ঋকবৈদিক যুগের সমাজ জীবন প্রসঙ্গে শ্রেণি বা বর্ণ, বংশানুক্রমিক জাতিভেদ প্রথার অনুপস্থিতি, পরিবার, বাসস্থান, খাদ্য, পানীয়, পোশাক, অবসর বিনোদন, নারীর অবস্থা ও চতুরাশ্রম প্রথা সম্পর্কে জানবো।
আর্যদের ঋকবৈদিক যুগের সমাজ জীবন
ঐতিহাসিক ঘটনা | ঋকবৈদিক যুগের সমাজ জীবন |
সভ্যতা | বৈদিক সভ্যতা |
শ্রেণি | চারটি |
পরিবারের প্রধান | গৃহপতি |
প্রথা | চতুরাশ্রম |
ভূমিকা :- ঋকবৈদিক যুগ -এ সমাজ জীবন ছিল সহজ, সরল, জটিলতামুক্ত। কালক্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, বস্তুগত জীবনের রূপান্তর ইত্যাদি নানা কারণে পরবর্তী বৈদিক যুগ -এর সমাজে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
ঋকবৈদিক যুগে শ্রেণি বা বর্ণ
- (১) আর্যরা ভারত -এ যখন প্রবেশ করে তখন তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল – যোদ্ধাশ্রেণী বা রাজন্য, ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণী ও সাধারণ আর্যরা। কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন যে, আর্যরা ভারতে আসার আগে যখন পারস্যে বাস করত তখনই “বর্ণ” বা শ্রেণী প্রথার উদ্ভব হয়।
- (২) প্রাচীন পারসিক সাহিত্যে এই বর্ণ প্রথার কথা জানা যায়। আর্যরা ভারতে এই প্রথা নিয়ে আসে। এখানে বর্ণ বলতে শ্রেণী মনে করা দরকার, জাতি অর্থে নয়। ঋগ্বেদ -এ ‘বর্ণ’ শব্দটির উল্লেখ দেখা গেলেও, তখন পর্যন্ত জাতি অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করা হত না।
- (৩) কৃষ্ণকায় অনার্য হতে গৌরবর্ণ আর্যদের পার্থক্য বুঝাবার জন্যে ‘বর্ণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হত। যে তিনটি শ্রেণীতে আর্যরা বিভক্ত তা ছিল অর্থনৈতিক শ্রেণী। ঐতিহাসিক বাসাম, কোশাম্বি প্রমুখ বর্ণ কথাটি ঋকবেদের যুগে জাতিবাচক ছিল না বলে মনে করেন।
- (৪) বাসামের মতে, ঋকবেদের আর্য সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য ছিল। আর্যদের সমাজে তিনটি শ্রেণী ছিল – ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত, রাজন্য বা যোদ্ধা এবং বৈশ্য। শ্রেণীবিভাগ বংশানুক্রমিক ছিল না। বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্বিবাহ ব্যবস্থা চালু ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।
- (৫) ব্রাহ্মণ পুরুষ, রাজন্য বা ক্ষত্রিয় নারীকে বিবাহ করত এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। পুরোহিত রাজার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত। ঋকবেদে ‘ক্ষত্রিয়’ শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় না। এর পরিবর্তে ‘রাজন্য’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
ঋকবৈদিক যুগে বংশানুক্রমিক জাতিভেদ প্রথার অনুপস্থিতি
- (১) অনেকেই বলেন যে, ঋকবেদের যুগে আর্যরা চারটি জাতিতে বিভক্ত ছিল। তাঁরা ঋকবেদের পুরুষসূক্তের উল্লেখ করেন। পুরুষসূক্তে বলা হয় যে, “আদি পুরুষ বা ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদেশ থেকে বৈশ্য এবং তাঁর পদযুগল থেকে শূদ্রের উদ্ভব হয়।”
- (২) সমালোচকদের মতে, পুরুষ সূক্তের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, এই সূক্তটি পরের যুগে রচনা করে ঋকবেদে অনুপ্রবেশ করান হয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, ঋকবেদের যুগে আর্যদের মধ্যে বংশানুক্রমিক জাতিভেদ প্রথার প্রচলন ছিল না।
