সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণার সময়কাল, ঘোষণাকারী, গান্ধিজির আন্দোলনে মুসলিম সমাজের দূরত্ব, মহম্মদ আলির ঘোষণা, পৃথক নির্বাচনের সম্প্রসারণ, বৈঠকে কংগ্রেসের আপত্তি ও মুসলিম লীগের সম্মতি, প্রেক্ষাপট হিসেবে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক, দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক, তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ঘোষণা, নীতির মূল বক্তব্য, নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়, গান্ধিজির ভূমিকা, পুনা চুক্তি, পৃথক পাকিস্তানের দাবি ও পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে জানবো।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা

ঐতিহাসিক ঘটনাসাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা
সময়কাল১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ
ঘোষণাকারীব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী  রামসে ম্যাকডোনাল্ড
মূল বক্তব্যসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা

ভূমিকা:- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করে।

গান্ধিজির আন্দোলনে মুসলিম সমাজের দূরত্ব

গান্ধিজির নেতৃত্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে খিলাফৎ আন্দোলন -এর দুজন অগ্রণী নেতা এবং গান্ধিজির একসময়কার একান্ত অনুগামী বলে পরিচিত মহম্মদ আলি ও সৌকত আলি আইন অমান্য আন্দোলন থেকে দূরে থাকেন।

মহম্মদ আলির ঘোষণা

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনে মহম্মদ আলি ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেসের আন্দোলন আসলে হিন্দুদের আন্দোলন এবং গান্ধিজির আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হল মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দু মহাসভার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা।

আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব

এই নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য তো বটেই এমনকি দলিত শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়।

বৈঠকে কংগ্রেসের আপত্তি

গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। এই সময় ভারত-এ সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে লন্ডনে পরপর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কংগ্রেস এই ধরনের বৈঠকে আপত্তি করে।

বৈঠকে মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্মতি

কংগ্রেস এই ধরনের বৈঠকে আপত্তি করলেও জিন্না, আলি ভ্রাতৃদ্বয়, আবদুল কাদির, মহম্মদ শফি প্রমুখ মুসলিম নেতা এবং বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন সরকারের এই উদ্যোগকে সমর্থন করে।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণার প্রেক্ষাপট

১৯৩২ সালে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –

(১) প্রথম গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠক -এ কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল যোগদান করে। বৈঠকে উপস্থিত জিন্না, আগা খাঁ, মহম্মদ শফি, মহম্মদ আলি, ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম লিগ নেতা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান এবং জানিয়ে দেন যে, যথার্থভাবে মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষিত না হলে তাঁরা কোনো সংবিধানই মানবেন না।

(২) দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক -এ কংগ্রেস যোগ দিলেও সরকারি প্ররোচনায় মুসলিম লিগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অযৌক্তিক সীমাহীন দাবি জানায়। ফলে এই বৈঠকও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং গান্ধিজি শূন্য হাতে ফিরে আসেন।

(৩) তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে কংগ্রেস ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক-এ যোগ না দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনে তীব্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করে।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ঘোষণা

ভারতের সাম্প্রদায়িক ঐক্য ধ্বংস এবং ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট “সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করেন।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মূল বক্তব্য

এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির দ্বারা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়। যেমন –

  • (১) মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভারতীয় খ্রিস্টান, ইউরোপীয় সম্প্রদায় প্রভৃতি সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
  • (২) হিন্দু সম্প্রদায়কে বর্ণহিন্দু ও অনগ্রসর হিন্দু – এই দুই ভাগে বিভক্ত করে তাদের পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির প্রতিক্রিয়া

এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষিত হওয়ার পর এর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির দ্বারা মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক নীতির জয় ঘোষিত হয়। লিগের যাবতীয় সাম্প্রদায়িক দাবিদাওয়া এই নীতির মাধ্যমে মেনে নেওয়া হয়।

(২) গান্ধিজির ভূমিকা

কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। এই নীতির প্রতিবাদে গান্ধিজি ২০ সেপ্টেম্বর জারবেদা জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে গান্ধিজির জীবনরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে আইন অমান্য আন্দোলনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায় এবং উদ্বিগ্ন কংগ্রেস নেতারা ড. বি. আর. আম্বেদকর -এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।

(৩) পুনা চুক্তি

তফশিলি নেতা ড. বি. আর. আম্বেদকর এবং অন্যান্য হিন্দুদের পক্ষ থেকে ড. মদনমোহন মালব্যের সঙ্গে আলোচনা করে পুনা চুক্তি (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রি.)-তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির দ্বারা হিন্দুদের যৌথ নির্বাচনের নীতি মেনে নেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মাধ্যমে তপশিলি সম্প্রদায় যতগুলি আসন পেত তার দ্বিগুণ আসন তাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। গান্ধিজি ২৬ সেপ্টেম্বর অনশন ভঙ্গ করেন।

(৪) পৃথক পাকিস্তানের দাবি

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষিত হওয়ার পর মুসলিম লিগের পৃথক পাকিস্তানের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঞ্জাবি মুসলিম ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি ও তাঁর অনুগামীরা ‘এখন অথবা কখনও না’ (Now or Never) শীর্ষক চার পাতার এক পুস্তিকায় ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত পাঁচটি প্রদেশ- পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু, এবং বেলুচিস্তান নিয়ে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান।

(৫) পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন

কিছুকাল পর চৌধুরী রহমত আলি ‘পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন’ শুরু করে প্রস্তাবিত ‘পাকিস্তান’ ভূখণ্ডে কয়েকটি প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করেন।

উপসংহার:- এই ঘটনার কিছুকাল পরই ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ লাহোর অধিবেশনে পৃথক পাকিস্তানের দাবি জানায় এবং পৃথক পাকিস্তান আন্দোলন অতিদ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

(FAQ) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কে কবে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করেন?

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড।

২. সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি দ্বারা হিন্দুদের কি ভাবে ভাগ করা হয়?

বর্ণহিন্দু ও অনগ্রসর হিন্দু।

৩. সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মূল বক্তব্য কি ছিল?

মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভারতীয় খ্রিস্টান, ইউরোপীয় সম্প্রদায় প্রভৃতি সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া।

Leave a Comment