ইব্রাহিম লোদী

সুলতান ইব্রাহিম লোদী প্রসঙ্গে ইব্রাহিমের নিষ্ঠুরতা, গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ, মেমারির সাথে সংঘাত, রাজতান্ত্রিক আদর্শ, আফগান সর্দারদের বিদ্রোহ, ইব্রাহিমের রক্তাক্ত জয় ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানবো।

সুলতান ইব্রাহিম লোদী

ঐতিহাসিক চরিত্রইব্রাহিম লোদী
রাজত্বকাল১৫১৭-২৬ খ্রি
বংশলোদী বংশ
পূর্বসূরিসিকান্দার লোদী
পরবর্তী সাম্রাজ্যমোগল সাম্রাজ্য
সুলতান ইব্রাহিম লোদী

ভূমিকা :- ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সিকন্দার লোদীর মৃত্যু হলে তাঁর জোষ্ঠপুত্র ইব্রাহিম লোদী সর্বসম্মতিক্রমে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ইব্রাহিমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জালাল খান জৌনপুরের শাসক নির্বাচিত হন। ইব্রাহিম দিল্লীর সিংহাসনে বসে “শাহ” উপাধি নেন।

ইব্রাহিম লোদীর নিষ্ঠুরতা

জৌনপুরে জালাল খানের স্বাধীন আধিপত্য তিনি স্বীকার করতে চান নি। জালাল খান যুদ্ধে ইব্রাহিমের হাতে পরাস্ত হয়ে বন্দী হন। ইব্রাহিম তাঁর ভ্রাতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে সিংহাসন নিস্কন্টক করেন। ইব্রাহিমের এই নিষ্ঠুর আচরণের জন্য তিনি আফগান অভিজাতদের আস্থা হারান। এভাবে তাঁর সঙ্গে আফগান কর্মচারীদের বিরোধের সূত্রপাত হয়।

সুলতান ইব্রাহিম লোদীর গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ

গোয়ালিয়র দুর্গের অধিপতি রাজা বিক্রমজিৎ দিল্লীর আদেশ অমান্য করায় ইব্রাহিম গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ করেন। বিক্রমজিৎ প্রবল বাধাদানের পর আত্মসমর্পণ করলে, ইব্রাহিম তাকে জাগীর দ্বারা পুরষ্কৃত করেন।

মেবারের সাথে ইব্রাহিম লোদীর সংঘাত

  • (১) গোয়ালিয়রের পর সুলতান ইব্রাহিম লোদী মেবার-এর রাণা সঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মেবারের রাণা সংগ্রামসিংহ মালবে নিজ অধিকার বিস্তারের চেষ্টা করেন। এদিকে মালবের ওপর ইব্রাহিমের দৃষ্টি ছিল।
  • (২) তিনি মালবের সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ শাহকে সাহায্য করেন। শেষ পর্যন্ত মালবের উপর আধিপত্যের প্রশ্ন নিয়ে রাণা সঙ্গ ও ইব্রাহিম যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে খাটাউলির যুদ্ধে ইব্রাহিম পরাস্ত হন। ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে ঢোলপুরের যুদ্ধে তিনি পুনরায় পরাস্ত হন।
  • (৩) এর পরেও দিল্লীর সঙ্গে মেবারের সংঘাত চলতে থাকে এবং ইব্রাহিম পরাজয় বরণ করেন। দিল্লী সুলতানি রাজ্যের কিছু অংশ রাজপুতরা অধিকার করে নেয়।

ইব্রাহিম লোদীর রাজতান্ত্রিক আদর্শ

  • (১) সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সঙ্গে তার স্বজাতীয় আফগান অভিজাতদের গভীর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে দুই পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য।
  • (২) সুলতান ইব্রাহিম স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদর্শে নির্ভর করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রে সুলতানই হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বাকি সকল কর্মচারী তার নির্দেশ মত চলতে বাধ্য। কিন্তু আফগান সর্দাররা সুলতানের সমকক্ষতা দাবী করতেন।
  • (৩) দিল্লী সুলতানির গোড়ায় ইলতুৎমিস-এর শাসনকালে যে সাংবিধানিক সমস্যা সিংহাসনকে ভারাক্রান্ত করে, একই সমস্যা দিল্লী সুলতানির শেষে দেখা দেয়। তিনি ভুলে যান যে, তার পূর্ববর্তী লোদী সুলতান বহলুল লোদী কূটনীতি, সামরিক দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে স্বাধিকার প্রমত্ত আফগান অভিজাতদের বশে রাখেন।
  • (৪) সিকন্দার লোদীও স্বীয় ব্যক্তিত্ব এবং শাসন দক্ষতার দ্বারা অভিজাত সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ইব্রাহিম লোদীর সেই ক্ষমতা ছিল না। রাণা সঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর আফগান অভিজাতরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • (৫) ইব্রাহিম এই পরিস্থিতিতে সতর্ক পদক্ষেপ করেন নি। তিনি ভাবেন যে তার পিতা ও পিতামহ যেহেতু সিংহাসনে ছিলেন বংশানুক্রমিক অধিকারবলে অভিজাতদের আনুগত্য তাঁর প্রাপ্য। ইব্রাহিম সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেন।
  • (৬) ইব্রাহিম অভিজাতদের বশীভূত করার জন্য দরবারে নানা প্রকার আদব-কায়দা চালু করেন। যেমন – সুলতান দরবারে ঢুকলে অভিজাতরা জোড়হাতে দাঁড়াতে বাধ্য থাকবে ইত্যাদি।

সুলতান ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে আফগান সর্দারদের বিদ্রোহ

  • (১) ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে আফগান সর্দাররা অসন্তুষ্ট ছিল। আফগান সর্দাররা সর্ব্বসম্মতভাবে ইব্রাহিম ও জালাল খানের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেয়। ইব্রাহিমকে দিল্লী অঞ্চলে ও তাঁর ভ্রাতা জালাল থাকে জৌনপুরে রাজত্ব করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়।
  • (২) ইব্রাহিম সাম্রাজ্য ভাগ স্বীকার না করে নিজ ভ্রাতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করায় আফগান সর্দাররা অসন্তুষ্ট হয়। এমন কি তাঁর অন্যান্য ভ্রাতা যারা সিংহাসন দাবী করতে পারত, ইব্রাহিম তাদেরকে হত্যা করেন। তিনি বয়স্ক সম্ভ্রান্ত অভিজাতদের মর্যাদা দিতেন না।
  • (৩) আফগান অভিজাতদের বিক্ষুব্ধ মনোভাব দেখে ইব্রাহিম তাদের দমন করার জন্য বল প্রয়োগ করেন। ইব্রাহিম লোদী কয়েকজন প্রধান অভিজাত আজম হুমায়ুন ফতে খান, মিঞা খান প্রমুখকে কারাগারে বন্দী করেন। আজম হুমায়ুনকে হত্যা করা হয়। এর ফলে তার বিরুদ্ধে আফগান অভিজাতরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

ইব্রাহিম লোদীর রক্তাক্ত জয়

কারা থেকে কনৌজ এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আফগান অভিজাতরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বহু যুবক আফগান ইব্রাহিমের পক্ষ নেন। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু আফগান সর্দারকে হত্যা করা হয়। ইব্রাহিম জয় লাভ করেন। ইসলাম খাঁ, সৈয়দ খাঁ লোদী প্রমুখ আফগান সর্দাররা বন্দী হন। তিনি বহু বন্দী আফগান সর্দারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন।

সুলতান ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

এই পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদী দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে কাবুলের অধিপতি মহম্মদ জাহিরুদ্দিন বাবরের সাহায্য চান। গুজরাটের শাসনকর্তা আলম খান লোদীও এই চক্রান্তে যোগ দেন।

উপসংহার :- বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ -এ ইব্রাহিম লোদীর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। যুদ্ধে ইব্রাহিম নিহত হলে দিল্লী সুলতানির পতন হয়। বাবর দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন। শুরু হয় মোগল সাম্রাজ্যের শাসন

(FAQ) সুলতান ইব্রাহিম লোদী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দিল্লি সুলতানির শেষ সুলতান কে ছিলেন?

ইব্রাহিম লোদী।

২. লোদী বংশের শেষ সুলতান কে ছিলেন?

ইব্রাহিম লোদী।

৩. সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে কখন?

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে।

৪. পাণিপথের প্রথম যুদ্ধ কখন হয়?

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment