সুলতানি যুগের সমাজ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে দুটি সম্প্রদায়, সামাজিক বিভেদ, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান, ভারতীয় মুসলিমদের উন্নতি, জাতিভেদ প্রথার প্রভাব, মুসলিম অভিজাত, উলেমা, হিন্দু সম্প্রদায়, ধনী বণিক, হিন্দু কৃষক, জাতিভেদ প্রথা, পর্দাপ্রথা, নারীর অবস্থা, ক্রীতদাস প্রথা, খাদ্য, পোষাক, বসবাস ও আমোদ প্রমোদ সম্পর্কে জানবো।
সুলতানি যুগের সমাজ ব্যবস্থা
বিষয় | সুলতানি যুগের সমাজ |
তহকিক-ই-হিন্দ | অলবিরুণি |
খলজি বিপ্লব | ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ |
নিরামিষ ভোজী | হিন্দু সম্প্রদায় |
মাংস ভক্ষণ | মুসলিম সমাজ |
ভূমিকা :- মধ্যযুগে হিন্দুসমাজ ও জনগোষ্ঠীর একক ও প্রবল অস্তিত্বের মাঝে মুসলমানদের আগমন ও প্রতিষ্ঠা ভারত-এর সমাজ-জীবনে এক উত্তেজনাকর অধ্যায়ের সূচনা করে।
সুলতানি যুগের সমাজ জীবন সম্পর্কে উপাদান
- (১) সুলতানি যুগের সমাজজীবন সম্পর্কে সমকালীন কথ্য ভাষার সাহিত্য, ফার্সী রচনা, হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি মূল্যবান উপাদান। এই যুগের বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে তাদের রচনায় বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন।
- (২) উলেমা শ্রেণীর ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক ক্ষেত্রে একপেশে। কাজেই তাদের লেখনী থেকে সমকালীন সমাজের প্রকৃত চিত্র পাওয়া সব সময় সম্ভব নয়। বৈদেশিক পর্যাটকদের মধ্যে মুর পর্যাটক ইবন বতুতার রচনা বিশেষ মূল্যবান।
- (৩) ইবন বতুতা প্রায় ৮ বছর মহম্মদ বিন তুঘলক-এর রাজসভায় ছিলেন। ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করে তিনি গাছপালা, পশু-পাখি, ফসল, লোকের জীবনযাত্রা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য রেখে গেছেন। অলবিরুণীর রচনা তহকিক-ই-হিন্দ ও একটি মূল্যবান উপাদান।
সুলতানি যুগের সমাজে দুটি সম্প্রদায়
দিল্লির সুলতানি যুগে ভারতীয় সমাজে হিন্দু ও মুসলিম এই দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। কোনো কোনো ইউরোপীয় লেখক ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমকে দুই পৃথক জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যাখ্যা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ,
- (১) ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে বেশীর ভাগ ছিলেন ভারতীয় জনগণের বংশধর। বহু ধর্মান্তরিত হিন্দু ও দীর্ঘকাল ভারতে বসবাসকারী মুসলিম ছিলেন ভারতীয় মুসলিম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
- (২) ক্ষুদ্র সংখ্যক বিজয়ী তুর্কী, পারসিক ও আফগান ছিলেন শাসক মুসলিম শ্রেণী। কিন্তু দীর্ঘকাল ভারতে বসবাস ও ভারতীয় সভ্যতার অংশীদারত্বের ফলে এরাও ভারতীয় জনগোষ্ঠীতে মিশে যান। সুতরাং হিন্দু ও মুসলিম এই দুই পৃথক জাতিতত্ত্বের প্রকৃত ভিত্তি নেই।
ভারতে সুলতানি যুগে সামাজিক বিভেদ
- (১) ইসলাম ধর্মাবলম্বী সকল ব্যক্তি ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ ছিল। তথাপি বাস্তব ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক বিভেদ ছিল। ডঃ সতীশ চন্দ্র-এর মতে “তুর্কী শাসনের যুগে মুসলিম সমাজ জাতিগত ও বংশগত এই দুভাগে বিভক্ত ছিল।
- (২) তুর্কী, ইরানী আফগানীরা নিজেদের বিজেতা ও শাসক জাতি বলে মনে করত। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিমদের তারা নীচু চোখে দেখত। সতীশচন্দ্রের মতে, এই দুই শ্রেণীর মধ্যে কদাচিৎ পরস্পরে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হতো।
- (৩) বিজেতা ও শাসক জাতি হিসেবে তুর্কীরা ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করত। পারসিক ও অন্যান্য বহিরাগত মুসলিম তুর্কী শাসকদের সাহায্যকারীরূপে উচ্চ পদ ভোগ করত। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে খলজী বিপ্লবের পর তাজিক ও তুর্কীদের একচ্ছত্র প্রাধান্যের অবসান হয়।
সুলতানি যুগের সমাজে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান
দিল্লির সুলতানী যুগে মুসলিম সমাজের অপর অংশ ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান। তারা ছিলেন ধর্মান্তরিত হিন্দু অথবা তাদের বংশধর। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সুলতানি সাম্রাজ্য-এর বিস্তার হলে এঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
সুলতানি যুগে বেরাদরী আন্দোলন
ভারতে সুলতানি শাসনের গোড়ার দিকে “বেরাদরী” আন্দোলন নামে এক আন্দোলন চলে। হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের লোকেরা যারা হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বলে গণিত হতেন, তাদের অনেকে ইসলামের সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এছাড়া আরও নানা কারণে বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
দিল্লির সুলতানি যুগের সমাজে ভারতীয় মুসলিমদের উন্নতি
- (১) ইলবারী তুর্কী শাসনের সময় ভারতীয় মুসলিমদের তুর্কীরা জাতিগত গোঁড়ামি ও ক্ষমতার লোভে নীচু চোখে দেখতেন। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে খলজি বিপ্লবের পর এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বহু উচ্চপদে ভারতীয় মুসলিমদের নিয়োগ করেন। তার অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি মালিক কাফুর ছিলেন ধর্মান্তরিত হিন্দু।
- (২) মোট কথা, খলজি বংশ ও তুঘলক বংশ-এর সুলতানরা বাস্তব দৃষ্টি নিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি অনেকটা সুবিচার করেন। সুলতান মহম্মদ তুঘলক ছিলেন অনেকটা মুক্ত দৃষ্টির মানুষ। তার আমলে নিম্নশ্রেণীর মুসলিমরা যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চপদ পেতেন।
সুলতানি যুগে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথার প্রভাব
- (১) ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে হিন্দু জাতিভেদ প্রথার প্রভাব পড়েছিল। ইসলামে ধর্মান্তরিত হলেও ধর্মান্তরের আগে তাঁরা কোন সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন সেকথা মনে রেখে তাদের সামাজিক মর্যাদা স্থির করা হত।
- (২) সুলতানি যুগে মুসলিমরা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভক্ত ছিলেন। শিয়া, সুন্নী, ইসমাইলি প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলিম ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিভেদ ছিল বিস্তর এবং এজন্য রেষারেষি কম ছিল না।
সুলতানি যুগের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি
দিল্লির সুলতানি যুগে পেশা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। যেমন –
- (১) সামরিক বৃত্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী অভিজাত শাসকশ্রেণী। এদের উপাধি ছিল মালিক, আমীর, খান, সিপাহসালার ও সর-ই-খেল প্রভৃতি। এদের মধ্যে খান ছিল শ্রেণী হিসেবে সর্বোচ্চ, তারপর মালিক। সর্বনিম্নে ছিল সর-ই-খেল।
- (২) মুসলিম অভিজাতরা প্রচণ্ড বিলাসিতা ও আড়ম্বরের মধ্যে বাস করতেন। তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল তৎকালীন বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। সুলতান নিজে ছিলেন অভিজাত শিরোমণি। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ রাজ প্রাসাদে বাস করতেন।
- (৩) মহম্মদ তুঘলকের দরবারে ঢুকতে হলে তিনটি বিশাল ফটক পার হয়ে তার হাজার থামে শোভিত দরবারে আসতে হত। আমীর ওমরাহরাও নিজ নিজ প্রাসাদ তৈরি করতেন। মহম্মদ তুঘলক তাঁর আমীর ওমরাহদের প্রতি শীত ও গ্রীষ্মে দুগ্রস্থ দামী পোষাক দিতেন।
- (৪) এই পোষাকগুলি কিংখাব, মখমল, রেশম, সোনা-রূপার সুতা দ্বারা শোভিত থাকত। ফিরোজ শাহ তুঘলক তার কোষাধ্যক্ষকে আদেশ দেন যে, যেখানে যত সুন্দর মূল্যবান জিনিষ আছে তা যেন ক্রয় করে ভাণ্ডারে রাখা হয়।
সুলতানি যুগের সমাজে মুসলিম অভিজাত
- (১) মুসলিম অভিজাতরা বিবাহ ও অন্যান্য উৎসবে বিরাট খরচ করে ভোজ দিতেন। সুলতানরা অভিজাতদের প্রচুর বেতন দিতেন। একমাত্র আলাউদ্দিন কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। ফিরোজ তুঘলকের উজীর খান-ই-জাহান বছরে ১৫ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন।
- (২) কর্মচারী বশির ১৩ কোটি টাকা সঞ্চয় করে। এই টাকা ছিল ফিরোজের ২ বছরের মোট রাজস্বের সমান। ডঃ তারাচাঁদের মতে যেহেতু অভিজাতরা রাষ্ট্রকে ফাকি দিয়ে সম্পদ বাড়াতেন, সেহেতু তাদের মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিত।
- (৩) ডঃ সতীশচন্দ্র এই মত মানেন না। তাঁর মতে অভিজাতরা তাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যেতেন। সুলতান ও অভিজাতদের বহু পত্নী ছিলেন। বেগমরা হারেমে বাস করতেন।
ভারতে সুলতানি যুগের সমাজে উলেমা
- (১) উলেমা শ্রেণী ছিল এক বিশিষ্ট ধর্মীয় শ্রেণী। এঁরা ছিলেন ইসলামীয় শাস্ত্র ও আইনে সুপণ্ডিত। এরাই ছিলেন শরিয়তের ব্যাখ্যাকার এবং রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী চলত।
- (২) উলেমারা সরকারী বিচার বিভাগীয়, শিক্ষা ও ধর্মীয় পদগুলি ভোগ করতেন। অনেকে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। সুলতানি যুগের বেশীরভাগ ঐতিহাসিক ছিলেন এই শ্রেণীর লোক। শরিয়তের ব্যাখ্যাকার ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের প্রবক্তারূপে মুসলিম সম্প্রদায়ে তাঁরা বিশেষ প্রভাব ভোগ করতেন।
- (৩) কিন্তু উলেমাশ্রেণীর একাংশের ভণ্ডামি ও ক্ষমতার লোভের জন্য আলাউদ্দিন প্রমুখ সুলতান তাদের গুরুত্ব দিতেন না। সৈয়দ ও সুফীরা তাদের পাণ্ডিত্য ও উদারতার জন্য জনপ্রিয়তা পেতেন।
সুলতানি যুগের সমাজে নিম্নশ্রেণি
সবার নীচে ছিলেন মুসলিম দোকানদার, কারিগর, দর্জি ও কৃষক শ্রেণী। এঁরা বিশেষ ক্ষমতা বা অর্থের অধিকারী ছিলেন না। এঁদের অনেকেই ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম। এঁরা অনেকে রাজকীয় কারখানাতেও কাজ করতেন।
সুলতানি যুগের সমাজে হিন্দু সম্প্রদায়
দিল্লির সুলতানি সমাজের বৃহত্তর অংশ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়। তুর্কী আক্রমণের আগে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই ছিলেন শাসক সম্প্রদায়, ভূমি অর্থ সম্পত্তির মালিক। তুর্কী আক্রমণের হিন্দুদের জীবিকা ও পরেও কৃষি জমির বৃহত্তর ভাগ ছিল তাদের হাতে।
সুলতানি যুগে কৃষি ও রাজস্ব ব্যবস্থার স্তম্ভ
হিন্দু কৃষক, গ্রামীণ হিন্দু জমিদার ও বংশানুক্রমিক রাজস্ব সংগ্রাহক খুৎ, মুকাদ্দমরাই কৃষি ও রাজস্ব ব্যবস্থার স্তম্ভ ছিলেন। ইলবারী তুর্কী আমলে হিন্দুরা কোনো উচ্চ রাজপদ পেতেন না। তবে রাজস্ব বিভাগে খুৎ, মুকাদ্দম পদে তাঁরা কাজ করতেন। কৃষি, বাণিজ্য ছিল তাদের প্রধান জীবিকা।
সুলতানি যুগের সমাজে ধনী বণিক
- (১) আলাউদ্দিনের আমল থেকে কোনো কোনো হিন্দু উচ্চপদ পান। হিন্দু অভিজাত ও ধনী বণিকরা বিলাস-ব্যসন ও আড়ম্বরের মধ্যে মুসলিম অভিজাতদের মতই বাস করতেন।
- (২) সুলতানি বণিকরা ছিল ভয়ানক ধনী। এরা ছিল হিন্দু। গুজরাটি ও মারোয়াড়ীরাও ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা ধনী হয়। ক্যাম্বে বন্দরে এই শ্রেণীর বহু বণিক ছিল। তারা মন্দির নির্মাণ করেছিল।
- (৩) ধনী হিন্দু বণিকদের জীবনযাত্রা শুধু আরামপ্রদ ছিল না। ফলের বাগানওয়ালা বড় বড় বাড়িতে তারা বাস করত। সুতো ও রেশমের পোষাক তারা পরত। গ্রীষ্মকালে তারা দেহে চন্দন লেপত। কোমরে সোনার কোমরবন্ধ, কানে হীরা খচিত দুল এবং হাতে আংটি তারা পরত।
- (৪) বণিক পরিবারের নারীরা বহু মূল্যের রত্নখচিত গহনা, রেশমের কাপড় পরত। মুসলিম বণিকরাও রত্নখচিত পোষাক পরত। ধনী হিন্দু বণিকদের বহু দাস ও দারোয়ান থাকত। বরণী বলেছেন যে, সুলতানী বণিকদের গৃহে প্রচুর সোনা-রূপা জমা থাকত। অমিতব্যয়ী মুসলিম অভিজাতরা ভোজ বা উৎসবের জন্যে সুলতানিদের কাছে টাকা ধার করতেন।
সুলতানি যুগের সমাজে হিন্দু কৃষক
হিন্দু কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন করত এবং রাজস্ব দিত বলে সুলতানরা তাদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতেন ও তাদের ওপর নির্যাতনের বিরোধিতা করতেন। হিন্দুরা রাজস্ব বিভাগে বিভিন্ন পদ পেত। কারণ এই কাজে তারা পারদর্শী ছিল।
সুলতানি যুগের সমাজে ক্ষত্রিয় শ্রেণি
বাঞ্জারা শ্রেণী সেনাদলে মাল ও খাদ্য পরিবহন করত। ক্ষত্রিয় শ্রেণীর আগের মত প্রতিপত্তি না থাকলেও, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন দেশীয় রাজা বা রায় ও জমিদার। তারা ঘোড়া বা হাতিতে চড়তেন। অস্ত্র বহন করতেন।
সুলতানি যুগের সমাজে নিম্নশ্রেণি
শূদ্র বা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অবস্থা আগের মতই কষ্টকর ছিল। অস্পৃশ্যতা ও বর্ণভেদের জন্য তারা ছিল সমাজে নির্যাতিত শ্রেণী।
সুলতানি যুগের সমাজে জাতিভেদ প্রথা
- (১) হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা তীব্র ছিল। হিন্দুদের মধ্যে বহু মিশ্র বা সঙ্কর জাতি ছিল। এজন্য আহার ও বিবাহে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্পৃশ্যতার প্রথা তীব্রতর হয়। হিন্দু সমাজে জাতিভেদ, সতীদাহ, জহরব্রত, বাল্যবিবাহ, কন্যাসন্তানের প্রতি অবহেলা প্রবল ছিল।
