভারত-গ্ৰিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্য সম্পর্কে জানবো।

সাতবাহন যুগের বাণিজ্য

ঐতিহাসিক ঘটনাসাতবাহন যুগের বাণিজ্য
সাম্রাজ্যসাতবাহন সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাসিমুক
শ্রেষ্ঠ রাজাগৌতমীপুত্র সাতকর্ণী
শেষ রাজাযজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী
সাতবাহন যুগের বাণিজ্য

ভূমিকা :- সাতবাহন যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পশ্চাতে এক দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার এই চারটি প্রকরণের মাধ্যমে সাতবাহন অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল।

সাতবাহন যুগের বাণিজ্য ও উপনিবেশ

(১) শিল্প বিস্তারের পাশাপাশি বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার ঘটে। বাণিজ্য এক শ্রেণীর লোকের প্রধান জীবিকা বলে গণিত হয়। বণিকরা সমাজে বিশেষ প্রাধান্য পায়। শিল্পী, কারিগরদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল ছিল যে, অনেক সময় তারা স্তূপ বা বিহার নির্মাণ করে তা উৎসর্গ করে।

সাতবাহন যুগে সামন্ত শ্রেণির আধিপত্য হ্রাস

এই যুগে সামন্তশ্রেণী সমাজে তাদের একাধিপত্য হারায়। কারণ, সাতবাহন সমাজে বহু নগর গড়ে ওঠে। নগরবাসী ও বণিকরা তাদের স্বচ্ছলতার দরুন সামন্তশ্রেণীর গুরুত্বকে খর্ব করে দেয়। বাৎসায়ণের রচনায় তার প্রতিফলন দেখা যায়। মধ্যযুগের ইউরোপ -এ নগর বিপ্লবের ফলে যে রকম নগরবাসীদের প্রাধান্য বেড়েছিল। অনেকটা সেই রকম ঘটনা সাতবাহন যুগে ঘটে।

সাতবাহন যুগে বাণিজ্য কেন্দ্র

(১) সাতবাহন যুগে অন্তর্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে মালবের উজ্জয়িনী, অন্ধ্রের ধান্যকটক, পশ্চিম অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান, নাসিক বা গোবর্ধন, মহীশূরের বা কন্নড়ের বনবাসি, টগর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ছিল। এছাড়া ছিল নতুন শহর বেনাকটক প্রভৃতি।

সাতবাহন যুগে অন্তর্বাণিজ্য বৃদ্ধি

ভারতের সাতবাহন যুগে শহরগুলি বিভিন্ন রাস্তা দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। দাক্ষিণাত্যে আগে যে বিরাট অনাবাদী অরণ্য অঞ্চল ছিল শক-সাতবাহন যুগে তার পরিবর্তে গ্রাম ও শহর গড়ে ওঠে এবং অন্তর্বাণিজ্য খুবই বৃদ্ধি পায়।

সাতবাহন যুগে বহির্বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার

প্রাচীন সাতবাহন যুগে বহির্বাণিজ্যের ও উপনিবেশ বিস্তারের পশ্চাতে কয়েকটি কারণ ছিল। যেমন –

  • প্রথমত, সাতবাহন সাম্রাজ্যের শান্তি ও সংহতির ফলে এই বাণিজ্যের আগ্রহ দেখা দেয়।
  • দ্বিতীয়ত, দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগে কৃষ্ণা-গোদাবরী উপত্যকায় সাতবাহন শক্তির বিস্তারের ফলে এই বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • তৃতীয়ত, আর্য সংস্কৃতির প্রচার এবং উপনিবেশ স্থাপনের আগ্রহ বাণিজ্যের অন্যতম কারণ ছিল।
  • চতুর্থত, যাবতীয় বিলাস দ্রব্য যথা মশলা, চন্দন কাঠ, কর্পূর প্রভৃতি এত প্রচুর উৎপাদন হত যে তা রোমে রপ্তানি করে রোম থেকে সোনা আমদানীর আগ্রহ দেখা দেয়।

সাতবাহন যুগে বাণিজ্যকেন্দ্র ভৃগুকচ্ছ

প্রাচীন সাতবাহন যুগের প্রধান বাণিজ্য চলত উপকূলের বন্দর থেকে। পশ্চিম উপকূলের প্রধান বন্দর ছিল ভৃগুকচ্ছ বা ভারুচ বা ব্রোচ। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে সাতবাহন যুগে এই বন্দর থেকে সাতবাহন দূত রোমান সম্রাট অগাষ্টাসের সভায় গিয়েছিল বলে জানা যায়।

শক সাতবাহন বাণিজ্য

এই সময় শক সাতবাহন বাণিজ্য ভারুচ বন্দর থেকে সমুদ্র পথে আরব সমুদ্র, লোহিত সাগর হয়ে, আলেকজান্দ্রিয়া তথা রোম সাম্রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র পর্যন্ত চলত।

