সুমাগধা

প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী সুমাগধা প্রসঙ্গে তার পরিচয়, সুমাগধার বিবাহ বিষয়ে গৌতম বুদ্ধের নিকট আজ্ঞা লাভ, সুমাগধার বিবাহ, শ্বশুরগৃহে কর্তব্যপরায়ণা সুমাগধা, সুমাগধার প্রতি শ্বাশুড়ির আদেশ, নগ্ন সন্ন্যাসীদের প্রতি সুমাগধার ঘৃণা প্রকাশ, সুমাগধা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধ ও তার ধর্মমতের বর্ণনা, ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে সুমগধার পুষ্পাঞ্জলি, সুমাগধার শ্বশুর বাড়িতে ভিক্ষুদের আগমন, সুমাগধার গৃহে বুদ্ধদেবের প্রবেশ ও বুদ্ধদেব কর্তৃক সুমাগধার শ্বশুর বাড়ির পূজা গ্ৰহণ সম্পর্কে জানব।

গৌতম বুদ্ধের শিষ্য়া সুমাগধা প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী সুমাগধা, জৈন সাধুদের প্রতি সুমাগধার ঘৃণা প্রকাশ, বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্যে সুমাগধার পুষ্পাঞ্জলি, সুমাগধার গৃহে বুদ্ধদেবের আগমন ও তার পূজা গ্রহণ সম্পর্কে জানব।

বৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী সুমাগধা

ঐতিহাসিক চরিত্রসুমাগধা
পরিচিতিবৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী
পিতাঅনাথপিণ্ডদ
শ্বশুরালয়পুণ্ড্রবর্ধন
স্বামীবৃষভদত্ত
ধর্মবৌদ্ধ ধর্ম
বৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী সুমাগধা

ভূমিকা :- প্রাচীন ভারত-এর বৌদ্ধ যুগের একজন বিদুষী নারী ছিলেন সুমাগধা। তিনি ছিলেন তৎকালীন এক ধনী শ্রেষ্ঠি অনাথপিণ্ডদের কন্যা।

সুমাগধার বিবাহ বিষয়ে গৌতম বুদ্ধের নিকট আজ্ঞা লাভ

  • (১) শ্রাবস্তী নগরীর জেতবনে গৌতম বুদ্ধ প্রশান্ত ভাবে বসে আছেন। তাঁর অপরূপ-রূপপ্রভায় সেই কাননভূমি আলোকিত। শিষ্যগণ তাঁর মুখ হতে সুমধুর উপদেশাবলী শুনছেন, এরূপ সময়ে অনাথপিণ্ডদ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর চরণপদ্ম স্পর্শ করে বিনীত ভাবে বললেন, ভগবান! আপনার কৃপায় সুমাগধা সর্বগুণে গুণবতী হয়েছে।
  • (২) সর্বত্রই বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছে। এখন পুণ্ড্র বর্ধন নগরের শ্রীমান সার্থনাথের পুত্র বৃষভদত্ত তার পাণিগ্রহণ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমার ধনপ্রাণ সমুদয়ই প্রভুর হাতে। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহলে আমি তাঁর হস্তে কন্যাকে সমর্পণ করতে পারি। বুদ্ধদেব বললেন, এইরূপ যোগ্যপাত্রে তুমি অনায়াসেই কন্যা দান করতে পার।

সুমাগধার বিবাহ

ভগবান তথাগতের অনুমতি লাভ করে অনাথপিণ্ডদ বৃষভদত্তের সাথে প্রচুর বিভব, বহু রত্ন এবং উৎকৃষ্ট বসনভূষণ ইত্যাদি প্রদান পূর্বক কন্যার বিবাহ দিলেন। সুমাগধা অতি দূরতর দেশে যাবার সময় অশ্রুপূর্ণ লোচনে ভগবান বুদ্ধদেবের নামোচ্চারণ করতে করতে গমন করলেন।

শ্বশুরগৃহে কর্তব্যপরায়ণা সুমাগধা

দীর্ঘকাল পথ-পর্যটনের পর সুমাগধা শ্বশুরগৃহে এসে উপস্থিত হলেন। শ্বশুরশাশুড়ী তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করলেন। কল্যাণী সুমাগধার পতিসেবা, কর্তব্য পালন ইত্যাদি দেখে শ্বশুরগৃহের সকলেই তাঁর প্রতি স্নেহশীল ছিলেন।

সুমাগধার প্রতি শ্বশ্রূর আদেশ

একদিন সুমাগধার শ্বশ্রূ ধনবতী তাকে বললেন, “বৎসে! আমি সংসারত্যাগী সাধুসন্ন্যাসীদেরকে পরিতোষরূপে ভোজন করাবার সঙ্কল্প করেছি। তুমি তার আয়োজন এবং অন্যান্য পূজোপকরণ সমুদয় সজ্জিত কর। জগৎপূজা ভগবান জিন (জৈন ধর্ম প্রবর্তক) আমার গৃহে আগমন করবেন।”

শ্বশ্রূর আদেশ পালনকারী সুমাগধা

সুমাগধা শ্বশ্রূর আদেশ অনুসারে সমুদয় পুজোপকরণ প্রস্তুত করে পূজ্য অতিথিগণের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলেন। জৈনভিক্ষুগণ ধনবতীর ভোজ্য সভাকার্যের ব্যয়ের কথা জানতে পেরে পরদিন সদলবলে সুমাগধার অন্তরভবনে আগমন করলেন।

ধনবতী কর্তৃক সুমাগধাকে আহ্বান

জৈন ভিক্ষুগণ দিগম্বর, জটাজুটধারী, ভস্মবিভূতি মাথা এবং বিকটবদন। দম্ভবশতঃ এদের বদন ভয়ঙ্কর এবং ক্রোধের ভাব মুখে ও চক্ষুতে সুস্পষ্ট প্রতিভাত। এরূপ আকৃতি ও প্রকৃতির সন্ন্যাসীরা গৃহে এসে উপস্থিত হলে, সুমাগধার শ্বশ্রু ধনবতী তাকে ডেকে বললেন, “বৎসে ! একবার আসিয়া দেখ, কেমন সব সন্ন্যাসীরা আসিয়াছেন।”

নগ্ন সন্ন্যাসীদের দেখে সুমাগধার ফিরে আসা

সুমাগধা শাশুড়ীর আহ্বানে পরম আনন্দিত মনে কৌতূহলী হয়ে নিচে নেমে এসে ঐ সব নির্লজ্জ, নগ্ন, মাংসভক্ষণাভ্যাসে স্কুলকায় মহিষের ন্যায় সন্ন্যাসীদেরকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বস্ত্র দ্বারা মুখ আচ্ছাদন করে বিমর্ষ ভাবে ফিরে গেলেন।

নগ্ন সন্ন্যাসীদের প্রতি সুমাগধার ঘৃণা প্রকাশ

  • (১) তাঁকে এইরূপ ভাবে ত্রস্তে ফিরে যেতে দেখে শাশুড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, “বাছা, তোমাকে এইরূপ বিষণ্ন ভাবে ফিরতে দেখছি কেন ?” তখন সুমাগধা বললেন, “আজ বহুকাল পরে আমি দেখতে পেলাম যে বধূগণ এরূপ নির্লজ্জ সাধুসন্ন্যাসীর সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে। এরা যদি সাধু তবে অসাধু কে ?
  • (২) এই সকল শৃঙ্গহীন পশুগণ আপনাদের গৃহে ভোজন করছে, এরা মনুষ্য নয়। এজন্যই পুরমহিলাগণ এদেরকে দেখে লজ্জিতা হচ্ছেন না। এদের মত দুর্জনের প্রতি যদি আপনাদের ভক্তি হয়ে থাকে, তাহলে বলব যে, আপনারা অযোগ্য পাত্রে ভক্তি সমর্পণ করেছেন। এ কিরূপ নিয়ম ?
  • (৩) যে ব্যক্তি ভোজন ত্যাগ করতে পারে না, সে কিরূপে বস্ত্র ত্যাগ করবে? এই সকল পশুরা যে দেশে পূজা পাচ্ছে, সে দেশে পরিত্যাজ্য কি তাই বুঝতে পারছি না।” সুমাগধার মুখে এইরূপ কথা শুনে তার শাশুড়ী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন “তোমার পিত্রালয়ে কিরূপ লোকের পূজা হয়ে থাকে বল।”

সুমাগধা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধ ও তার ধর্মমতের বর্ণনা