- (২) নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ, বাল্য-বিবাহ প্রভৃতি চলত। হিন্দু সমাজে পুরুষের বহুবিবাহ প্রথার চলন ছিল। মুসলিম সমাজে শরিয়ত-সম্মত ৪ বিবাহ এবং নিকাহ করা যেত। হিন্দু সমাজে দেবদাসী প্রথার চলন ছিল।
ভারতে সুলতানি যুগের সমাজে পর্দাপ্রথা
- (১) উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম পরিবারে নারীদের মধ্যে পর্দাপ্রথা ছিল। মুসলিমদের আগমনের আগেই উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নারীদের পর্দার আড়ালে রাখত। অশোকের শিলালিপিতে ‘অবরোধন’ বা অন্তপুরে স্ত্রীলোকদের থাকার কথা বলা হয়েছে।
- (২) যদিও অজন্তার চিত্রে দেখা যায় যে পরিবারের নারীরা অলিন্দ থেকে শোভাযাত্রা দেখছেন, তথাপি স্ত্রীলোকদের নানা বাধা নিষেধে আটক রাখা হত। সতীশচন্দ্রের মতে, অপরিচিত লোকের সামনে নারীরা মুখে ঘোমটা দিতেন।
- (৩) আরব ও তুর্কীরা ভারতে আসার পর সতীশচন্দ্রের মতে পরদা প্রথার ব্যাপকতা বাড়ে। যদিও এক শ্রেণীর লেখক বলেন যে, বিদেশীদের হাত থেকে বাচাবার জন্যই হিন্দু রমনীদের পর্দার আড়ালে রাখা শুরু হয়, এই মত ঠিক মনে হয় না।
- (৪) সমাজে যারা উচ্চশ্রেণীর লোক ও অভিজাত তারা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পর্দা চালু করেন। এই প্রথাকে বাধ্যতামূলক করার জন্য ধর্মীয় অনুশাসন জুড়ে দেওয়া হয়। মুসলিম সমাজে মোল্লারা বোরখা পরা আবশ্যিক বলে ঘোষণা করেন।
- (৫) ডঃ তারাচাঁদের মতে, রক্ষণশীল মুসলিম নেতারা নারীদের অধিকার ছাঁটাই করতে তৎপর ছিলেন। তবে নিম্নশ্রেণীর নারীরা পর্দা মানতেন না। তারা সর্বত্র পুরুষের সহকর্মিনী ছিলেন, বিশেষত হিন্দু সমাজে।
সুলতানি যুগের সমাজে নারীর অবস্থা
- (১) আমীর খসরুর মত কবি তাঁর কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ায় খেদ প্রকাশ করেন। সেখ নিজামুদ্দিন আওলিয়া নাকি বলেছিলেন যে, নারীদের স্বাধীনতা দিলে কিয়ামতের দিন ঘনিয়ে আসবে (Quoted by Dr. Tarachand Gazetter of India)।
- (২) রাজিয়া ও রূপমতীর মত সৌভাগ্যবতী নারীর সংখ্যা বেশী ছিল না। সামগ্রিকভাবে হিন্দু ও মুসলিম নারীদের দমিয়ে রাখার প্রবণতা ভীষনভাবে ছিল। হিন্দু সমাজে নারীদের সতীদাহ, জহর পালন করতে হত। হিন্দু আইনে বিধবাকে স্বামীর সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হলেও কাজে তা সফল খুব কমই হত।
সুলতানি যুগের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির লোক
দিল্লি সুলতানি যুগে বেশীর ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করলেও বেশ কিছু লোক শহরে বাস করত। শহরগুলিতে নানা শ্রেণীর লোক থাকত। যথা – অভিজাত, সরকারী কর্মচারী, কেরানী, কারিগর, ব্যবসায়ী প্রভৃতি।
সুলতানি যুগে ক্রীতদাস প্রথা
- (১) শহরের লোকেদের বাড়িতে এবং অভিজাত ও রাজপরিবারের অধীনে বহু ক্রীতদাস ছিল। ভারতে ইসলাম আসার আগেই দাসপ্রথা ছিল। হিন্দুশাস্ত্রে দাসপ্রথার উল্লেখ আছে। তুর্কী শাসন চালু হলে দাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
- (২) যুদ্ধবন্দীদের এই যুগে দাসে পরিণত করা হত। তাছাড়া পশ্চিম এশিয়ার দাসের বাজার থেকে দাসদের ক্রয় করা হত। হাবসী ক্রীতদাসদের ভীষণ কদর ছিল। তুর্কী, আরব, গ্রীক ও হাবসী ছাড়া বহু ভারতীয় ক্রীতদাস এই যুগে ছিল। পুরুষ ও নারী উভয়কেই দাস বা দাসীতে পরিণত করা হত।