মৌসুমি বায়ুর গতিপথ আবিষ্কার

আলোচ্য কালে মৌসুমী বায়ুর গতিপথ ৪৫ অব্দে হিপপলাস নামে এক গ্রীক নাবিক আবিষ্কার করেন। মৌসুমী বায়ুতে পাল খাটিয়ে রোমান জাহাজগুলি গভীর সমুদ্র দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে ভারুচ ও সোপর্ক বন্দরে চলে আসত।

ভারত-গ্ৰিক বাণিজ্য বৃদ্ধি

আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণ -এর পর পারস্যের বিরাট সোনা ও রূপার সম্পদ গ্রীক জগতে ছড়িয়ে পড়লে ভারত -এর সঙ্গে গ্রীক বাণিজ্য বাড়ে। ক্রমে গ্রিস -এর পর রোমানরাও এই বাণিজ্যে আগ্রহী হয়।

সাতবাহন যুগে রোমের বাণিজ্য দ্রব্যের নিদর্শন

প্লিনি বলেছেন যে, রোম -এর স্বর্ণমুদ্রার বেশীর ভাগ ভারতে চলে আসতে থাকে। নাসিক, কার্লে, কানহেরির লিপিতে এই বাণিজ্যের সংবাদ পাওয়া যায়। কোলাপুর ও পণ্ডিচেরীতে রোমের বাণিজ্যদ্রব্যের নিদর্শনও পাওয়া যায়।

সাতবাহন যুগে সোপারা ও কল্যাণ বন্দর

এই সময় সুপর্ক বা সোপারা এবং কল্যাণ বন্দর ছিল মহারাষ্ট্রের বন্দর। এই বন্দরগুলি অর্ন্তবন্দর নাসিক, পৈঠান প্রভৃতির সঙ্গে রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত ছিল। এর দক্ষিণে মালাবার উপকূলে লিমরিক (Lymrika) ছিল অপর বন্দর।

সাতবাহন যুগে আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্য

মৌসুমী বায়ুর গতিপথ আবিষ্কৃত হলে এই বায়ুর গতিতে পাল খাটিয়ে জাহাজগুলি সহজে আরব সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পশ্চিম উপকূলের বন্দরে আসত। রান্নার মশলা, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত, রেশম, সরু চাল, সুগন্ধি মশলা, কর্পূর প্রভৃতি রোমান সাম্রাজ্যে রপ্তানি হত আর তার বিনিময়ে আসত সোনা।

সাতবাহন যুগে বৌদ্ধ বিহার গুলির বাণিজ্যে উৎসাহ

এই সময় সোপারা ও কল্যাণ থেকে দেশের ভেতর যে বাণিজ্য পথ প্রসারিত ছিল তার ধারেই তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধ বিহার, স্তূপ ও গুহাগুলি। এর অনেকগুলি বণিকদের বা ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্যে তৈরি হয়েছিল। এই বিহারগুলি সম্ভবত বাণিজ্যে উৎসাহ দিত, অনেক সময় অর্থ বিনিয়োগ করত।

সাতবাহন যুগে পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য

(১) পূর্ব উপকূলেও বাণিজ্য বন্দর ছিল যা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য চলত ও উপনিবেশ বিস্তার করা হত। বাংলার তাম্রলিপ্ত থেকে করমণ্ডল উপকূল ধরে বিভিন্ন বন্দর স্থাপিত হয়েছিল। পেরিপ্লাসের ভ্রমণ কাহিনী ও টলেমীর ভূগোলে এর বর্ণনা পাওয়া যায়।

সাতবাহন যুগে সুমাত্রা ও জাভার মশলা আমদানি

কাবেরীপত্তনম থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের লোকেরা এই বাণিজ্যে অংশ নিত। রোমান সাম্রাজ্যে মশলা সরবরাহের জন্য পূর্ব উপকূলের বণিকরা সুমাত্রা ও জাভার মশলা আমদানী করত।

সাতবাহন যুগে হিন্দু সংস্কৃতির বিস্তার

আর্য বা হিন্দু সংস্কৃতির বিস্তারের জন্যও পূর্ব উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপিত হয়। সাতবাহন সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য ও উপনিবেশের বিস্তার ঘটে।

উপসংহার :- টলেমির রচনা থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে দাক্ষিণাত্যে ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য চলত। জাভা, মালয়, ইন্দোচীন প্রভৃতি অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের পূর্ব উপকূলের বাণিজ্যের কথা টলেমি বলেছেন।

(FAQ) সাতবাহন যুগের বাণিজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সাতবাহন যুগের দুটি বন্দরের নাম লেখ।

কল্যাণ, সোপারা, ভৃগুকচ্ছ, তাম্রলিপ্ত।

২. পুরাণে সাতবাহনদের কি বলা হয়েছে?

অন্ধ্র।

৩. সাতবাহন রাজ্য কে প্রতিষ্ঠা করেন?

সিমুক।

৪. সাতবাহন রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কে?

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী।

৫. সাতবাহন রাজ্যের শেষ রাজা কে?

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী।

Leave a Comment