উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়া

উনিশ শতকের প্রাক্কাল্যে রাশিয়া প্রসঙ্গে স্লাভ, পোল্যান্ড অঞ্চলের অধিবাসী, বাল্টিক অঞ্চলের অধিবাসী, ক্রিমিয়া ও সাইবেরিয়া অঞ্চলের অধিবাসী, ইহুদি জাতি, রুশ সাম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ দেশ, রোমানভ রাজবংশ, জারতন্ত্র, জারতন্ত্রের সূচনা, আধুনিক রাশিয়ার জনক, উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত, রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা হিসেবে অভিজাত সম্প্রদায়, কৃষক সম্প্রদায়, ভূমিদাসদের অবস্থা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি, রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা হিসেবে অনগ্ৰসর কৃষি, শিল্প বাণিজ্যে পশ্চাৎপদ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি, শিল্পায়নের সূচনা, সমুদ্রে নির্গমন পথের অভাব, রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা বিষয়ে স্বৈরাচারী জারতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অভাব, অভিজাতদের প্রাধান্য, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, রাজ্য সমিতি, প্রদেশ, মীর, উদারনৈতিক ভাবধারার উন্মেষ, রুশ অভিজাতদের অসন্তোষ ও গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানবো।

উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়া

ঐতিহাসিক ঘটনাউনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়া
রাশিয়ার রাজাজার
রাশিয়ার রাণীজারিনা
মিখাইল বংশের প্রতিষ্ঠাতামিখাইল রোমানভ
প্রথম জার উপাধি ধারণরাজা চতুর্থ আইভান
আধুনিক রাশিয়ার জনকমহান পিটার
উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়া

সূচনা:- উনিশ শতকের সূচনায় রাশিয়া ছিল একটি আধা-ইউরোপীয় আধা-এশিয় শক্তি। ইউরোপ-এর অর্ধাংশ ও এশিয়ার এক ব্যাপক অঞ্চল নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত ছিল। নানা জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের লোক এই সাম্রাজ্যে বসবাস করত।

রাশিয়ার অধিবাসী স্লাভ

এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল স্লাভ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। স্লাভরা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল –

  • (ক) রাজধানী মস্কোকে কেন্দ্র করে মধ্যবর্তী অঞ্চলের রুশদের বলা হত ‘গ্রেট রাশিয়ান”।
  • (খ) কিয়েভকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের রুশদের বলা হত ‘লিটল রাশিয়ান এবং
  • (গ) লিথুয়ানিয়া অঞ্চলের রুশরা ‘শ্বেতরুশ’ নামে পরিচিত ছিল। এরা ধর্মবিশ্বাসে গ্রিক গির্জাধীন গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিল।

পোল্যান্ড অঞ্চলের অধিবাসী

পোল্যান্ড অঞ্চলের অধিবাসীরা স্লাভ জাতীয় হলেও কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে তারা ভিন্নতর ছিল। তারা ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ছিল এবং তাদের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপীয় সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠতর।

বাল্টিক অঞ্চলের অধিবাসী

বাল্টিক অঞ্চলের এস্তোনিয়া, লিভোনিয়া ও ফিনল্যান্ডের অধিবাসীরা এস্তম ও লেটস নামে পরিচিত ছিল। এদের অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী। তারা জার্মান জমিদারদের শাসনাধীন ছিল। ধর্মবিশ্বাসে তারা ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট।

ক্রিমিয়া ও সাইবেরিয়া অঞ্চলের অধিবাসী

ক্রিমিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল তাতার জাতিগোষ্ঠীভুক্ত এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সাইবেরিয়া অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠীভুক্ত।

ইহুদি বসতি

লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের একাংশে ধনী ইহুদিদের বসবাস ছিল। অ-স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে একমাত্র ইহুদিরাই নানাপ্রকার নির্যাতনের শিকার ছিল।

রুশ সাম্রাজ্য

স্লাভ, এস্তম, লেটস, তাতার, মোঙ্গল প্রভৃতি উপজাতি এবং ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, ইসলাম ও ইহুদি প্রভৃতি নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।

মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ দেশ রাশিয়া

অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনিশ শতকের সূচনায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় রাশিয়া ছিল একটি মধ্যযুগীয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন, অর্ধ-বর্বর ও পশ্চাৎপদ দেশ। ইউরোপের প্রাগ্রসর সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই ছিল না।

রাশিয়ার রোমানভ রাজবংশ

এই সময় রাশিয়া ছিল রোমানভ রাজবংশের শাসনাধীন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মিখাইল রোমানভ (১৬১৩-১৬৪৫ খ্রিঃ) রাশিয়ার সিংহাসনে বসেন এবং তিনিই হলেন রোমানভ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই রাজবংশ রাশিয়া শাসন করে।

রাশিয়ায় জারতন্ত্র

রোমানভ বংশের রাজারা সার্বভৌম শক্তির চিহ্নস্বরূপ নিজেদের ‘জার’ (Tsar অথবা Czar) এবং রানিদের ‘জারিনা’ (Czarina) বলে অভিহিত করতেন। তাঁদের শাসনকে ‘জারতন্ত্র’ বলা হত।

রাশিয়ায় জারতন্ত্রের সূচনা

রোমানভ বংশের আগেই রাশিয়াতে  জারতন্ত্রের সূচনা হয়। ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা চতুর্থ আইভান প্রথম ‘জার’ উপাধি ধারণ করেন।

আধুনিক রাশিয়ার জনক

জার পিটার দি গ্রেট বা মহান পিটার-এর আমল (১৬৮২-১৭২৫ খ্রিঃ) থেকে রাশিয়াতে আধুনিকীকরণের সূচনা হয়। তাঁকে ‘আধুনিক রাশিয়ার জনক’ বলে অভিহিত করা হয়।

উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত রাশিয়া

জার মহান পিটারের কোনও যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল না। জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন-এর আমলে (১৭৬২-১৭৯৬ খ্রিঃ) অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে রাশিয়া একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়।

রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা

মধ্যযুগীয় ও সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়া ছিল একটি অনগ্রসর দেশ। বহু জাতি ও ধর্ম-অধ্যুষিত রুশ সমাজে কোনও সামাজিক ঐক্য বা সংহতি ছিল না। উনিশ শতকের প্রাক্কালে রুশ সমাজ মূলত দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। – অভিজাত ও কৃষক সম্প্রদায়।

(ক) অভিজাত সম্প্রদায়

  • (১) অভিজাতরা ছিল সামন্তপ্রভু। দেশের অধিকাংশ জমি তাদের কুক্ষিগত ছিল। তাদের অধীনে বিরাট জমিদারি, ম্যানর এবং বহু সার্ফ বা ভূমিদাস ছিল। তারা বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারি-স্বত্ব ভোগ করত এবং সরকারের সামরিক ও অসামরিক বিভাগে একমাত্র তারাই নিযুক্ত হত।
  • (২) উনিশ শতকের প্রাক্কালে সমগ্র রাশিয়ায় মোট ১৪০০০০ অভিজাত পরিবার ছিল। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব -এর আগে ফ্রান্স -এর অভিজাত সম্প্রদায় যেমন একচেটিয়াভাবে সব রকম রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, কিন্তু বিনিময়ে কোনও কর্তব্য পালন করত না, রাশিয়ার অভিজাতদের অবস্থাও ছিল ঠিক একই রকম।

(খ) কৃষক সম্প্রদায়

রাশিয়া ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং মোট জনসংখ্যার ৯৪.৫% মানুষই ছিল কৃষক। তাদের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়। অধ্যাপক সেটন-ওয়াটসন রাশিয়ার কৃষক সম্প্রদায়কে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন – স্বাধীন কৃষক ও ভূমিদাস বা সার্ফ।

(১) স্বাধীন কৃষক

স্বাধীন কৃষকদের জমিগুলি আয়তনে ছিল খুবই ছোটো এবং তাতে উৎপাদনও হত খুব সামান্য। এই কারণে অনেকেই বড়ো জমির মালিক বা জমিদারকে তাদের নিজেদের জমিগুলি লিজ দিয়ে সেই মালিকের খামারে মজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত।

(২) সার্ফ

কৃষকদের অধিকাংশই ছিল ভূমিদাস বা সার্ফ। এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ মিলিয়ন। ষোড়শ শতক থেকে রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা প্রচলিত হয় এবং জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিনের আমলে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।

রাশিয়ায় ভূমিদাসদের অবস্থা

  • (১) ভূমিদাসদের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়। জমিদার বা সামন্তপ্রভু ছিল তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। জমিদারের ম্যানর বা খামার-সংলগ্ন গ্রামে তারা বসবাস করত।
  • (২) ম্যানর প্রথা অনুযায়ী তারা জমিদারের এক টুকরো জমি চাষ করত। এর বিনিময়ে সপ্তাহে অন্তত তিনদিন তারা বিনা পারিশ্রমিকে জমিদারের জমি চাষ করতে বাধ্য থাকত। এছাড়া, তাদের কর্ভি বা বেগার শ্রম দিতে হত। খাল খনন, রাস্তা নির্মাণ, পুল তৈরি প্রভৃতি কাজ তাদের বিনা পারিশ্রমিকে করতে হত।
  • (৩) তাছাড়াও, তাদের উপর নানা করের বোঝা চাপানো হত। গির্জাকে দিতে হত ‘’টাইদ’ (Tithe) বা ধর্মকর। এক কথায়, তাদের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয় এবং তারা ছিল জমিদারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
  • (৪) ভূমিদাসদের কোনও অধিকার বা স্বাধীনতা ছিল না। গবাদি পশুর মতো তাদের কেনা-বেচা করা যেত, বন্ধক দেওয়া যেত এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেত। মালিকের অনুমতি ছাড়া তারা ম্যানর থেকে অন্যত্র যেতে পারত না। তাদের উপর ইচ্ছামতো দৈহিক নির্যাতন করা যেত বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করাও যেত।
  • (৫) রাজকীয় জমিগুলির সঙ্গে যুক্ত সার্ফদের অবস্থা কিছুটা উন্নত ছিল এবং ‘মির’ (Mir) নামক গ্রামীণ সংস্থার অধীনে তারা কিছুটা স্বশাসন ভোগ করত। জমিদারদের অধীনস্থ সার্ফদের জীবন ছিল শোচনীয়।
  • (৬) ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে জনৈক রুশ দেশপ্রেমিক মন্তব্য করেন যে, “রাশিয়ার ব্যক্তি-মালিকানাধীন ভূমিদাসদের তুলনায় আমেরিকায় ক্ষেতে-খামারে নিযুক্ত নিগ্রোদের অবস্থা ভালো ছিল।”
  • (৭)  এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য মাঝে-মাঝেই তারা বিদ্রোহ করত। ১৮২৬ থেকে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাশিয়ায় এই ধরনের প্রায় ৭১২টি ভূমিদাস বিদ্রোহ ঘটে। মহান পিটার এবং জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন রাশিয়ায় নানা সংস্কার প্রবর্তন করলেও ভূমিদাসদের দুঃখ নিবারণে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি।

রাশিয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি

এই সময় রাশিয়ার কোনোও শিল্প, বাণিজ্য বা নগর জীবন গড়ে ওঠে নি। এর ফলে রুশ সমাজে অভিজাত ও কৃষক সম্প্রদায়ের মাঝে কোনোও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। এই কারণে নানাপ্রকার মধ্যযুগীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের মতো রাশিয়াতে কোনও উদারনৈতিক যুক্তিবাদী গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে নি।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা

উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নিমরূপ। –

(১) অনগ্রসর কৃষি

রাশিয়ার অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। তা সত্ত্বেও কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত ও অবহেলিত। মুষ্টিমেয় জমিদারের হাতে অপ্রতিহত ক্ষমতা ছিল এবং তারা কৃষির উন্নয়নে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। এর ফলে রাশিয়াতে উন্নত ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কোনোও বিকাশ ঘটে নি। উনিশ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় দেশে খাদ্যাভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

(২) শিল্প-বাণিজ্যে পশ্চাদপদ

ডেভিড ল্যান্ডস ও গারশেনক্রন বলেন যে, সামন্তপ্রথার প্রভাবে রাশিয়ার লোক কায়িক পরিশ্রমের কাজকে নিচু চোখে দেখত এবং ফ্রান্সের মতো তারা কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যকে হীন কাজ বলে মনে করত। এই কারণে ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ অপেক্ষা শিল্প-বাণিজ্যে রাশিয়া অনেক পিছিয়ে পড়েছিল।

(৩) মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি

ধনবণ্টন না হওয়ায় মুষ্টিমেয় ধনী অভিজাতের হাতেই সম্পদ জমা হচ্ছিল, যা বাণিজ্য পুঁজিতে রূপান্তরিত হয় নি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো সেখানে বিত্তবান ধনী বুর্জোয়া, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা পাতি বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উত্থান হয় নি।

(৪) শিল্পায়নের সূচনা

শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও রাশিয়া ছিল পশ্চাৎপদ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন জার্মান সহযোগিতায় কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এইভাবে উরাল ও রোস্টেড অঞ্চলে দু-একটি লৌহশিল্প গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে রাশিয়াতে কয়লা ও তেল উৎপাদনের চেষ্টা শুরু হয়। কৃষির বিকল্প হিসেবে শিল্পায়নের উদ্যোগ তখনও শুরু হয় নি।

(৫) সমুদ্রে নির্গমন পথের অভাব

রাশিয়ার সমুদ্রপথে নির্গমনের সুযোগ ছিল না। এর ফলে বৈদেশিক ও ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের সুযোগ থেকে রাশিয়া বঞ্চিত ছিল।

রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা

উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল নিম্নরূপ। –

(১) স্বৈরাচারী জারতন্ত্র

উনিশ শতকের প্রাক্কালে রাশিয়ায় একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন স্বৈরাচারী জার। তিনি ছিলেন সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস। তিনি ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। দেশে কোনও লিপিবদ্ধ আইন ছিল না। তাঁর ইচ্ছা ও হুকুমনামাই ছিল দেশের আইন। তিনি তাঁর কাজের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না। এই শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই ছিল “স্বৈরাচার, অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতি।”

(২) গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অভাব

দেশে একটি ‘ডুমা’ বা জাতীয় সংসদ থাকলেও জারের ইচ্ছানুযায়ী এর অধিবেশন আহুত হত। এর সকল সদস্যই ছিল অভিজাত শ্রেণির এবং এর সদস্যরা সর্বসাধারণের ভোটে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হতেন না।

(৩) অভিজতদের প্রাধান্য

শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল। সেখানে সাধারণ মানুষের কোনও ভূমিকা ছিল না। সরকারি পদে একমাত্র অভিজাতরাই নিযুক্ত হত এবং এই নিযুক্তি ও তাদের কার্যকলাপের মেয়াদ সম্পূর্ণভাবে জারের ইচ্ছাধীন ছিল। সরকারি কর্মী নিযুক্তির ব্যাপারে অবাধে উৎকোচ প্রদান চলত। যাই হোক, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে তারা যথেষ্ট সামাজিক প্রতিপত্তি ভোগ করত।

(৪) দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন

সরকারের নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর, এমনকী সামরিক প্রশাসকরাও ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অবাধে উৎকোচ গ্রহণ করত। উৎকোচ ছাড়া বিচারবিভাগ থেকেও উপযুক্ত সাহায্য পাওয়া যেত না। উৎকোচের পরিমাণের উপরেই বিচারের প্রকৃতি নির্ভর করত।

(৫) পুলিশ বাহিনী

জারের স্বেচ্ছাতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ ছিল পুলিশ বাহিনী। এই বাহিনীকে জারতন্ত্রের ‘প্রেটোরিয়ান গার্ড’ বলা হত। এই বাহিনীর ক্ষমতা ছিল অসীম। এরা যে কোনও সময় যে কোনও ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারত। জনগণ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল।

(৬) রাজ্য সমিতি

শাসনকার্যে জারকে সাহায্য করার জন্য একাধিক সমিতি বা সংস্থা ছিল। এই সমিতিগুলির মধ্যে রাজ্য সমিতি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বয়ং জার এই সমিতির সদস্যদের মনোনীত করতেন এবং এর কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করতেন।

(৭) প্রদেশ

সমগ্র সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেকটি প্রদেশের শাসনতার একজন গভর্নর ও একটি সমিতির উপর ন্যস্ত ছিল। গভর্নর ও সমিতিগুলি জার কর্তৃক নিযুক্ত হত।

(৮) মীর

গ্রামাঞ্চলে ‘মির’ নামক একটি সংস্থা কৃষি ও বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিষয়গুলি তত্ত্বাবধান করত।

রাশিয়ায় উদারনৈতিক ভাবধারার উন্মেষ

প্রবল অর্থনৈতিক সংকট ও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়াতে কোনও উদারনৈতিক প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে নি। কারণ, সেখানে কোনও মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না।

লিপসনের মন্তব্য

ঐতিহাসিক লিপসন বলেন যে, ইউরোপের অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ ছিল বলে সেখানে বিপ্লব সংঘটিত হয় নি। ফ্রান্সে একটি বুদ্ধিদীপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল, এবং এই কারণেই সেখানে বিপ্লব সংঘটিত হয়। যাই হোক, এই অবস্থায় রাশিয়াতে পরিবর্তনের সূচনা হয়।

রুশ অভিজাতদের অসন্তোষ

  • (১) রাশিয়ায় কর্তৃত্ব করত জার্মান অভিজাতরা। ক্ষমতার বাইরে থাকা রুশ অভিজাতরা এটা মানতে পারছিল না। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল।
  • (২) নেপোলিয়ন -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে বহু রুশ অভিজাত পশ্চিম ইউরোপে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে এবং তিন বছর ফ্রান্সে অবস্থান করে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের সঙ্গে সুপরিচিত হয়।

রাশিয়ায় গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা

  • (১) পশ্চিমী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ রুশরা ইতালির ‘কার্বোনারি’ এবং গ্রিস-এর ‘হেটাইরিয়া ফিলিকে’-র অনুসরণে নানা স্থানে ছোটো ছোটো গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তাদের আদর্শ প্রচারে ব্রতী হয়।
  • (২) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিয়ন অব পাবলিক গুড’ নামক গুপ্ত সমিতি। পরে এই সমিতি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। – উত্তরের সমিতি এবং ‘দক্ষিণের সমিতি’। উত্তরের সমিতি’ ছিল সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পক্ষে এবং ‘দক্ষিণের সমিতি’ ছিল প্রজাতন্ত্রের পক্ষে।
  • (৩) যাই হোক, রাশিয়ার সাধারণ মানুষ এইসব তত্ত্বকথা না বুঝলেও এই সমিতিগুলির কার্যকলাপ দেশে যে একটি জাগরণের সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

উপসংহার:- লিপসন বলেন যে, “আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ যেমন ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল, তেমনি ফ্রান্সের উদারতন্ত্র দ্বারা রুশ অভিজাতদের প্রতিবাদী চেতনা পুষ্ট হয়েছিল।”

(FAQ) উনিশ শতকের প্রাক্কাল্যে রাশিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রাশিয়ার রাজা ও রানিকে কি বলা হয়?

জার ও জারিনা।

২. প্রথম জার উপাধি ধারণ করেন কে?

রাজা চতুর্থ আইভান।

৩. আধুনিক রাশিয়ার জনক কাকে বলা হয়?

পিটার দ্য গ্ৰেট বা মহান পিটার।

৪. রাশিয়ায় রোমানভ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে?

মিখাইল রোমানভ।

Leave a Comment