সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা

সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রভুর বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা, দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন, কনৌজ অধিকার, গুজরাট আক্রমণ, বুন্দেলখন্ড আক্রমণ, তুর্কি আধিপত্য, শাসনের গুরুত্ব, সাম্রাজ্যের দৃঢ়ীকরন, বঙ্গদেশ ও বিহারের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে জানবো।

সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা
সুলতানকুতুবউদ্দিন আইবক
রাজত্ব১২০৬-১২১০ খ্রি:
বংশদাস বংশ
উত্তরসূরিইলতুৎমিস
সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা

ভূমিকা :- ভারতীয় সাম্রাজ্য কুতুবউদ্দিন আইবকের নিকট গোলাপ-শয্যাতে পরিণত হয়নি। সিংহাসনে বসার পূর্বে এবং পরে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

সাহায্যের পুরস্কার

হিন্দুস্থানে তাঁর প্রভুর অভিযানের সময়, কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁর বুকের রক্ত দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এবং তারই পুরস্কার স্বরূপ তাঁর নতুন বিজিত সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় শুধুমাত্র অবাধ ক্ষমতা পাননি; নিজের ইচ্ছামতো তার বিস্তারের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। 

প্রভূর বিশ্বাসের মর্যাদা

কুতুবউদ্দিনের উপর তাঁর প্রভু যে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, তার পূর্ণ মর্যাদা তিনি রেখেছিলেন। তাঁর প্রভুর অনুপস্থিতিতে তিনি মিরাট, রণথম্বোর, হাদি এবং দিল্লি দখল করেছিলেন।

কুতুবউদ্দিন কর্তৃক দিল্লীতে রাজধানী স্থাপন

সবদিক বিবেচনা করে তিনিই প্রথম দিল্লিকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। দিল্লি আজও সেই মর্যাদা ভোগ করছে। অবস্থান ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের দিক থেকে রাজধানী হিসাবে দিল্লির বিকল্প ছিল না।

কুতুবউদ্দিনের কনৌজ দখল

১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে জয়চাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে কুতুবউদ্দিন আইবক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জয়চাঁদ এই যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। জয়চাঁদ ছিলেন কনৌজ -এর রাজা। সুতরাং কনৌজ অধিকৃত হয়।

কুতুবউদ্দিনের গুজরাট আক্রমণ

১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় ভীমসেনকে পরাজিত করেন এবং গুজরাটের রাজধানী লুণ্ঠন করেন। অতঃপর দিল্লি প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি হান্সি দখল করেন।

কুতুবউদ্দিনের বুন্দেলখণ্ড আক্রমণ

১২০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবক বুন্দেলখণ্ড আক্রমণ করেন এবং চান্দেল্ল নরপতি পারমারদেবকে পরাজিত করে কালিঞ্জর, মাহোবা ও খাজুরাহো দখল করেন। কথিত আছে, কালিঞ্জর দুর্গ থেকে তিনি অপরিমিত সম্পদ পেয়েছিলেন এবং পঞ্চাশ হাজার নরনারীকে বন্দি করেছিলেন।

তুর্কি আধিপত্য

ইতিমধ্যে বখতিয়ার খলজি বঙ্গদেশ ও বিহারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বখতিয়ার খলজি কুতুবউদ্দিন আইবকের অধীনতা স্বীকার করে নেন। তাঁর প্রভু মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পূর্বেই তিনি ঘুরির সেনাপতি ও প্রতিনিধি হিসাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সমগ্র উত্তর ভারত -এ তুর্কি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কুতুবউদ্দিনের বৈবাহিক সম্পর্ক

  • (১) ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই, কুতুবউদ্দিন নিজ শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে, তাঁর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
  • (২) তিনি ইলতুৎমিসের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এবং ভগ্নীর বিবাহ দিয়েছিলেন সিন্ধুদেশের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচার সঙ্গে। আর তিনি স্বয়ং বিবাহ করেছিলেন গজনির শাসক তাজউদ্দিনের কন্যাকে।
  • (৩) এই বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিদেশনীতির এক নতুন পথ নির্মাণ করেছিলেন। বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে, তাঁর মর্যাদা ও ক্ষমতা অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পায়।

কুতুবউদ্দিনের শাসনের গুরুত্ব

তিনি মাত্র চার বছর শাসন করেছিলেন কিন্তু এই স্বল্পকালের শাসনকালে তাঁর শাসন-প্রতিভার তেমন পরিচয় না পেলেও, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাঁর স্থান অক্ষয় হয়ে থাকবে। কারণ,

  • (১) ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে তাঁর আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। উপরন্তু তিনিই গজনির সার্বভৌমত্বের অধীনতা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্তি দেন।
  • (২) মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর তাজউদ্দিন গজনির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি গজনি সাম্রাজ্যের সার্বভৌম অধিপতি হিসাবে ভারতবর্ষের অধিকার দাবি করেন। কিন্তু কুতুবউদ্দিন আইবক গজনির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে, নিজেকে ভারতের স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি হিসাবে ঘোষণা করেন।
  • (৩) এর ফলে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের স্বাধীনভাবে চলার পথ উন্মুক্ত হয় এবং ভারতকে মধ্য এশিয়ার জটিল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয় না। এর ফলে একদিকে যে-কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ হতে ভারতকে রক্ষা করেন।
  • (৪) তিনি ভারত থেকে বিদেশে অর্থ নির্গমনের পথকে রুদ্ধ করে তুর্কিদের ভারতীয় ঐতিহ্যের ও মাটির সঙ্গে আত্মিক যোগ স্থাপনের পথ উন্মুক্ত করেন। এই কাজের দ্বারা কুতুবউদ্দিন আইবক ভারতকে সার্বভৌম ক্ষমতা দান করেছিলেন এবং বিচক্ষণ রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন।

সাম্রাজ্যের দৃঢ়ীকরণে কুতুবউদ্দিনের ভূমিকা

  • (১) মাত্র চার বছরের শাসনকালে তাঁর একমাত্র প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের দৃঢ়ীকরণ। যে কারণে তিনি এই সময় নতুন কোনো রাজ্য জয় করার চেষ্টা করেননি। এই সময় মহম্মদ ঘুরির অন্যান্য অনুচরদের সঙ্গে বিরোধিতাতেই তাঁর সময় অতিবাহিত হয়।
  • (২) এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর তাজউদ্দিন গজনি দখল করেন, কিন্তু ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে খারাজিম শাহ কর্তৃক তাজউদ্দিন গজনি থেকে বিতাড়িত হন। এই সুযোগে কুতুবউদ্দিন গজনি দখল করেন।
  • (৩) কিন্তু গজনির জনসাধারণ কুতুবউদ্দিন আইবকের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে তাজউদ্দিনকে আহ্বান করে, সেই কারণে কুতুবউদ্দিন মাত্র চল্লিশ দিনের মধ্যেই গজনি থেকে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন।
  • (৪) এছাড়াও, ভারতবর্ষে তাঁর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব ছিল না। মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুতে রাজপুত নরপতিরাও তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হন।

বঙ্গদেশ ও বিহারের কুতুবউদ্দিনের সাথে সম্পর্ক

  • (১) বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির সঙ্গে বঙ্গদেশ ও বিহারের সম্পর্ক ছিন্ন হবার উপক্রম হয়। আলি মর্দান খলজি বঙ্গদেশে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এবং লখনৌতির স্বাধীন শাসক হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেন।
  • (২) কিন্তু স্থানীয় এক খলজি নেতা মহম্মদ সেহেরান তাঁকে কারারুদ্ধ করে, নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করেন। পরে আলি মর্দান খলজি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দিল্লি যান এবং বঙ্গদেশের ব্যাপারে কুতুবউদ্দিন আইবককে হস্তক্ষেপ করার জন্য বোঝাতে সক্ষম হন।
  • (৩) কুতুবউদ্দিনের হস্তক্ষেপের ফলে, আলি মর্দান খলজি বঙ্গদেশের শাসনকর্তা হন। এবং দিল্লিকে বাৎসরিক কর দিতে স্বীকৃত হন।
  • (৪) পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশের উপর দিল্লির এই কর্তৃত্ব স্থাপন প্রসঙ্গে ড. হবিবুল্লাহ মন্তব্য করেছেন, দিল্লির নিকট এটি ছিল একটা সান্ত্বনা মাত্র ; কারণ সেই মুহূর্তে সার্বভৌম অধিপতির ভূমিকা অপেক্ষা রাজনৈতিক নিরাপত্তাই ছিল সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।

কুতুবউদ্দিন সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ্য

সবচেয়ে উল্লেখ্য এই সময় কুতুবউদ্দিন আইবক উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের রাজনীতিতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এমনকি বঙ্গদেশের রাজনীতিতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু রাজপুত নরপতিদের বিরুদ্ধে তিনি আক্রমণাত্মক যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেননি।

কুতুবউদ্দিনের মৃত্যু

এইরকম পরিস্থিতিতে, ১২১০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে নীচে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয় এবং লাহোরে তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়।

উপসংহার :- উত্তর ভারতের প্রথম স্বাধীন তুর্কি সুলতানের যে সাধারণ সমাধি মন্দির তৈরি করা হয় তা তাঁর মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ড. শ্রীবাস্তব বলেছেন, “Over his remains a very unpretentious monument was raised which is hardly worthy of the first independent Turkish Sultan of Northern India.”

(FAQ) সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দিল্লী সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

কুতুবউদ্দিন আইবক।

২. কুতুবউদ্দিন আইবক প্রতিষ্ঠিত বংশ কি নামে পরিচিত?

দাস বংশ।

৩. কুতুবউদ্দিন আইবকের উত্তরসূরি কে ছিলেন?

ইলতুৎমিস।

Leave a Comment