- (৩) সাধারণ লোকে পরিবারের কাজের জন্য গৃহদাস রাখত। কারিগরী বিদ্যায় দক্ষ ক্রীতদাসের দাম ছিল বেশী। উপপত্নী হিসেবে সুন্দরী দাসী ক্রয় করা হত। ইবন বতুতা নিজে এরূপ একটি দাসী কিনেছিলেন।
- (৪) সুলতানরা তাদের যুদ্ধের ও রাজ্য পরিচালনার কাজের জন্য দক্ষ, গুণবান, যোগ্য দাস ক্রয় করতেন। এদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত। সুলতান তাদের পুত্রবৎ লালন করতেন। কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, বলবন প্রথম জীবনে এই রকম দাস ছিলেন।
- (৫) আলাউদ্দিন খলজির দাস মালিক কাফুর ভয়ানক ক্ষমতাশালী ছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকের দাসের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৮০ হাজার। তিনি দাসদের বিশেষ মূল্যবান সম্পদ বলে মনে করতেন। সাধারণভাবে গৃহদাসদের অবস্থা ভালই ছিল। মালিকরা তাদের খাদ্য, পোষাক ও আশ্রয় দিতেন। মুক্তিপণ দিলে দাসকে ছেড়ে দেওয়া হত।
সুলতানি যুগে মানুষের খাদ্য
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্যের অভ্যাসে তফাৎ ছিল। হিন্দুরা ছিল বেশীর ভাগ নিরামিষ ভোজী, মুসলিমরা মাংস ভক্ষণ করতে ভালবাসত। সুফী ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের মধ্যে অনেকে নিরামিষ খাদ্য খেত। কোরাণে মদ্যপান নিষিদ্ধ হলেও মুসলিমদের মধ্যে সুরাপান চলত। হিন্দুদের মধ্যে সুরাপানের অভ্যাস ছিল।
সুলতানি যুগের সমাজে বসবাস
ধনী হিন্দু-মুসলিমরা নগরে বসবাস করত এবং বিলাসময় জীবনে অভ্যস্ত ছিল। দরিদ্র লোকেরা গ্রামে মাটির ঘরে বাস করত।
সুলতানি যুগের অধিবাসীদের পোষাক
তুলা, রেশম, পশমের পোষাক হিন্দু-মুসলিম সকলেই পরত। সোনা, রূপার অলঙ্কার ব্যবহার করা হত।
সুলতানি যুগের সমাজে আমোদ-প্রমোদ
আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে শিকার, কুস্তি, বিভিন্ন পশুর যুদ্ধ ক্রীড়া, পোলো বা চৌঘান ছিল প্রিয়। এছাড়া দোলযাত্রা বা হোলি, দীপাবলি, দশেরা, ইদ, নৌরোজ, শবেরাত প্রভৃতি উৎসব-এ লোক আনন্দ করত।
সুলতানি যুগের সমাজে সাধারণ লোকের দুরবস্থা
- (১) মধ্যযুগে খাদ্যশস্যের দর কম থাকলে সাধারণ লোকে পেট ভরে খেতে পেত। আলাউদ্দিন খলজি, ফিরোজ তুঘলক ও ইব্রাহিম লোদীর আমলে খাদ্যশস্যের দাম কমই ছিল। ৫ জন সদস্যসহ একটি পরিবারের খাই-খরচা পড়ত মাসে ৫ টঙ্কা।
- (২) সৈনিকরা যেহেতু ২৩৪ টঙ্কা বার্ষিক বেতন পেত, তাদের অবস্থা ছিল বেশ স্বচ্ছল। কিন্তু শ্রমিক, কারিগরের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। অথচ অভিজাতরা বিলাসে-বৈভবে দিন কাটাত। সুতরাং সতীশচন্দ্রের মতে, “মধ্য যুগের সমাজ ছিল বৈষম্যমূলক”।
উপসংহার :- রক্ষণশীল হিন্দু বা মুসলিমরা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে গণ্ডীর মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেন, কিন্তু দীর্ঘকাল পাশাপাশি বাস করার জন্য হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বহু আদান-প্রদানের ফলে হিন্দুস্থানী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
(FAQ) সুলতানি যুগের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র।
আলাউদ্দিন খলজি, ফিরোজ শাহ তুঘলক ও ইব্রাহিম লোদী।
মহম্মদ বিন তুঘলক।
অলবিরুণি।