ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন

ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন প্রসঙ্গে কৃষি, লোহার ব্যবহার, জমির মালিকানা, পশুপালন, বিভিন্ন শিল্প, অভ্যন্তরীন বাণিজ্য, মুদ্রা ব্যবস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও দাসপ্রথা সম্পর্কে জানবো।

আর্যদের ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন

ঐতিহাসিক ঘটনাঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন
সভ্যতাবৈদিক সভ্যতা
জীবিকাকৃষি ও পশুপালন
প্রধান ফসলযব
মুদ্রামনা ও নিস্ক
ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন

ভূমিকা :- যে কোনো সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজ গঠনের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। ঋগ্বেদ -এর সমাজে কৃষি ও পশুপালন ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা। এই দুই জীবিকাকে অবলম্বন করে আর্যদের জীবন-যাত্রা চলত।

ঋকবৈদিক যুগে কৃষি ও পশুপালন নিয়ে মতভেদ

ঋকবৈদিক যুগ -এ কৃষি ও পশুপালন এই দুই জীবিকার মধ্যে কোনটি প্রধান ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। বেশীরভাগ পণ্ডিত বলেন যে, কৃষিই ছিল ঋকবৈদিক আর্যদের প্রধান জীবিকা। এই যুগে আফগানিস্তান হতে উত্তর প্রদেশের সরযূ নদী পর্যন্ত আর্যদের বসতি বিস্তার লাভ করেছিল।

ঋকবৈদিক যুগে কৃষি

  • (১) এই যুগে ধানের চাষকে প্রাধান্য দেওয়া হত না। কারণ ঋকবেদে ধান বা “ব্রীহি” শব্দটির উল্লেখ দেখা যায় না। ‘যব’ শব্দটি এক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যব বলতে ধানকেও বোঝাত। আর্যরা ভারতে আসার আগে হয়ত ধানের চাষ জানত না। তারা এদেশে আসার পর এদেশের অনার্যদের কাছে ধানের চাষ শিখে নেয়।
  • (২) ধানকেও তারা যব বলত। যব ছিল খাদ্যশস্যের সাধারণ নাম। ঋকবেদে ‘গোধূম’ বা গমেরও নাম দেখা যায় না। যব কথাটি বলতে ধান, গম, সকল প্রকার খাদ্যশস্য বোঝান উচিত। আবার কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, ঋকবেদের যুগে ধানের চাষ হত না। ঋকবেদে লবণের উল্লেখ নেই।

ঋকবেদের যুগে লোহার ব্যবহার

  • (১) ঋকবেদের যুগে লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গলের দ্বারা জমিকে গভীর করে চাষ করা হত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। লাঙ্গলের নাম ছিল “শীর”। কেউ কেউ বলেন যে, ঋকবেদের যুগে আর্যরা লোহার ব্যবহার জানত না। তারা লৌহপিণ্ড গলাবার পদ্ধতি জানত না।
  • (২) বেশীরভাগ পণ্ডিতের মত এই যে, ঋকবৈদিক আর্যরা লোহার লাঙ্গল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত। গরুর দ্বারা লাঙল টানা হত। জমিতে জলসেচ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এজন্যে জলচক্র ও জলাশয় ব্যবহার করা হত। লোহার অস্ত্র দ্বারা জঙ্গল কাটাই করে নতুন জমি চাষের জন্য তৈরি করা হত।

ঋকবেদের যুগে জমির মালিকানা

(১) ঋকবেদের যুগে জমির মালিকানা ব্যবস্থা বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। ডাঃ এইচ- সি. রায়চৌধুরী বলেন যে, পশুচারণের জমি ছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি। বাস্তু ও আবাদের জমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে। ডি. ডি. কোশাম্বীর মতে, জমি ছিল গ্রামের সমষ্টিগত সম্পত্তি। অনেকে বলেন যে, জমি ছিল পরিবারের সমষ্টিগত সম্পত্তি। পরিবারের প্রধান বা গৃহপতি পরিবারের পক্ষে এই জমির দেখাশোনা করত।

ঋকবেদের যুগে পশুপালন

  • (১) রোমিলা থাপারের মতে, আর্য জাতি যখন ভারত -এ আসে, তখন পশুপালনকেই তারা প্রধান জীবিকা হিসেবে নেয়। পরে তারা কৃষিকার্যে নজর দেয়। যাই হোক, পশুপালন ছিল একটি প্রধান জীবিকা। গরুকে বলা হত গোধন।
  • (২) গরু যাতে হারিয়ে না যায় এজন্যে গরুগুলির কানে নানারকম সাঙ্কেতিক চিহ্ন দেওয়া থাকত। এই যুগে আর্য গোষ্ঠিগুলি পরস্পরের গরু লুঠ করত। সোনা-রূপার মত তখন গরুকে মূল্যবান মনে করা হত। কার কত গরু আছে তার দ্বারা সেই ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার বিচার হত।
  • (৩) কোনো দ্রব্যের মূল্য গরুর দামের দ্বারা স্থির করা হত। গঙ্গা-যমুনার উপত্যকায় গোচারণের প্রচুর সুবিধা ছিল। গরু ছাড়া ঘোড়া, ভেড়া প্রভৃতি পশুকেও পালন করা হত। ঘোড়া যেহেতু রথ টানা ও যুদ্ধের কাজে ব্যবহার হত এজন্য ঘোড়াকেও মূল্যবান মনে করা হত।

ঋকবেদের যুগে বিভিন্ন শিল্প

কৃষি ও পশুপালন ছাড়া কাঠের মিস্ত্রীর কাজ (সূত্রধর) বেশ লাভজনক ছিল। রথ, লাঙ্গল, গৃহ প্রভৃতি নির্মাণের জন্য কাঠের মিস্ত্রীর খুব চাহিদা ছিল। এছাড়া চর্মকার, কুম্ভকার প্রভৃতির কাজও লোকে করত। হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার মতই বৈদিক যুগে বস্ত্র বয়ন ছিল একটি বড় শিল্প। তামার ও ব্রোঞ্জের কাজও কিছু লোক করত। ঋকবেদের যুগে লোহার প্রচলন ছিল না বলে কেউ কেউ মনে করেন। অপরদিকে অনেক পণ্ডিত ঋকবেদের যুগে লোহার অস্ত্রশস্ত্র, লাঙ্গল ও যন্ত্রপাতি তৈরি হত বলে মনে করেন।

ঋকবেদের যুগে অভ্যন্তরীন বাণিজ্য

ঋকবেদে ‘পাণি’ নামে এক শ্রেণীর লোকের কথা জানা যায় যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই দক্ষ ছিল। আর্য বসতি বিস্তারের ফলে আর্যরাও বাণিজ্যে নিযুক্ত হয়। বৈশ্য শ্ৰেণী ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্ৰহণ করে। আর্য গ্রাম ও বসতিগুলির ভেতর বেশীর ভাগ বাণিজ্য চলত। সিন্ধুর শাখানদীগুলি ও যমুনার দুই তীরে অবস্থিত আর্য গ্রামগুলির মধ্যে বাণিজ্য চলত। স্থলপথে রথ বা গরুর গাড়ি ও নদীপথে নৌকায় মাল চলাচল করত।

ঋকবেদের যুগের মুদ্রা ব্যবস্থা

এই যুগে মুদ্রার স্থলে বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য বেশী চলত। কারণ এই যুগে মুদ্রার প্রচলন বেশী ছিল না। ‘নিস্ক’ নামে এক ধরনের স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন ছিল। কিন্তু এই মুদ্রার ওজন ও আকৃতির সমতা ছিল না। রৌপ্য মুদ্রা না থাকায় মুদ্রার সংখ্যা কম ছিল। এজন্য মুদ্রার দ্বারা ক্রয়-বিক্রয়ের অসুবিধা দেখা দেয়।

ঋকবেদের যুগে বৈদেশিক বাণিজ্য

  • (১) ঋকবেদের যুগে আর্যরা সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্য করত কিনা এ সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। ঋকবেদে ‘মনা’ নামে এক প্রকার মুদ্রার উল্লেখ আছে। ‘মনা’ ছিল প্রাচীন ব্যাবিলনের মুদ্রা। এ থেকে অনেকে মনে করেন যে, পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে আর্যদের বাণিজ্যিক যোগ ছিল।
  • (২) ঋকবেদে বহু দাড়যুক্ত নৌকার কথা উল্লিখিত আছে। সম্ভবতঃ এই নৌকাগুলি ছিল সমুদ্রগামী ‘বহিত্র’। ঋকবেদে এর নাম ছিল “শতঅনিত্র”। কিন্তু এই সামান্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে আর্যদের বাণিজ্যের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি।
  • (৩) বেদ -এ সিন্ধু নদের মোহনা অঞ্চলের কথা উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগে আর্যদের সামুদ্রিক বাণিজ্য করার একমাত্র প্রশস্ত পথ ছিল সিন্ধু নদের মোহনার পথ। এর অনুল্লেখ অর্থবহ। তাছাড়া আর্য সভ্যতা ছিল প্রধানত কৃষিকেন্দ্রিক। আর্য সভ্যতা হরপ্পার মত শিল্পকেন্দ্রিক ছিল না। সুতরাং আর্যদের পক্ষে দেশের মধ্যে অন্তর্বাণিজ্য করাই স্বাভাবিক ছিল।
  • (৪) আর্যদের হাতে উদ্বৃত্ত পণ্য না থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল না। ঋকবেদের যুগে মুদ্রার প্রচলন বা মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন তেমন ছিল না। নিষ্ক বা সোনার মুদ্রার প্রচলন থাকলেও তার সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম।
  • (৫) রূপার মুদ্রা না থাকায় নিত্য ব্যবহারের জন্য মুদ্রা ছিল না। ফলে লোকে গরুকে মূল্য মান হিসেবে ব্যবহার করত। এই ধরনের নীচু মানের অর্থনীতির পক্ষে সামুদ্রিক বাণিজ্য চালান অসম্ভব ছিল।

ঋকবেদের যুগে দাসপ্রথা

বৈদিক যুগে অনার্যদের ‘দস্যু’ বা দাস বলা হত। অনার্য দাসদের চাষবাসের কাজে ব্যবহার করে বাড়তি উৎপাদন করা হত। যুদ্ধে পরাস্ত হলে অনার্যদের দাসে পরিণত করা হত। তাদের জমি, ঘর-বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হত। সকল দাসকে বিজয়ী উপজাতির সম্পত্তি বলে মনে করা হত।

উপসংহার :- এই যুগে লোকেরা সাধারণত গ্রামে খড় ও বাঁশের ঘরে বাস করত। দেশের অধিকাংশ স্থান ছিল গ্রাম ও কৃষিক্ষেত্র। নগর বা শহর বিশেষ কিছু ছিল না। যুদ্ধবিগ্রহের সময় আর্যরা “পুর” নামে এক সুরক্ষিত স্থানে আশ্রয় নিত। ‘পুর’ কথাটির অর্থ পণ্ডিতেরা দুভাবে করে থাকেন – নগর অথবা দুর্গ। আর্যদের জীবনযাত্রা ছিল আড়ম্বরহীন। অর্থনৈতিক দিক হতে তারা ছিল সিন্ধু অধিবাসীদের অপেক্ষা অনুন্নত।

(FAQ) ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের প্রধান জীবিকা কি ছিল?

কৃষি ও পশুপালন।

২. ঋকবৈদিক যুগের মুদ্রার নাম কি?

মনা ও নিস্ক।

৩. ঋকবৈদিক যুগে গোধুম বলতে কি বোঝানো হতো?

গম।

৪. ঋকবৈদিক যুগে শীর কি ছিল?

লোহার লাঙ্গল।

৫. ঋকবেদে সমুদ্রগামী নৌকার নাম কি ছিল?

শত অনিত্র।

Leave a Comment