লোপামুদ্রা

ঋক বৈদিক যুগের বিদুষী নারী লোপামুদ্রা প্রসঙ্গে তার জন্ম কাহিনী, অগস্ত্য ঋষির সাথে তার বিবাহ, আদর্শ নারী চরিত্র লোপামুদ্রা, পাতিব্রত্যের আদর্শে মহীয়সী নারী লোপামুদ্রা, বৈদিক যুগের অতুল্যা নারী লোপামুদ্রা ও তার মন্ত্র রচনা সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী লোপামুদ্রা প্রসঙ্গে লোপামুদ্রার জন্ম কাহিনী, লোপামুদ্রার বিবাহ, লোপামুদ্রার পাতিব্রত, লোপামুদ্রার মন্ত্র রচনা, আদর্শ নারী চরিত্র লোপামুদ্রা ও বৈদিক যুগের অতুল্যা নারী লোপামুদ্রা সম্পর্কে জানব।

ঋক বৈদিক যুগের বিদুষী নারী লোপামুদ্রা

ঐতিহাসিক চরিত্রলোপামুদ্রা
পরিচিতিবৈদিক যুগের বিদুষী নারী
জন্মবিদর্ভ রাজার গৃহে
বিবাহঅগস্ত্য মুনি
খ্যাতিঋগ্বেদ সংহিতার মন্ত্র রচনা
লোপামুদ্রা

ভূমিকা :- ঋকবৈদিক যুগ-এর যে কয়েকজন নারী বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর্য নারী লোপামুদ্রা।

লোপামুদ্রার জন্ম কাহিনী

  • (১) অগস্ত্য বৈদিক যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ঋষি ছিলেন। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বীর্যবত্তা পুরাণেও কীর্তিত আছে। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যখন ভয়ানক যুদ্ধবিগ্রহ চলছিল, সেই সময়ে নিরুপায় দেবতারা অগস্ত্য ঋষির শরণাপন্ন হলে তিনি সমুদ্র পান করে দেবতাদেরকে অসুরবধে সাহায্য করেছিলেন। ইল্বল ও বাতাপি নামক দুজন দুষ্ট দৈত্যকে বধ করাও তাঁর অন্যতম কীর্তি।
  • (২) বিন্ধ্যপর্বত যখন মস্তকোত্তোলন পূর্বক সূর্যদেবের গতিপথ রোধ করেছিলেন, সেই সময় দেবতাদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে অগস্ত্য ঋষি বিন্ধ্যাচলের গর্ব খর্ব করেছিলেন। অগস্ত্য বিন্ধ্যাচলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন – “আমি তীর্থ করতে দক্ষিণদেশে গমন করব। আমার পক্ষে তোমাকে ডিঙিয়ে যাওয়া অসম্ভব; অতএব তুমি একটু মাথা নীচু কর, আমি তীর্থ করে আসি।”
  • (৩) অগস্ত্যের কথায় বিন্ধ্যপর্বত মাথা নীচু করলেন। তখন মুনি বিদ্ধ্যপর্বত উত্তীর্ণ হয়ে দক্ষিণদিকে গমন করে বললেন, “যতক্ষণ আমি তীর্থ করে ফিরে না আসব, ততক্ষণ এমনই ভাবে নত অবস্থান অবস্থান কর। যদি না থাক তা হলে তোমাকে ভয়ানক অভিশাপ দেব।” কাজেই বিন্ধ্য আর কি করেন ? মাথা নত করে পড়ে থাকলেন। অগস্ত্যও আর ফিরে এলেন না। এই উপাখ্যানটিকে মূল করে আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত হয়ে আসছে – অগস্ত্যযাত্রা। মাসের প্রথম দিনে কোথাও গমন করলে অগস্ত্যযাত্রা হয়। সেদিন যাত্রা করলে অগস্ত্যের ন্যায় আর ফিরে আসতে হয় না বলেই মাসের প্রথম দিন যাত্রা নিষিদ্ধ হয়েছে।
  • (৪) একদিন অগস্ত্য পথে চলতে চলতে দেখতে পেলেন একটা গর্তের ভিতরে কতকগুলি লোক রয়েছে। তাদের মাথা নীচের দিকে, পা উপরের দিকে। তাদেরকে দেখে অগস্ত্যের প্রাণে অত্যন্ত দুঃখ হল। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনাদের এইরূপ অবস্থা হল কেন ?” উত্তর এল “আমরা তোমার পূর্বপুরুষ। তুমি বিবাহ কর নি, সেজন্য আমাদের এইরূপ অবস্থা হয়েছে। তুমি যদি বিবাহ কর, আর তোমার পুত্র হয় তাহলে আমাদের এই দুঃখের অবসান হতে পাবে।”
  • (৫) এই কথায় অগস্ত্য বিবাহ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। কিন্তু কোথাও তার মনের মত কন্যা খুঁজে পেলেন না। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজেই এক কন্যার সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যে যার শরীরের যে স্থানটি সকলের চেয়ে সুন্দর সেইরূপ আদর্শে সেই আদর্শ কন্যার শরীর গঠিত হল। এই কন্যা হল অতুলনীয়া সুন্দরী। সেই কন্যা বিদর্ভ রাজার গৃহে তাঁর কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করল। রাজা তাঁর নাম রাখলেন লোপামুদ্রা।

বিদুষী নারী লোপামুদ্রার বিবাহ

লোপামুদ্রা যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হলেন, তখন অগস্ত্য এসে বিদর্ভের রাজাকে বললেন, “মহারাজ, আমি আপনার কন্যাকে বিবাহ করব। এতে বিদর্ভের রাজা ও রাণী অত্যন্ত চিন্তান্বিত হলেন। রাজকুমারীর সাথে হবে কি না এক দরিদ্র মুনির বিবাহ। কিন্তু এদিকে আবার ঋষির শাপের ভয়ও আছে। কাজেই তাঁরা কি যে করবেন সে-কথা ভেবে ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। এমন সময় লোপামুদ্রা বললেন “আপনারা আমার জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আমাকে এই মুনির সাথেই বিবাহ দিন।” সুতরাং অগস্ত্য ও লোপামুদ্রার বিবাহ হয়ে গেল।

আদর্শ নারী চরিত্র লোপামুদ্রা

লোপামুদ্রার চরিত্রটি আদর্শ নারী চরিত্র। বৈদিক যুগের মহিলাদের অপূর্ব পতিভক্তি ও ত্যাগের মহিমা তাঁর চরিত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বিবাহের পর লোপামুদ্রা তপস্বিনীর বেশে স্বামীর গৃহে এসে বাস করতে লাগলেন। রাজ কন্যা হয়েও তিনি স্বামীগৃহে দারিদ্র্যকেই বরণ করে নিলেন।

পাতিব্রত্যের আদর্শে মহীয়সী নারী লোপামুদ্রা

একদিকে যেমন তিনি বিদুষী ছিলেন। তেমনি ছিলেন পাতিব্রত্যের আদর্শে মহীয়সী মহিলা। স্বামির সেবাকেই তিনি শ্রেষ্ঠ ধর্মরূপে গ্রহণ করেছিলেন। লোপামুদ্রা সর্ববিষয়ে সর্বকার্যে স্বামীর সহগামিনী ছিলেন। স্বামী ভোজন করলে পর তিনি ভোজন করতেন, স্বামী নিদ্রা গেলে পর তিনি নিদ্রা যেতেন এবং স্বামীর নিদ্রাভঙ্গের পূর্বেই তিনি গাত্রোত্থান করতেন। অগস্ত্যকে সেবা দ্বারা তিনি এমন ভাবে পরিতুষ্ট করেছিলেন যে একদিনের জন্যও তাঁর ব্যবহারে অগস্ত্যমুনির অসন্তোষের কারণ জন্মে নি।

বৈদিক যুগের অতুল্যা নারী লোপামুদ্রা

অতিথিসেবায়, গৃহকার্যে, গো-সেবায় এবং আশ্রম পর্যবেক্ষণে তার তুল্যা নারী বৈদিক যুগেও অতি বিরল ছিল।

লোপামুদ্রা কর্তৃক মন্ত্র রচনা

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তের প্রথম ও দ্বিতীয় ঋক বা মন্ত্র লোপামুদ্রা সঙ্কলন করেছিলেন।

উপসংহার :- বিদুষী লোপামুদ্রা স্বামী অগস্ত্য ঋষিকে বলছেন – হে প্রভু! বহু বছর অবধি, রাত্রিদিন আপনার সেবা করে এখন আমি শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। জরা আসিয়া আমার দেহের সৌন্দর্য নাশ করছে। তবুও আপনার সেবাকেই আমি আমার জীবনের আনন্দ ও পরম তপস্যা জ্ঞান করছি। আপনিই আমার একমাত্র আশ্রয় ও গতি। আপনার সেবা দ্বারাই, আপনার তৃপ্তি দ্বারাই যেন আমার জীবন পূর্ণ হয় এবং আমার প্রতি যেন আপনার প্রীতি ও অনুরাগ অটুট থাকে এই আমার একমাত্র প্রার্থনা।

(FAQ) লোপামুদ্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. লোপামুদ্রা কে ছিলেন?

ঋকবৈদিক যুগের বিদুষী মহিলা।

২. লোপামুদ্রার জন্ম কোথায় হয়?

বিদর্ভ রাজার গৃহে।

৩. কার সাথে লোপামুদ্রার বিবাহ হয়?

অগস্ত্য মুনি।

৪. লোপামুদ্রার খ্যাতির কারণ কি?

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তের প্রথম ও দ্বিতীয় ঋক বা মন্ত্র সঙ্কলন করে লোপামুদ্রা খ্যাতি অর্জন করেন।

Leave a Comment