সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি

গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য, রাষ্ট্রীয় ঐক্য, ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার প্রসার, রাজ চক্রবর্তীর আদর্শ, অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবো।

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি

ঐতিহাসিক ঘটনাসমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি
সাম্রাজ্যগুপ্ত সাম্রাজ্য
রাজাসমুদ্রগুপ্ত
পূর্বসূরিপ্রথম চন্দ্রগুপ্ত
উত্তরসূরিদ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
উপাধিভারত -এর নেপোলিয়ন
সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি

ভূমিকা :- সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়-এর বিবরণ আলোচনা করলে জানা যাবে যে, তিনি নিসন্দেহে একজন সমরবিশারদ ও প্রতিভাবান সেনাপতি ছিলেন।

সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিতর্ক

গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় শুধুমাত্র রাজ্যজয়ের জন্যই, ব্যক্তিগত পরাক্রম স্থাপনের জন্য করা হয় নাকি এর পিছনে কোনো উদ্দেশ্য নিহিত ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতেরা বিতর্ক করেছেন।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য

ঐতিহাসিক স্মিথের মতে, সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদী। সিংহাসনে বসার সময় থেকেই তিনি আগ্রাসী উচ্চাকাঙ্খার অনুবর্তী হয়ে তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে গ্রাস করার সঙ্কল্প নেন। “তিনি এই নীতি নিতে ইতস্তত করেননি যে, রাজ্য অধিগ্রহণ করা হল রাজার কর্তব্য কাজ।” স্মিথ এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সমুদ্রগুপ্তকে “ভারতীয় নেপোলিয়ন” আখ্যা দিয়েছেন। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন স্মিথের ব্যাখ্যা অনুসারে এক সাধারণ বিজেতামাত্র।

সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ঐক্য

  • (১) ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয় নীতির এই ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করেন। ডঃ রায়চৌধুরী প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে, আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত এই ভারতভূমিকে এক শাসনে আবদ্ধ করাই ছিল সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ্য।
  • (২) ধর্মশাস্ত্রে রাজচক্রবর্তীর যে আদর্শের কথা বলা হয়েছে, যথা এক রাজছত্রের অধীনে ভারতের ঐক্য স্থাপন, সমুদ্রগুপ্ত তার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি এই লক্ষ্য পুরণে অনেকটা অগ্রসর হন এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ যারা তার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ্য ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার প্রসার

  • (১) অনেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ্য করেছেন। রোমিলা থাপারের মতে, বর্ণ বা জাতিভেদ অধ্যুসিত ব্রাহ্মণ্য সত্যতা যার কেন্দ্র ছিল গাঙ্গেয় উপত্যাকা তা সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের মাধ্যমে ভারতের অন্য অঞ্চলে আধিপত্য লাভ করে।
  • (২) প্রজাতান্ত্রিক উপজাতি বা গণরাজ্যগুলিকে ধ্বংস বা বশীভূত করে গুপ্ত সম্রাট ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে দেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছিল তিনি তাকে তার সাম্রাজ্যের মাধ্যমে চূর্ণ করে ব্রাহ্মণ্য সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠ করেন।

সমুদ্রগুপ্তের রাজচক্রবর্তী আদর্শ

  • (১) জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, সমুদ্রগুপ্ত প্রকৃতপক্ষে বিজিত রাজ্যের অধিকাংশ স্থান ফিরিয়ে দেন। তিনি ছিলেন ধর্মবিজয়ী। তাঁর নীতি ছিল গ্রহণ পরিমোক্ষ। সুতরাং তাকে সাম্রাজ্যবাদী বা আগ্রাসী বলা চলে না। তার রাজ্য জয়ের পশ্চাতে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্য নিশ্চিত ছিল।
  • (২) সমালোচকরা বলেন যে, সমুদ্রগুপ্ত শুধু বিজেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিজ্ঞ। সুদূর দক্ষিণ বা উত্তরের দূরবর্তী স্থানগুলিকে পাটলিপুত্র থেকে প্রত্যক্ষভাবে শাসন করার অসুবিধা তিনি উপলব্ধি করেন। এজন্য তিনি দক্ষিণে ধর্মবিজয় নীতি নেন।
  • (৩) পশ্চিমে মালব ও উত্তর-পশ্চিমের উপজাতি রাজাগুলিকেও তিনি সামন্ত রাজ্যে পরিণত করে ক্ষান্ত থাকেন। এর পশ্চাতে তার বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রে যে রাজচক্রবর্তীর আদর্শের কথা বলা হয়েছে তা বিজয়ের ও সাম্রাজ্যের মাধ্যমেই একমাত্র স্থাপিত হতে পারে। সমুদ্রগুপ্ত সম্ভবত সেই চেষ্টাই করেন।

সমুদ্রগুপ্তের অর্থনৈতিক লক্ষ্য

  • (১) সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পশ্চাতে অনেকে অর্থনৈতিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছেন। ডঃ গয়ালের মতে, দক্ষিণের অপরিমিত সম্পদ আহরণ করা ছিল সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্য অভিযানের লক্ষ্য। শক্তিশালী পল্লব রাজারা দক্ষিণে বাণিজ্যের মাধ্যমে যে সম্পদ জমা করেছিলেন সমুদ্রগুপ্ত তা অধিকার করেন।
  • (২) দক্ষিণে প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপন না করেও তিনি দক্ষিণের বশংবদ রাজাদের কাছ থেকে যে বিরাট কর পেতেন তার দ্বারা এক বিরাট সৈনাদল ও আড়ম্বরপূর্ণ দরবার গঠন করেন। গুপ্ত সম্রাটরা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার কৃষি-সম্পন্ন ও দক্ষিণের বাণিজ্য-সম্পদ ভোগ করে অপরিমিত শক্তিশালী হন। সেই অনুপাতে জনকল্যাণের জন্য তারা প্রভূত ব্যয় করেন কিনা তা সঠিক জানা যায়নি।
  • (৩) কারণ উদ্বৃত্ত উপসত্ব ভোগ করে গুপ্তযুগে একশ্রেণীর বাশানুক্রমিক কর্মচারী ও ব্রাহ্মণ লেখকের উদ্ভব হয়েছিল যারা গুপ্ত সম্রাটদের গুণ বর্ণনায় শতমুখ হয়েছেন। অশোক -এর মত জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে রাজস্ব ব্যয় তাঁরা করেন কিনা তা জানা যায়নি। কারণ, রোমিলা থাপারের মতে, গুপ্তযুগের সভ্যতা খুবই উঁচু দরের সন্দেহ নেই। কিন্তু তা ছিল অভিজাত শ্রেণী বা শাসকশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ঐতিহাসিক পরিস্থিতি

এসব সত্ত্বেও বলা প্রয়োজন যে, গুপ্ত সাম্রাজ্য একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে উদ্ভুত হয়েছিল। কুষাণ সাম্রাজ্য -এর পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয় গুপ্ত সাম্রাজ্য তা দূর করে।

উপসংহার :- ভারতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা। এখানে যে শক্তি প্রবল তারা মোটামুটি উত্তর ভারত নিয়ন্ত্রণ করে। এমন কি দক্ষিণ পর্যন্ত তাদের পরাক্রম ছাড়িয়ে যায়। ইতিহাসের এই নিয়মে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। সমুদ্রগুপ্তকে এজন্য সাম্রাজ্যবাদী বা আগ্রাসী চিহ্নিত করে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা উচিত নয়।

(FAQ) সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে?

সমুদ্রগুপ্ত।

২. ভারতের নেপোলিয়ন কাকে বলা হয়?

সমুদ্রগুপ্ত।

৩. দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্ত কি নীতি গ্রহণ করেন?

গ্ৰহণ পরিমোক্ষ নীতি।

৪. এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে কার কথা জানা যায়?

সমুদ্রগুপ্ত।

Leave a Comment