  • (১) তখন সুমাগধা ভক্তি গদগদচিত্তে প্রসন্ন মনে পরম উৎসাহের সাথে বলতে লাগলেন, “আমার পিতৃগৃহে ভগবান জিনের (বুদ্ধের) পূজা হয়ে থাকে। ভগবান বুদ্ধদেব সমস্ত জগতের নরনারীর কুশল ও কল্যাণ চিন্তা করে থাকেন। তার সৌম্যমূর্তি দেখলেই তাকে ভক্তি করতে ইচ্ছা হয়।
  • (২) তিনি সর্বজ্ঞ এবং সদানন্দময়। তাঁর কান্তি তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। তাঁর করতলে শঙ্খ, ধ্বজ, ও পদ্মমালার রেখা আছে। তিনি শান্তি ও সংযম সাম্রাজ্য-এর উপযুক্ত লক্ষণ বলে ধারণ করেন। মহামুনিগণেরও অভিলাষজনক সেই মহাপুরুষের স্বভাব সর্বপ্রকার অভিলাষবর্জিত।

গৌতম বুদ্ধের দর্শন অভিলাষি সুমাগধার শ্বশ্রূ

সুমাগধার শ্বশ্রূ পুত্রবধূর মুখে বুদ্ধদেবের এই বর্ণনা শুনে সুমাগধাকে বললেন, “তাকে কিরূপে দর্শন করতে পারা যায়? আমরা যদি তার দর্শন লাভ করতে পারি তাহলে আমরাও কি পাপমুক্ত হতে পারব ?”

গৌতম বুদ্ধকে দেখানোর প্রতিজ্ঞা সুমাগধার

সুমাগধা বললেন, “নিশ্চয়ই পারবেন।” শ্বশ্রু বললেন, “তাহলে আমরা তাঁকে যাতে দেখতে পারি সে ব্যবস্থা করে দাও।” সুমাগধা বললেন, আমি আপনাদেরকে তাকে দেখিয়ে দেব।”

ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে সুমগধার পুষ্পাঞ্জলি

এইরূপ প্রতিজ্ঞা করে সুমাগধা প্রাসাদের উপর আরোহণ করলেন এবং সেখান থেকে ভগবান বুদ্ধদেব যে স্থানে অবস্থান করছিলেন, সেই দিক লক্ষ্য করে তাঁকে প্রণিপাতপূর্বক পূজাপুজোপযুক্ত কুসুমাঞ্জলি নিক্ষেপ করলেন। সুমাগধা কুসুমাঞ্জলি নিক্ষেপ করলে তা সজীব ভক্তিদূতিকার ন্যায় সেই শ্বেত, রক্ত, হরিত ও অসিতবর্ণ ধূপগন্ধসুরভিত পুষ্পাবলী আকাশপথে ধীরে গমন করতে করতে ক্ষণকাল মধ্যে জেতবনে উপস্থিত হয়ে ভগবানের পাদপদ্মের উপর নিপতিত হল।

সুমাগধার গৃহে যাবার জন্য গৌতম বুদ্ধের আদেশ

সর্বজ্ঞ ভগবান সুমাগধার সমস্ত অভিপ্রায় জানতে পেরে আনন্দকে বললেন “কল্য প্রাতঃকালে আমাদিগকে পুণ্ড্রবর্ধন নগরে যাইতে হইবে। সুমাগধা আমার ও মদীয় সঙ্ঘগণের পূজা করিবার প্রার্থনা করিতেছেন। পুণ্ড্র বর্ধন (গৌড়) এস্থান হইতে শতষষ্টি যোজনের অধিক। কিন্তু আমাদিগকে একদিনেই সেখানে যাইতে হইবে। আমরা আর বিলম্ব করিতে পারি না। যে সকল ভিক্ষুগণ প্রভাবশালী এবং শতমার্গে বিচরণ করিতে পারেন, তাহাদিগকেই কেবল নিমন্ত্রণ শলাকাপত্র প্রদান কর।”

সুমাগধার শ্বশুর বাড়ি যাবার জন্য আনন্দ কর্তৃক নিমন্ত্রণ

সেই মত আনন্দ প্রভাবশালী ভিক্ষুদেরকে শলাকাদ্বারা নিমন্ত্রণ করলেন। রাত্রি প্রভাত হলে সমস্ত ভিক্ষুগণ নানা প্রকার দিব্যবেশ ধারণ-পূর্বক বিমান দ্বারা আকাশমার্গে গমন করলেন ।

শলাকাপত্র কি?

প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে নিমন্ত্রণকালে কপূর, চন্দন, কস্তুরিকা প্রভৃতি সুগন্ধদ্রব্য দ্বারা নির্মিত একটি একটি শলাকা পত্র-সহ পাঠাবার রীতি প্রচলিত ছিল।

সুমাগধার শ্বশুর গৃহে আয়োজন

এদিকে সুমাগধার শ্বশুরগৃহেও সুগত ও ভিক্ষুগণের আদর অভ্যর্থনা করবার বিরাট আয়োজন চলছিল। তাঁর শ্বশ্রু, শ্বশুর ও পতি সকলেই সুগতের দর্শনাভিলাসী হয়ে পুষ্প, ধূপ ইত্যাদি পূজোপকরণ সংগ্রহকারে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

সুমাগধার শ্বশুর বাড়িতে ভিক্ষুদের আগমন

দিব্যশক্তি সম্পন্ন ভিক্ষুগণ কেউ কনকপদ্মে আরোহণ করে সৌরভ বিস্তার করতে করতে, কেউ মেঘের উপর আসীন হয়ে দিব্যপ্রভা বিস্তার করতে করতে আগমন করতে লাগিলেন। সুমাগধার শ্বশুরশাশুড়ী প্রমুখ এক একজন অদ্ভূতকর্মা ভিক্ষুকেই ভগবান স্বগত বলে মনে করছিলেন।

সুমাগধার শ্বশুর বাড়িতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাব

সহসা জগৎ যেন কাঞ্চনবৰ্ণসন্নিভ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, শত সূর্য প্রকাশজনিত আলোকে চতুর্দিক উদ্ভাসিত হল এবং অশেষ সন্তাপের প্রশমন হওয়ায় শীতাংশুশতমালা দ্বারা যেন জগৎ শীতল হয়ে গেল। ভগবান তথাগতের পবিত্রমূর্তি দৃষ্টিগোচর হল।

সুমাগধার গৃহে বুদ্ধদেবের প্রবেশ

ভগবান তথাগত সুমাগধার গৃহে প্রবেশ করলে মনে হল যেন তা শতশশিকান্তমণির প্রভায় প্রভান্বিত হয়েছে। এখন সকলে তাঁকে প্রণাম করলেন, বিবিধ উপচার দ্বারা পূজা করলেন। পুরবাসিজন বহির্দেশে ভিত্তিতে প্রতিবিম্বিত ভগবানের ছায়ামাত্র অর্চনা করে আপনাদেরকে ধন্য মনে করতে লাগলেন।

বুদ্ধদেব কর্তৃক সুমাগধার শ্বশুর বাড়ির পূজা গ্ৰহণ

ভগবান সুগত সুমাগধার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে সঙ্ঘ সহ পূজা গ্রহণ করলেন এবং সকলের প্রতি প্রসন্ন-দৃষ্টিপাত করে প্রসাদ বিধান করলেন। সুমাগধার শ্বশুর, স্বামী প্রমুখ প্রিয়জন এবং অন্যান্য সমস্ত পুরবাসিগণ সুগতের সুমধুর উপদেশ লাভ করে বিশুদ্ধাশয় হয়ে তৎক্ষণাৎ সত্যদর্শন করলেন।

উপসংহার :- শিক্ষিতা ও পুণ্যবতী পুত্রবধূ সুমাগধার দ্বারা এই ভাবে তাঁর শ্বশুরাদিবর্গ পুণ্যধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

(FAQ) বৌদ্ধ যুগের বিদুষী নারী সুমাগধা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুমাগধা কে ছিলেন?

প্রাচীন ভারতের মধ্যযুগের একজন বিদুষী নারীর ছিলেন সুমাগধা।

২. সুমাগধা কার কন্যা ছিলেন?

অনাথপিণ্ডদ।

৩. সুমাগধার বিবাহ হয় কোথায়?

পুণ্ড্রবর্ধনে।

৪. সুমাগধার স্বামী কে ছিলেন?

বৃষভদত্ত।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment