১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত ত্রিশক্তি মৈত্রী বা Triple Alliance প্রসঙ্গে পটভূমি হিসেবে ফ্রান্সের প্রতি ইতালির আনুগত্য, রাশিয়া সম্পর্কে বিসমার্কের সন্দেহ, ইতালি ও ফ্রান্সের বিবাদ, বিসমার্কের উদ্দেশ্য, ইতালির মিত্র সন্ধান, ত্রিশক্তি মৈত্রী স্থাপন, ত্রিশক্তি মৈত্রীর শর্ত, রূপকার, নতুন মৈত্রী ব্যবস্থা, স্থায়ীত্ব ও বিশেষত্ব, গুরুত্ব হিসেবে বিসমার্কের কূটনৈতিক সাফল্য, মিত্রহীন ফ্রান্স, রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র বার্লিন, বিসমার্কের সাফল্য, ত্রিশক্তি মৈত্রীর সম্প্রসারণ, ত্রুটি হিসেবে জার্মানির সমস্যা, ইতালির আনুগত্য সন্দেহাতীত ও ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতি ব্যর্থ সম্পর্কে জানবো।
ত্রিশক্তি মৈত্রী
ঐতিহাসিক ঘটনা | ত্রিশক্তি মৈত্রী |
সময়কাল | ২০ মে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ |
স্বাক্ষরকারী | জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি |
উদ্যোক্তা | বিসমার্ক |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা:- রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের পর বিসমার্ক ইতালিকে দলে টানতে সচেষ্ট হন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০ মে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিশক্তি মৈত্রী স্থাপিত হয়।
ত্রিশক্তি মৈত্রীর পটভূমি
ত্রিশক্তি মৈত্রী স্থাপনের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ। –
(১) ফ্রান্সের প্রতি ইতালির আনুগত্য
ইতালি তার ঐক্যের জন্য ফ্রান্স -এর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। ইতালীয় গণতন্ত্র ও আদর্শগত দিক থেকে ফ্রান্সের প্রতি অনুগত ছিল।
(২) রাশিয়া সম্পর্কে বিসমার্কের সন্দেহ
কুটকৌশলী বিসমার্ক ইতালিকে ফ্রান্স থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট হন। তিন সম্রাটের লিগ প্রতিষ্ঠিত হলেও রাশিয়া সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন।
(৩) ইতালি ও ফ্রান্সের বিবাদ
এই সময় উত্তর আফ্রিকার টিউনিস উপনিবেশের দখল নিয়ে ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে বিবাদ চলছিল। বিসমার্ক টিউনিস দখলের জন্য ফ্রান্সকে গোপনে উৎসাহ দেন।
(৪) বিসমার্কের উদ্দেশ্য
আসলে বিসমার্কের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ থেকে ফ্রান্সের দৃষ্টি ঔপনিবেশিকতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, যার ফলে অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
(৫) ইতালির মিত্র সন্ধান
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স টিউনিস দখল করলে ইতালি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মিত্রের সন্ধান করতে থাকে। ইংল্যান্ড মিত্র হতে পারত, কিন্তু উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড নিজেই ছিল ইতালির প্রতিদ্বন্দ্বী।
ত্রিশক্তি মৈত্রী
এই অবস্থায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের সূচনায় ইতালি নিজেই জার্মানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মে ভিয়েনা শহরে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালির মধ্যে ত্রিশক্তি মৈত্রী বা Triple Alliance সম্পন্ন হয়।
ত্রিশক্তি মৈত্রীর রূপকার
- (১) সাধারণভাবে বিসমার্ককেই ত্রিশক্তি মৈত্রী-র রূপকার বলে মনে করা হয়। কারণ, তিনিই প্রথম জোটবাঁধার নীতি অনুসরণ করেন। বলা বাহুল্য, এই মত সর্বাংশে সত্য নয়। তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির নিরাপত্তা বিধান এবং এই ব্যাপারে তিনি প্রধানত অস্ট্রিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিলেন।
- (২) ইতালির উপর তাঁর কোনও আস্থা ছিল না এবং তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতেও তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। ইতালিই জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে উদ্যোগ নেয়। ঐতিহাসিক এস বি ফে তাই বলেন যে, “বিসমার্ক নয়, ইতালির উদ্যোগেই ত্রিশক্তি মৈত্রী-র জন্ম হয়েছে।”
ত্রিশক্তি মৈত্রীর শর্তাবলী
ত্রিশক্তি মৈত্রীর শর্তানুসারে স্থির হয় যে,
- (১) যদি ফ্রান্স ইতালিকে আক্রমণ করে, তবে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া একযোগে ইতালির পক্ষ নেবে।
- (২) যদি ফ্রান্স জার্মানিকে আক্রমণ করে তবে ইতালি জার্মানির পক্ষ নেবে।
- (৩) যদি একাধিক শক্তি কোনও মিত্রকে আক্রমণ করে, তবে তিন মিত্র একত্রে যুদ্ধ করবে।
- (৪) অস্ট্রিয়া ও জার্মানির মধ্যে কোনও বিবাদে ইতালি নিরপেক্ষ থাকবে।
- (৫) পৃথকভাবে ঘোষণা করা হয় যে, এই চুক্তি কোনোভাবেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নয়।
নতুন মৈত্রী ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক জন লো বলেন যে, এই ত্রিশক্তি মৈত্রী কোনোভাবেই ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত দ্বিশক্তি চুক্তি-র সম্প্রসারণ নয়। এটি একটি নতুন মৈত্রী-ব্যবস্থা।
স্থায়ীত্ব ও বিশেষত্ব
এই চুক্তি আপাতত পাঁচ বছরের জন্য স্বাক্ষরিত হয় এবং এর শর্তগুলি গোপন রাখা হয়।
ত্রিশক্তি মৈত্রীর গুরুত্ব
ইউরোপের ইতিহাসে ত্রিশক্তি মৈত্রীর গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –
(১) বিসমার্কের কূটনৈতিক সাফল্য
ত্রিশক্তি মৈত্রী ছিল বিসমার্কের কূটনৈতিক দক্ষতার চূড়ান্ত প্রকাশ। অধ্যাপক সীম্যান-এর মতে, এই চুক্তি ছিল সারা ইউরোপ জুড়ে বিসমার্কের কূটনৈতিক সাফল্য ও প্রভাবের চূড়ান্ত প্রতীক।
(২) মিত্রহীন ফ্রান্স
ত্রিশক্তি মৈত্রীর ফলে ফ্রান্স ইউরোপে সম্পূর্ণভাবে মিত্রহীন হয়ে পড়ে।
(৩) রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র বার্লিন
ইউরোপের উপর বিসমার্কের আধিপত্য প্রায় সম্পূর্ণ হয়। তিনি হয়ে ওঠেন ইউরোপের ভাগ্যবিধাতা এবং বার্লিন পরিণত হয় ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে।
(৪) বিসমার্কের সাফল্য
তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘তিন সম্রাটের চুক্তি‘ এবং ‘তিন সম্রাটের লিগ‘। ইংল্যান্ডের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এমনকী ফ্রান্সও অখুশি ছিল না। সেদিক থেকে তিনি অবশ্যই সফল ছিলেন।
ত্রিশক্তি মৈত্রীর সম্প্রসারণ
বিসমার্ক এই চুক্তিকে আরও সম্প্রসারিত করেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে রুমানিয়া ও তুরস্ক এই চুক্তিতে যোগ দেয়। তুরস্ক ও ইতালির স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী হলেও তুরস্ক এই চুক্তিতে যোগ দেয়, কারণ এতে ইতালির অন্তর্ভুক্তির কথা গোপন করা হয়েছিল।
ত্রিশক্তি মৈত্রীর ত্রুটি
এই চুক্তি একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। যেমন –
(১) জার্মানির সমস্যা
এই চুক্তির দ্বারা জার্মানি নিজ ভাগ্যকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। সমস্যা-সঙ্কুল দেশ অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জার্মানির কোনও উপকার হয় নি। বরং অস্ট্রিয়ার স্বার্থে জার্মানি ইউরোপের নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে এবং তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়।
(২) ইতালির আনুগত্য সন্দেহাতীত
ইতালি ছিল একটি সমস্যা-সঙ্কুল দুর্বল দেশ। ইতালির সঙ্গে মিত্রতা করে শক্তিজোটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় নি। তাছাড়া, এই জোটের প্রতি ইতালির আনুগত্য সন্দেহাতীত ছিল না। এই কারণেই ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার পক্ষে অবতীর্ণ না হয়ে ত্রিশক্তি আঁতাত-এ যোগদান করে।
(৩) ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতি ব্যর্থ
ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতিও শেষ পর্যন্ত সফল হয় নি এবং এর দ্বারা জার্মানির কোনও লাভ হয় নি।
উপসংহার:- ত্রিশক্তি মৈত্রী ছিল একটি রক্ষণাত্মক চুক্তি এবং ইউরোপে শান্তি বজায় রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হয় নি। কারণ, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
(FAQ) ত্রিশক্তি মৈত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
২০ মে, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ।
জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি।
বিসমার্ক।