- (৩) যদিও আর্য সমাজে ব্রাহ্মণ ও রাজন্য শ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশী ছিল, তথাপি বিশ বা জনসাধারণ যে কোনো শ্রেণীতে স্থান পেতে পারত। তাতে কোনো বাধা ছিল না। ঋকবেদের যুগে অস্পৃশ্যতা বা খাদ্যের ব্যাপারে ছোঁয়ার কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না।
- (৪) ঋকবেদের যুগে যখন আর্যরা পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে বাস করত তখন তারা শ্রেণী বা বর্ণতে বিভক্ত হলেও জাতিতে বিভক্ত ছিল না। পরে তারা পূর্ব ভারতে গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলে বসবাস প্রসার করে। সেই সময় এবং তা হয়ত ঋকবেদের শেষের দিকে অথবা পরবর্তী বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব হয়।
ঋকবৈদিক যুগে পরিবার
ঋকবেদের সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের প্রাধান্য ছিল। পরিবারগুলি ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের সর্বাপেক্ষা বয়স্ক পুরুষ কর্তা বা গৃহপতি হিসাবে গণ্য হত। পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহী ও অন্যান্য পরিজনসহ পরিবার গঠিত হত। পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধন ছিল। গৃহপতি বা পরিবারের কর্তা পারিবারিক সম্পত্তির আয় থেকে পরিবারের সকলের খাদ্য, পরিধেয় প্রভৃতি যোগাত।
ঋকবৈদিক যুগে মানুষের বাসস্থান
ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে গ্রামে স্থায়ী বসবাস অভ্যাস করে। প্রতি পরিবারের স্থায়ী গৃহ থাকত। সাধারণত গৃহগুলি বাঁশ, খড় দ্বারা তৈরি করা হত। পরবর্তী যুগে মাটির দেওয়াল দ্বারা গৃহ নির্মাণের প্রথা চালু হয়। প্রতি গৃহে একটি করে অগ্নিকুণ্ড থাকত। এই অগ্নিকুণ্ড পোড়ামাটির ইটের দ্বারা তৈরি করা হত।
ঋকবৈদিক যুগে অধিবাসীদের খাদ্য
আর্যরা খাদ্য হিসেবে প্রধানত যব, গম ব্যবহার করত। তারা চাউল ও চাউল-জাত দ্রব্যও খেত। দুধ এবং দুধজাত দ্রব্য বিশেষত, ঘি, মাখন প্রভৃতি তাদের প্রিয় খাদ্য ছিল। পুরোডাশ বা পিঠা ছিল আর্যদের প্রিয় খাদ্য। মাছ, মাংস বিশেষত, ঘোড়ার মাংস, ছাগলের মাংস ও পাখির মাংস তারা আহার করত। গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। তবে ঋকবেদে দুগ্ধবতী গাভী হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। তরিতরকারী, ফলমূল ছিল আর্যদের দৈনন্দিন খাদ্য।
ঋকবৈদিক যুগে অধিবাসীদের পানীয়
আর্যরা সুরা বা মদ্য পান করত। বিশেষ উৎসবে সোমরস নামে এক লতার রস মাদক দ্রব্য হিসেবে পান করত। তবে সুরাপান সমাজে নিন্দনীয় ছিল।
ঋকবৈদিক যুগে অধিবাসীদের পোশাক
আর্যরা সূতী ও পশমের বস্ত্র ব্যবহার করত। বিশেষ উৎসব বা ধর্মীয় কারণে ক্ষৌমবস্ত্র এবং ‘দুকুল’ নামে মিহি রেশমের বস্ত্র ব্যবহার করা হত। পুরুষেরা নিম্নাঙ্গে ধুতি ও ঊর্ধ্বাঙ্গে উত্তরীয় ধারণ করত। নারীরা দুই প্রস্থ পোষাক ছাড়া ‘নীবি’ বা কোমরবন্ধনী ব্যবহার করত। নারীরা সোনা ও রূপার অলঙ্কার এবং দামী পাথরের অলঙ্কার ব্যবহার করত। নারীরা নানা ছাঁদে কবরী বাঁধত এবং তাতে চিরুনী ও তেল দিয়ে প্রসাধন করত।
ঋকবৈদিক যুগে অধিবাসীদের অবসর বিনোদন
আর্যরা তাদের অবসর সময় পাশাখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, রথের দৌড় ও সঙ্গীতের চর্চায় কাটাত। পাশাখেলার দ্বারা জুয়াখেলার প্রচলন হয়। সমাজে জুয়াখেলা নিন্দনীয় হলেও বহুলোক এর প্রলোভনে পড়ত। ঋকবেদে জুয়াখেলাকে একটি ক্ষতিকারক ব্যাসন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু লোক জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হত। আর্যদের সঙ্গীত ও চারুকলার দিকে ঝোঁক ছিল। বাঁশী, বীণা ও ঢোলক সহ তারা নৃত্যগীত করত। সামবেদকে গানের আকারে গাওয়া হত। নৃত্য ও সঙ্গীতে তাল, মাত্রা ও রাগ-রাগিনীর বিন্যাস করা হত। পেশাদারী নর্তকীরা নৃত্যকলায় পারদর্শিনী ছিল।
ঋকবৈদিক যুগে নারীর অবস্থা
- (১) ঋকবেদের সমাজে নারীরা সম্মানিতা ছিল। যদিও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের জন্য লোকে পুত্রসন্তান আকাঙ্খা করত, তবুও কন্যা জন্মলাভ করলে তাকে অবহেলা করা হত না। বৈদিক স্তোত্রের রচয়িতা হিসেবে ঘোষা, বিশ্ববারা, অপালা, লোপামুদ্রা খ্যাতি লাভ করেন।
- (২) নারীরা পুরুষের সঙ্গে সকল কাজকর্ম করত। পর্দা প্রথার দ্বারা তাদের গৃহকোণে আটকান হত না। স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ধর্মাচরণে অংশ নিতে পারত। গৃহস্থালীর পরিচালনায় গৃহকর্ত্রীর আধিপত্য ছিল। বাল্যবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর পরস্পরের পছন্দকে বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হত। নারীরা কখনও কখনও নিজ পতি নির্বাচন করে স্বয়ম্বরা হত এবং সমাজে তা স্বীকৃত প্রথা ছিল।
- (৩) পণপথা ও কন্যাপণ প্রথা উভয় নিয়মই প্রচলিত ছিল। পুরুষেরা কখনও কখনও বহু বিবাহ করত। নারীরা বহু বিবাহ করত না। সন্তানহীনা বিধবা ভ্রাতৃবধুকে বিবাহ করার প্রথা প্রচলিত ছিল। এই যুগে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত না থাকলেও, প্রতীকী সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। নারীদের নৈতিক চরিত্র পুরুষদের তুলনায় উঁচু ছিল।
ঋকবৈদিক যুগে চতুরাশ্রম প্রথা
- (১) ঋকবেদে আর্য জীবনধারায় চতুরাশ্রম বা চারটি আশ্রমের কথা জানা যায়। সমাজের প্রথম তিন শ্রেণীর মধ্যে এই প্রথার প্রচলন ছিল। বাল্যে ও কৈশোরে গুরুগৃহে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন ও বিদ্যাচর্চা করা ছিল প্রথম পর্যায়। সাহিত্য, ব্যাকরণ, ছন্দ ও বেদ শিক্ষা ছিল গুরুগৃহে শিক্ষার অঙ্গ।
- (২) যৌবনে বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালন বা গার্হস্থ্য আশ্রম যাপন ছিল দ্বিতীয় পর্যায়। প্রৌঢ় অবস্থায় বানপ্রস্থ অবলম্বন ছিল তৃতীয় আশ্রম। এই সময় সংসার, সম্পত্তি, পরিজনদের প্রতি মায়া ত্যাগ করে পরলোক চিন্তা এবং অরণ্যে বাস ছিল কর্তব্য। সর্বশেষে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ ছিল চতুর্থ আশ্রম। এই সময় ইহলৌকিক বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে ঈশ্বর চিন্তা করা এবং সন্ন্যাস জীবন নিয়ে পরিব্রাজকের মত ভ্রমণ ছিল সন্ন্যাসীর কর্তব্য।
উপসংহার :- আর্যদের সাহিত্য ও ব্যাকরণ প্রভৃতি থাকলেও, লেখবার হরফ বা লিপি তাদের গোড়ার দিকে ছিল না। আর্যরা আবৃত্তির দ্বারা তাদের সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখত। আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বে আর্যরা সর্বপ্রথম লিপির ব্যবহার শিখে।
(FAQ) ঋকবৈদিক যুগের সমাজ জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চতুরাশ্রম প্রথা।
যব ও গম।
অপালা, লোপামুদ্রা।
গৃহপতি।