জাদুঘরের বিকাশ প্রসঙ্গে প্রাচীন জাদুঘর, পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর, পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর, আধুনিক জাদুঘর, জাদুঘরে প্রবেশের অনুমতি, আধুনিক জাদুঘরগুলির প্রতিষ্ঠাকাল, আধুনিক জাদুঘর গুলির অবস্থান, আধুনিক জাদুঘর গুলির পর্ব বিভাগ, উল্লেখযোগ্য আধুনিক জাদুঘর ও আধুনিক জাদুঘর গুলি উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানবো।
জাদুঘরের বিকাশ
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাদুঘরের বিকাশ |
প্রাচীনতম জাদুঘর | এননিগালডি-নান্না-র জাদুঘর |
ব্যক্তিগত জাদুঘর | প্লেটোর জাদুঘর |
ব্রিটিশ মিউজিয়াম | ইংল্যান্ড |
লুভর মিউজিয়াম | ফ্রান্স |
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল | কলকাতা |
ভূমিকা :- সুদূর অতীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রচলন ছিল। যুগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অতীতকালের জাদুঘরগুলির বিকাশ ঘটতে থাকে। এই বিকাশের ধারায় প্রাচীন জাদুঘরগুলি বর্তমান যুগের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।
প্রাচীন জাদুঘর
অতীতকালে ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জাদুঘরগুলি গড়ে উঠত। তাদের উদ্যোগে বিভিন্ন দুর্লভ সামগ্রী, কৌতূহলোদ্দীপক প্রাকৃতিক বস্তু, মানুষের সৃষ্টি করা কিছু জিনিস প্রাচীন জাদুঘরগুলিতে স্থানলাভ করত। জনগণের প্রবেশাধিকারের ভিত্তিতে প্রাচীন জাদুঘরগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন – (ক) পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর, (খ) পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর।
(ক) পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর
প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত প্রথমদিকের জাদুঘরগুলি থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে ইতালির নবজাগরণ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত যেসকল জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলিতে সর্বদা সর্বসাধারণের প্রবেশের অধিকার ছিল না। বহু ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেসব জাদুঘরে প্রবেশের অবাধ সুযোগ পেলেও সর্বসাধারণ সেখানে প্রবেশের অবাধ সুযোগ পেত না। এযুগের উল্লেখযোগ্য জাদুঘরগুলি হল –
(১) প্রাচীনতম জাদুঘর
পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘরের নির্দশন হিসেবে আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার এননিগালডি-নান্না-র জাদুঘর (Ennigaldi Nanna’s museum)-কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
(২) প্লেটোর জাদুঘর
দার্শনিক প্লেটো তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাচীন এথেন্সে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বহু দুর্লভ বইপত্র সংগ্রহ করা হয়।
(৩) আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘর
প্রাচীনকালে গড়ে ওঠা বিভিন্ন জাদুঘরের মধ্যে উন্নত ও সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘর।
(খ) পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর
জাদুঘরের বিকাশের ধারায় পঞ্চদশ শতক থেকে সর্বসাধারণকে প্রবেশাধিকারের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। যেমন –
(১) ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়াম
প্রকৃতপক্ষে সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য জাদুঘর বলতে যা বোঝায় সে ধরনের জাদুঘর সর্বপ্রথম গড়ে উঠেছিল ইতালির রোম-এ, পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণের যুগে। ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়াম নামে পরিচিত এই জাদুঘরটি ১৪৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। পোপ চতুর্থ সিক্সটাস এই সংগ্রহশালায় বেশ কিছু প্রাচীন ভাস্কর্য দান করেন।
(২) ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
সর্বসাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল ইতালিতে এমন দ্বিতীয় জাদুঘরটি হল ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভ্যাটিকান মিউজিয়াম। পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস-এর উদ্দ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সর্বসাধারণের প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তা খুলে দেওয়া হয়।
(৩) রয়েল আরমারিজ
ইংল্যান্ডে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাদুঘর হল লন্ডনের রয়েল আরমারিজ। এটি ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়।
(৪) অ্যাসমোলীয়ান মিউজিয়াম
ইলিয়াস অ্যাসমোল -এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দ্য অ্যাসমোলীয়ান মিউজিয়াম টি প্রথম আধুনিক জাদুঘর বলে বিবেচিত হয়। এটি ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানকার সংগ্রহে ছিল প্রাচীন মুদ্রা, পুস্তক, খোদাই করা ফলক, জৈবিক প্রজাতি ইত্যাদি।
(৫) অন্যান্য জাদুঘর
এই কালপর্বে প্রতিষ্ঠিত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জাদুঘরগুলি হল – ব্যাসেল-এর আমেরব্যাখ ক্যাবিনেট, সেন্ট পিটার্সবার্গের কুন্সটকামেরা, ভিয়েনার বেলভেডার প্যালেস, সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর হারমিটেজ মিউজিয়াম, আমেরিকার চার্লসটন মিউজিয়াম, কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম প্রভৃতি।
আধুনিক জাদুঘর
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাচীন জাদুঘরগুলি একসময় সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হলেও তাতে প্রবেশের যথেষ্ট সুবিধা ভোগ করত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাকিদের পক্ষে জাদুঘরে প্রবেশ করার কাজটি যথেষ্ট জটিল ছিল।
জাদুঘরে প্রবেশের অনুমতি
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রবেশের জন্য দর্শকদের লিখিত আবেদন করে অনুমতি নিতে হত। এই অনুমতি পেতে অন্তত দু-সপ্তাহ সময় লাগত। এরূপ জটিল প্রতিক্রিয়ায় নিম্নশ্রেণির মানুষের পক্ষে সর্বদা জাদুঘরে প্রবেশের সুযোগ হত না।
আধুনিক জাদুঘরগুলির প্রতিষ্ঠাকাল
যাই হোক, আধুনিক জাদুঘরগুলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশের ক্ষেত্রে এরূপ জটিল প্রক্রিয়া নেই। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক জাদুঘরগুলির অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জ্ঞানদীপ্তির যুগে (সপ্তদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক), বিশেষ করে অষ্টাদশ শতক ও তার পরবর্তীকালে।
আধুনিক জাদুঘরগুলির অবস্থান
বর্তমানকালে পৃথিবীর সর্বত্র ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকারের জাদুঘর দেখা যায়। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরগুলি বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে অবস্থিত। এ ছাড়া বিভিন্ন মফস্বল বা ছোটো ছোটো শহর, এমনকি গ্রাম্য এলাকায়ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
আধুনিক জাদুঘর গুলির পর্ব বিভাগ
এই আধুনিক জাদুঘরগুলিকে দুটি পর্বে বিভক্ত করা যায়, যেমন – (ক) প্রথম পর্বের আধুনিক জাদুঘর, (খ) জাদুঘরের যুগ-এ প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর।
(ক) প্রথম পর্বের আধুনিক জাদুঘর
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য আধুনিক জাদুঘরগুলি হল –
(১) ব্রিটিশ মিউজিয়াম
লন্ডনে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার হান্স স্লোয়ান-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহগুলি দিয়ে এই জাদুঘরের পথ চলা শুরু হয়। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘরটি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়।
(২) উফফিজি গ্যালারি
ফ্লোরেন্সের উফফিজি গ্যালারি নামে জাদুঘরটি ষোড়শ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয় ও দর্শকদের দীর্ঘকাল অনুরোধের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তা জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়।
(৩) লুভর মিউজিয়াম
- (i) ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত লুভর মিউজিয়ামটি হল বর্তমানকালের সুবৃহৎ ও সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য জাদুঘরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই জাদুঘরটি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব কালে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়।
- (ii) ফরাসি রাজবংশ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেসব বিস্ময়কর শিল্প-সম্পদ সংগ্রহ করেছিল, সেগুলি জনসাধারণ দেখার সুযোগ পায়।
- (iii) সম্রাট নেপোলিয়ন বহু দেশ জয় করে যেসব সামগ্রী লাভ করেন সেগুলির অনেক কিছুই এই জাদুঘরে স্থান পায়। অবশ্য নেপোলিয়নের পরাজয়ের (১৮১৫ খ্রি.) পর সেসব সামগ্রীর অনেকগুলিই তাদের পূর্বতন মালিকরা ফিরিয়ে নেন।
(খ) জাদুঘরের যুগ-এ প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর
ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে বিংশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপক উদ্যোগ দেখা দেয় এবং বহু নতুন নতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই এই যুগকে ‘জাদুঘরের যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। এই কালপর্বে আমেরিকার এবং ইউরোপ-এর বিভিন্ন দেশে বহু নতুন নতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
উল্লেখযোগ্য আধুনিক জাদুঘর
উল্লেখযোগ্য আধুনিক জাদুঘরগুলি হল –
- (i) ‘দ্য আর্ট ইন্সটিটিউট অব শিকাগো’ (শিকাগো, ১৮৭৯ খ্রি.),
- (ii) ‘করকোরান গ্যালারি অব আর্ট’ (ওয়াশিংটন, ১৯০১ খ্রি.),
- (iii) ‘ডালাস মিউজিয়াম অব আর্ট’ (ডালাস, ১৯০৩ খ্রি.),
- (iv) ‘দ্য ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট’ (ক্লিভল্যান্ড, ১৯১৬ খ্রি.),
- (v) ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল’ (কলকাতা, ১৯২১ খ্রি.),
- (vi) ‘দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন ‘আর্ট’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯২৯ খ্রি.),
- (vii) ‘দ্য ফিল্ড মিউজিয়াম’ (শিকাগো, ১৯৩০ খ্রি.) প্রভৃতি।
আধুনিক জাদুঘরগুলির উদ্দেশ্য
- (১) এ যুগে নির্মিত জাদুঘরগুলির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক বস্তুসামগ্রী প্রদর্শনের পাশাপাশি সেগুলি নিয়ে গবেষণা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করা। এযুগে আমেরিকায় প্রাকৃতিক ইতিহাস, শিল্প প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) উত্তর আমেরিকায় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, শিল্পের বিকাশ প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করাই ছিল এসব জাদুঘরের প্রধান উদ্দেশ্য।
আধুনিক জাদুঘরগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা
প্রাচীন মিশর, গ্রিস, মেসোপটেমিয়া, রোম প্রভৃতি দেশের দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক সামগ্রী সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের জাদুঘরগুলির সঙ্গে আমেরিকার জাদুঘরগুলি পাল্লা দিতে শুরু করে।
উপসংহার :- সুপ্রাচীনকালে মেসোপটেমিয়া, এথেন্স প্রভৃতি দেশে জাদুঘরের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য জাদুঘরের অস্তিত্ব রয়েছে।
(FAQ) জাদুঘরের বিকাশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার এননিগালডি-নান্না-র জাদুঘর।
ফ্রান্সের প্যারিসে।
দার্শনিক প্লেটোর জাদুঘর।
১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনে।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে।