পানিপথের প্রথম যুদ্ধ -এর সময়কাল, অবস্থান, বিবাদমান পক্ষ, পটভূমি, যুদ্ধ পরিস্থিতি, বাবরের জয়লাভের কারণ, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
সময়কাল | ২১ এপ্রিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | পানিপথ, হরিয়ানা, ভারত |
বিবাদমান পক্ষ | ফরগানা অধিপতি বাবর ও লোদী বংশ |
ফলাফল | বাবরের বিজয় |
ভূমিকা :- বর্তমান ভারতের হরিয়ানায় অবস্থিত পানিপথের প্রান্তর উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থান থেকে শুরু করে শক্তিশালী মারাঠাদের পতন পর্যন্ত প্রায় তিনটি বড় যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এখনো ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বর হয়ে আছে পানিপথ প্রান্তর।
পানিপথ
ভারতের রাজধানী দিল্লীর উত্তরে অবস্থিত পানিপথ ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের একটি শহরের নাম। মহাভারত অনুযায়ী পানিপথ পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি শহরের মধ্যে অন্যতম। মহাভারতের ইতিহাস ছাপিয়ে পানিপথ মুখ্য হয়ে আছে মূলত পানিপথ প্রান্তরে ঘটে যাওয়া তিনটি বড় যুদ্ধের কারণে। এই যুদ্ধ গুলি পানিপথের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
পানিপথে তিনটি যুদ্ধ
পানিপথের প্রান্তরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
(১) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোঘল অধিপতি বাবর এবং সুলতান ইব্রাহিম লোদীর মধ্যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বাবর জয়লাভ করে ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন।
(২) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ -এ সম্রাট আকবর এবং উত্তরের রাজা হেমচন্দ্র মুখোমুখি হন। যুদ্ধ জয়ী আকবর মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন।
(৩) পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ
১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ তথা সর্বশেষ যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন আহমদ শাহ আবদালী। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে মারাঠা সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যায়।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের সময়কাল
১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের ব্যবহার হয়েছে এমন যুদ্ধের মধ্যে এই যুদ্ধ ছিল অন্যতম।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ
দিল্লি সুলতানির লোদি সাম্রাজ্যের ইব্রাহিম লোদি এবং মধ্য এশিয়ার ফরগানা অধিপতি বাবরের মধ্যে সংঘটিত হয় পানিপথের প্রথম যুদ্ধ।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পটভূমি
বিভিন্ন কারণ পানিপথের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল।
(১) যুদ্ধের নেশা
বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন ফারগানার পূর্বকালীন অধিপতি তৈমুরের বংশধর। আবার মায়ের দিক থেকে তিনি মোঙ্গল অধিপতি চেঙ্গিস খান-এর বংশধর। পূর্বসূরীদের মতোই বাবরের রক্তেও মিশে ছিল যুদ্ধের নেশা।
(২) ব্যর্থ অভিযান
ভাগ্য তার সহায় ছিল না। তাই বারবার অভিযান পরিচালনা করেও তিনি পূর্বপুরুষদের ঘাঁটি মধ্য এশিয়া পুনরাধিকার করতে পারেননি। শুধু সমরকন্দের কাছেই তাকে পরপর তিনবার ব্যর্থ হতে হয়।
(৩) মনোভাবের পরিবর্তন
যার দেহে বইছে চেঙ্গিসের রক্ত, তার জন্য শুধু কাবুল শাসন করে সন্তুষ্ট থাকা অসম্ভব। সভাসদদের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ দিকে দৃষ্টিপাত করেন।
(৪) ইব্রাহিম লোদির দুর্বলতা
দক্ষিণে তখন দিল্লীর সিংহাসন সুলতান ইব্রাহিম লোদির দখলে ছিল। অদক্ষ সুলতান লোদি ছিলেন রাজ্য পরিচালনায় অপটু। বাবর খবর নিয়ে জানতে পারলেন লোদির সভাসদদের মধ্যেই অনেকে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন নি।
(৫) বাবরকে আমন্ত্রণ
ইব্রাহিম লোদির সভাসদদের মধ্যে অন্যতম দৌলত খান লোদি বাবরকে ভারত আক্রমণ করে ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ পরিস্থিতি
দৌলত খান লোদির আমন্ত্রণে বাবর প্রায় ১৫ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করেন। এভাবে শুরু হয় মোঘলদের পানিপথের দিকে যাত্রা এবং তৈরি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির সৈন্যবাহিনী
লোদির প্রধান শক্তি ছিল অশ্বারোহী দল। তিনি ঘোড়ার পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার যুদ্ধবাজ হাতি দিয়ে বিশাল এক হস্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। লোদির অধীনে দক্ষ তীরন্দাজ পদাতিক বাহিনীও ছিল। পদাতিক যোদ্ধারা তলোয়ার, কুঠার এবং বর্শা দিয়ে সজ্জিত ছিলেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সেনাবাহিনী
- (১) বাবরের মোঘল বাহিনীতে তুর্কি, মঙ্গোল, পারস্য এবং আফগান অঞ্চলের যোদ্ধারা ছিলেন। মঙ্গোলদের চিরাচরিত কায়দায় বাবর অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনী দিয়ে দল ভারি করেন।
- (২) তার কাছে গোপন অস্ত্র ছিল ‘গোলন্দাজ বাহিনী’। তখনও ভারতের বুকে পশ্চিমা বারুদের খবর পৌঁছায়নি। তাই লোদি এই অস্ত্র সম্পর্ক অবগত ছিলেন না। বাবর প্রায় চার ধরনের ভারি এবং হালকা কামান দিয়ে গোলন্দাজ বাহিনী সজ্জিত করেন। গোলা হিসেবে পাথর এবং বিভিন্ন ধাতুর তৈরি গোলক ব্যবহার করেন। প্রায় ২০টি কামান সহ ৮ হাজার সৈনিক সম্বলিত মোঘলবাহিনী এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধ শুরু
- (১) যুদ্ধের শুরুতেই লোদি বাহিনীকে চমকে দেন বাবর। তিনি অটোমানদের যুদ্ধের প্রথম কৌশল ‘তুলুঘমা’ অনুসরণ করেন। তুলুঘমা অর্থ শত্রুকে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলা। ৮ হাজার সৈনিক যখন লোদির ৪০ হাজার যোদ্ধাকে ঘিরে ফেলল, তখন সুলতান নিজেই খেই হারিয়ে ফেললেন।
- (২) কামানের গোলায় লোদি বাহিনীর ঘোড়া, হাতি এবং সৈনিকদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হাতিগুলো ভয় পেয়ে আর সামনে অগ্রসর হতে রাজি হল না।
- (৩) ইতিহাসবিদদের মতে ইব্রাহিম লোদি তখন যুদ্ধের তীব্রতায় সৈনিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অতিরিক্ত ফৌজ থাকার পরেও তিনি তাদের ব্যবহার করতে পারেননি। সুলতানের মৃত্যুর পর লোদি বাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয়।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের কারণ
ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের পশ্চাতে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন –
(১) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের কামানের ব্যবহার
ভারতের মাটিতে সর্বপ্রথম বাবরই কামান ব্যবহার করেন। কামানের গােলার সামনে ইব্রাহিম লােদির সৈন্যদের তিরধনুক, তরবারি ও বল্লম অকেজো হয়ে পড়ে এবং বাবর জয়ী হন।
(২) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের উন্নত রণকৌশল
বাবর যুদ্ধক্ষেত্রে উন্নত ‘তুলঘুমা’ ও ‘রুমি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। গােলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে তীব্রগতিসম্পন্ন উজবেকি অশ্বারােহী বাহিনীর মিলিত আক্রমণকে বলা হত ‘তুলঘুমা’ পদ্ধতি। গােরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি বা কাঠ-জাতীয় কিছু জিনিস সারিবদ্ধভাবে রেখে প্রথমে একটি কৃত্রিম প্রাচীর তৈরি করা এবং তার পিছনে মাটির ঢিবির ওপর কামান রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করার নাম ছিল ‘রুমি’ পদ্ধতি। এই দুই পদ্ধতি অবলম্বন করায় বাবরের পক্ষে জয়লাভ অনেক সহজ হয়।
(৩) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সাহসী নেতৃত্ব
বাবর ছিলেন একজন সাহসী ও দক্ষ সেনানায়ক। তিনি মধ্য এশিয়ার উজবেক, মােঙ্গল, পারসিক, তুর্কি প্রভৃতি জাতিগােষ্ঠীগুলির রণকৌশলের সেরা দিকগুলি নিয়ে একটি উন্নত রণনীতি গড়ে তােলেন। অপরদিকে সেনানায়ক হিসেবে ইব্রাহিম লােদি ছিলেন বাবরের তুলনায় অনেকটাই অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। তাই বাবর সহজেই জয়লাভ করেন।
(৪) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের দক্ষ ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী
বাবরের পদাতিক ও অশ্বারােহী সেনারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ বাবরের প্রতি সেনাদের অটুট আনুগত্য ছিল।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের ফলাফল
যুদ্ধে ইবরাহিম লোদি তার ১৫০০০ সৈনিকসহ নিহত হন। গোয়ালিয়রের শাসক বিক্রমজিতও যুদ্ধে মারা যান। পানিপথের এই যুদ্ধ ভাগ্যনির্ধারণী ছিল। এর ফলে বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পর মোঘল সাম্রাজ্য স্থাপন
এই যুদ্ধের তিনদিন পর পানিপথের বীর বাবর বিজয়ীর বেশে দিল্লী দখল করে নেন। শুরু হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, যার নাম মোঘল সাম্রাজ্য।
উপসংহার :- পানিপথের প্রান্তরে লোদির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মাধ্যমে যে মোঘল সূর্যের উত্থান হয়, তা পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রতাপের সাথে ভারতবর্ষ শাসন করে। হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেব প্রমুখরা মিলে ধাপে ধাপে গড়ে তোলেন ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাস।
(FAQ) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল লোদি সাম্রাজ্যের ইব্রাহিম লোদি এবং ফরগানার অধিপতি বাবরের মধ্যে হয়েছিল।
হরিয়ানার পানিপথ নামক স্থানে।
এই যুদ্ধে জয়লাভ করে বাবর ভারতে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল।