দাস বংশ

দাস বংশ প্রসঙ্গে কুতুবউদ্দিন আইবক, আরাম শাহ, ইলতুৎমিস, রুকন উদ্দিন ফিরোজ, রাজিয়া, মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহ, আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ, নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ, গিয়াসউদ্দিন বলবন সম্পর্কে জানবো।

দাস বংশ

বিষয়দাসবংশ
সময়কাল১২০৬-১২৯০ খ্রি.
প্রতিষ্ঠাতাকুতুবউদ্দিন আইবক
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাইলতুৎমিস
শ্রেষ্ঠ সুলতানগিয়াসউদ্দিন বলবন
শেষ সুলতানকাইকোবাদ
দাসবংশ

ভূমিকা :- কুতুবউদ্দিন আইবক হলেন দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আইবক কথার অর্থ হল ‘দাস’। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে আইবক থেকে কাইকোবাদ পর্যন্ত প্রায় সব সুলতানই প্রথম জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন। ঐতিহাসিকরা আইবক প্রতিষ্ঠিত বংশকে দাসবংশ বলেছেন।

কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০ খ্রিস্টাব্দ)

  • (১) ভারত -এ সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবক। আইবক কথার অর্থ হল ‘দাস’ বা চাঁদের মতো সুন্দর। তাই আইবক প্রতিষ্ঠিত বংশ দাসবংশ নামে পরিচিত। তিনি ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সুলতান’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি প্রচণ্ড দানশীল ছিলেন বলে তাঁকে দানশীল’ বা ‘লাখবক্স’ বলা হত।
  • (২) কুতুবউদ্দিনের উপাধি হল ‘মালিক’, ‘সুলতান’ ও ‘সিপাহশালার’। দিল্লি ও আজমিরে নির্মিত দুটি মসজিদ ও কুতুবমিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে তাঁর নাম স্মরণীয়। ১২১০ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে চৌঘান বা পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে আইবকের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আরাম শাহ পরবর্তী সুলতান হিসাবে নিযুক্ত হন।

আরাম শাহ (১২১০-১২১১ খ্রি)

  • (১) দুর্ঘটনার ফলে কুতুবউদ্দিনের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে লাহোরের মালিক বা উচ্চ তুর্কী কর্মচারীরা কুতুবউদ্দিনের পুত্র আরাম শাহকে সিংহাসনে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে। আরামশাহ কুতুবউদ্দিনের প্রকৃত পুত্র ছিলেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। মিনহাজের বিবরণে কুতুবউদ্দিনের কোনো পুত্রের কথা উল্লেখ নেই। তার তিন কন্যার কথাই বলা হয়েছে।
  • (২) যাই হোক আরাম শাহ ছিলেন সার্থকনামা। দিল্লীর অভিজাতরা তাকে সুলতান হিসেবে মানতে রাজী হয়নি। তারা কুতুউদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিসকে সুলতান হিসেবে নির্বাচন করলে ইলতুৎমিস, আরাম শাহকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করেন (১২১১ খ্রি)।

ইলতুৎমিস (১২১১-১২৩৬)

  • (১) ১২১১ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবকের পুত্র আরাম শাহকে পরাজিত ও নিহত করে ইলতুৎমিস দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন ইলবারি তুর্কি বংশের লোক। ইলতুৎমিস সিন্ধু, রাজপুতনা, গাঙ্গেয় উপত্যকা ও লক্ষ্মণাবতী (বাংলা)-তে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (২) ইলতুৎমিস শিবালিক পর্বতের অন্তর্ভুক্ত মান্দোর জয় করেন। এবং মালব রাজ্য আক্রমণ করে ভিলসা ও উজ্জয়িনী দখল করেন (১২৩৪)। ইলতুৎমিসের রাজত্বকালে ১২২১ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান খিবা বা খারিজম রাজ্যের পলাতক শাসক জালালউদ্দিন মঙ্গবরনির পশ্চাদ্ধাবন করে সিন্ধু নদীর তীরে এসে উপস্থিত হন।
  • (৩) ইলতুৎমিস মঙ্গবরনিকে ভারতে আশ্রয় দিতে রাজি না হলে মঙ্গবরনি পারস্যে চলে যান। চেঙ্গিস খান আর ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে সিন্ধুদেশে লুটপাট চালিয়ে ফিরে যান। এর ফলে দিল্লি সুলতানির উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তখন থেকে সিন্ধু নদ বলে চিহ্নিত হয়।
  • (৪) দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে ‘সুলতান-ই-আজম’ (মহান সুলতান) উপাধি লাভ করেন। এর ফলে দিল্লির সিংহাসনে তাঁর বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দিল্লির সুলতানির গৌরব বৃদ্ধি পায়।

বন্দেগি-ই-চাহালগানি বা চল্লিশচক্র

  • (১) ইলতুৎমিস ৪০ জন আমির ওমরাহকে নিয়ে যে ক্ষমতাচক্র গড়ে তোলেন তা চল্লিশচক্র নামে পরিচিত। এই চক্র যখন গড়ে ওঠে তখন তারা দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে অভিজাত রূপে প্রচুর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হন।
  • (২) ইলতুৎমিস তাঁদের যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর এঁরা ক্ষমতাশালী হয়ে সুলতান নির্বাচন ও অপসারণ করতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত বলবন নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা এই চক্র দমন করেন।

খুৎবা ও সিক্কা

ইসলামীয় রীতি অনুযায়ী একজন সার্বভৌম সুলতানি শাসক নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান পালন করতেন তার মধ্যে ‘খুৎবা’ ও ‘সিক্কা’ অন্যতম। ‘খুৎবা’ হল সুলতানের নামে প্রকাশ্যে ধর্ম উপদেশ আবৃত্তি করা এবং ‘সিক্কা’ হল সুলতানের স্ব-নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করা।

রুকনউদ্দিন ফিরোজ (১২৩৬ খ্রি)

  • (১) সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করলেও, সুলতানের মৃত্যুর পর দিল্লীর আমীরগণ মৃত সুলতানের পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন। তাদের সাহায্যে ফিরোজ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।
  • (২) ফিরোজের উত্থান ও পতন ইলবারী তুর্কী শাসনের একটি সাংবিধানিক বৈচিত্র্য প্রমাণ করে। তুর্কী আমীররাই রাজিয়ার উত্তরাধিকারকে অগ্রাহ্য করে ফিরোজকে সিংহাসনে বসায় এবং তুর্কী অভিজাত দের ভূমিকা আমীররাই ফিরোজকে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করে।

রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি)

  • (১) ইলতুৎমিসের কন্যা রাজিয়া ছিলেন ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত প্রথম মহিলা সুলতান। তিনি পুরুষের পোশাক পরে রাজদরবারে এসে রাজকোষ পরিচালনা করে প্রথম দিল্লির আমির ওমরাহদের প্রভাব খর্ব করে রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা করেন।
  • (২) কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে আমির ওমরাহদের চক্রান্তে তিনি সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন। মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারী হয়ে জন্মানো, আমির ওমরাহদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং যৌথভাবে সিংহাসন লাভের চেষ্টায় রাজিয়ার শাসন ব্যর্থ হয়।

মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহ (১২৪০-১২৪২ খ্রি)

  • (১) রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত করে তুর্কী আমীররা ইলতুৎমিসের অপর পুত্র মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহকে সিংহাসনে বসায়। তুর্কী অভিজাতরা বাহারাম শাহকে নামে মাত্র সুলতান পদে রেখে প্রকৃত ক্ষমতা নিজেরা হস্তগত করার চেষ্টা করে।
  • (২) এজন্য অভিজাতদের মধ্যে প্রধান আইতিগীনকে বাহরাম শাহ নিহত করেন। এর ফলে তুর্কী অভিজাত ও উলেমারা বাহরাম শাহকে সিংহাসনচ্যুত করার সঙ্কল্প করে। ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে মোঙ্গল আক্রমণের সময় বাহারাম শাহের সমর্থক সেনাপতিরা মোঙ্গল যুদ্ধে যাত্রা করে।
  • (৩) এই সময় বাহারাম শাহকে অরক্ষিত পেয়ে তার শত্রুরা তাকে হত্যা করে এবং রুকনুদ্দিন ফিরোজের পুত্র এবং ইলতুৎমিসের পৌত্র আলাউদ্দিন মাসুদ শাহকে সিংহাসনে বসায়।

আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ (১২৪২-১২৪৬ খ্রি)

  • (১) তুর্কী দাস কর্মচারীরা ইলতুৎমিসের সময় থেকেই বন্দেগী-ই-চাহালগানী নামে একটি জোট গড়ে। এই জোটে ৪০ জন ক্ষমতাশালী দাস কর্মচারী ছিল। এরাই মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহকে হত্যা করে এবং আলাউদ্দিন মাসুদ শাহকে হাতের পুতুল হিসেবে সিংহাসনে বসায়।
  • (২) সুলতান আলাউদ্দিন মাসুদ শাহের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। চল্লিশ ক্রীতদাসের চরের মধ্যমণি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন। তাজিক ও তুর্কী কর্মচারীদের ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে তিনি দ্রুত ক্ষমতা বাড়ান। অবশেষে ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন মাসুদ শাহকে পদচ্যুত করে ইলতুৎমিসের পুত্র মতান্তরে পৌত্র নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহকে তিনি সিংহাসনে বসান।

নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি)

নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ চল্লিশের চক্রের নায়ক বলবনের সহায়তায় ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘকাল ধরে ঐতিহাসিকরা তাকে সুলতান ইলতুৎমিসের পুত্র বলে মনে করতেন। সম্প্রতি ডঃ কে এ নিজামী, ফেরিস্তা, মিনহাজ ও ইসামীর রচনার আলোকে প্রমাণ করেছেন যে, নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ ছিলেন ইলতুৎমিসের মৃত জ্যেষ্ঠ পুত্রের পুত্র, অর্থাৎ ইলতুৎমিসের পৌত্র।

গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি)

  • (১) নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর শ্বশুর ও প্রধানমন্ত্রী উলুঘ খান ‘গিয়াসউদ্দিন বলবন’ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। বলবনের প্রকৃত নাম হল উলুঘ খান বা বাহারউদ্দিন। বলবনের সময়কালে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন তুঘ্রিল খান। বাংলা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বলবন তাঁকে পরাজিত করেন।
  • (২) বলবন বিগত ৩০ বছরের অরাজকতা দূর করে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, চল্লিশচক্রকে ধ্বংস করে সিংহাসনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন। মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা এবং সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন বলে গিয়াসউদ্দিন বলবনকে দিল্লি সুলতানির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

উপসংহার :- বলবনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কাইকোবাদ ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। বলবনী বংশের শেষ শাসক ছিলেন কাইকোবাদের শিশুপুত্র কায়ুমার্স।

(FAQ) দাস বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দিল্লী সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

কুতুবউদ্দিন আইবক।

২. দিল্লী সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

ইলতুৎমিস।

৩. দিল্লী সুলতানির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা কাকে বলা হয়?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

৪. দিল্লী সুলতানির শ্রেষ্ঠ সুলতান কে ছিলেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

৫. দিল্লী সুলতানির শেষ সুলতান কে ছিলেন?

কাইকোবাদ।

Leave a Comment