আলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীণ নীতি

আলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীন নীতি প্রসঙ্গে স্বৈরতন্ত্রী অভিজাতদের দমন, আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহ, বিদ্রোহের কারণ নির্ণয়, গুপ্তচর নিয়োগ, অভিজাতদের অর্থ শোষণ, উদ্দেশ্য, ভূমিকর বৃদ্ধি, মদ্যপান ও মাদক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ, সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ ও কঠোরতা সম্পর্কে জানবো।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীণ নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীণ নীতি
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
বংশখলজি বংশ
প্রতিষ্ঠাতাজালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি
খলজি বিপ্লব১২৯০ খ্রিস্টাব্দ
আলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীণ নীতি

ভূমিকা :- আলাউদ্দিন ছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি চাইতেন যে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তাঁর হাতেই কেন্দ্রীভূত হবে এবং অভিজাত শাসনকর্তারা তার অঙ্গুলি হেলনে চলবেন।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক স্বৈরতন্ত্রী অভিজাতদের দমন

  • (১) দিল্লী সুলতানির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে অভিজাতশ্রেণী সিংহাসনকে অগ্রাহ্য করে যথেচ্ছাচার করার চেষ্টা করেন। আলাউদ্দিন ছিলেন ক্ষমতাশালী শাসক। তিনি অভিজাতদের যথেচ্ছাচার সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না।
  • (২) তাছাড়া তার সিংহাসনে বসার আগে যে সকল তুর্কী ও জালালী অভিজাত শাসন ক্ষমতায় ছিলেন তাদের বেশীর ভাগকেই তিনি নিহত করেন। তিনি নতুন লোকদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তিনি আশা করতেন যে, এই নবনিযুক্ত আলাই অভিজাতরা তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাবে।

আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহ

  • (১) আলাউদ্দিন সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে পর পর কয়েকটি অভিজাত বিদ্রোহ ঘটে। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল বা নব মুসলমানরা বিদ্রোহ করে। তারা আলাউদ্দিনের এক ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিহত করে। আলাউদ্দিন এই বিদ্রোহ দমন করেন।
  • (২) এরপর রণথম্ভোর অভিযানের সময় আলাউদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র আকাত খান তাকে হত্যার চেষ্টা করেন। আলাউদ্দিন দৈবক্রমে রক্ষা পান। আকাত খানকে নিহত করা হয়। এরপর আলাউদ্দিনের দুই ভাগিনেয় মালিক উমর ও মধু খান বিদ্রোহ করেন এবং আলাউদ্দিন তাদের দমন করেন।
  • (৩) এর পর হাজি মৌলা নামে এক অভিজাত সেনাপতি বিদ্রোহ করেন। হাজি মৌলা দিল্লীর কোতোয়ালের পদপ্রার্থী ছিলেন। আলাউদ্দিন তার দাবী অগ্রাহ্য করায় তিনি আলাউদ্দিনের পতন ঘটাতে চেষ্টা করেন।
  • (৪) তিনি ইলতুৎমিস-এর এক বংশধরকে সিংহাসনে বসিয়ে প্রকৃত ক্ষমতা নিজ হাতে নিতে চেষ্টা করেন। আলাউদ্দিনের বিশ্বাসভাজন সেনাপতি মালিক হামিদউদ্দিন হাজি মৌলাকে পরাজিত ও নিহত করেন। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে হিন্দু রায়, খুৎ ও মুকাদ্দমগণও সুলতানের বিরোধিতার চেষ্টা করেন।

আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ নির্ণয়

এই বিদ্রোহগুলি দমন করার পর আলাউদ্দিন তাঁর বিশ্বাসভাজন কর্মচারীদের সঙ্গে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করেন। এই বিশ্বাসী কর্মচারীদের নিয়ে তিনি যে আলোচনা সভায় বসেন তার নাম ছিল মজলিস-ই-খাস। শেষ পর্যন্ত সকল সদস্য একমত হয়ে এই বিদ্রোহগুলির পাশ্চাতে চারটি কারণ নির্দেশ করেন। যথা –

  • (১) সাম্রাজ্য-এ গুপ্তচর ব্যবস্থার দুর্বলতার জন্য সুলতান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কি ঘটছে তা জানতে পারতেন না। বিদ্রোহীরা চক্রান্ত করলে তিনি খবর পেতেন না।
  • (২) মদ্যপানের ব্যাপকতার জন্য লোকে পরস্পরের সঙ্গে মদের আসরে জোটবদ্ধ হত এবং সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার সুযোগ পেত।
  • (৩) আমীর, মালিক ও ওমরাহরা ইচ্ছামত পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে, সুলতানের বিরুদ্ধে জোট বাঁধত।
  • (৪) অভিজাতদের হাতে টাকা জমে যাওয়ার ফলে তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েছিল এবং ক্ষমতালোভী ও উদ্ধত হয়ে পড়ে।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক গুপ্তচর নিয়োগ

  • (১) আলাউদ্দিন এই চারটি কারণ স্থির করার পর সেগুলির প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। তিনি দেশের সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ করেন এবং গুপ্তচরদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন। বারিদ নামক কর্মচারীরা গুপ্তচরদের কর্তা হিসেবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করত।
  • (২) “মুনহী” বা গুপ্তচরদের অভিজাতদের গৃহে, বাজারে ও অন্যান্য স্থানে নিয়োগ করা হয়। অভিজাতদের যাতায়াত ও কাজকর্মের ওপর, বাজারে গুজবের ব্যাপারে এবং মূল্য তালিকার দিকে মুনহী বা গুপ্তচররা সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখত।
  • (৩) তারা সকল বিষয় বারিদের মারফৎ সুলতানকে জানাত। গুপ্তচরদের কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পেলে আলাউদ্দিন সন্দেহভাজন অভিজাত ও কর্মচারীদের কঠোরভাবে শাসন করতেন। এই ব্যবস্থার ফলে অভিজাতরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক অভিজাতদের অর্থ শোষণ

  • (১) অতঃপর আলাউদ্দিন অভিজাতদের সম্পদ নিষ্ক্রমনের নীতি নেন। আলাউদ্দিন এরপর আর একটি হুকুমনামা দ্বারা দরবারী অভিজাতদের যে সকল ইনাম, মিলক, ওয়াকফ বাবদ জমি বা জাগীর দেওয়া হয় তা খারিজ করে দেন। এই সকল জমি খালিসা জমিতে পরিণত করা হয়।
  • (২) বরণী বলেছেন যে, আলাউদ্দিন তার কর্মচারীদের কড়া নির্দেশ দেন যে, যে কোনো অজুহাতে যেন অভিজাতদের হাতের বাড়তি টাকা সরকারে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ধনীদের ধনভার লাঘব করার জন্য রাজস্ব বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
  • (৩) কেবলমাত্র মালিক, আমীর, সরকারি কর্মচারী, শেঠ ও মুলতানী বণিকদের গৃহে কিছু সোনাদানা অবশিষ্ট থাকে। ডঃ নিজামী আলাউদ্দিনের এই নীতির একটি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে আলাউদ্দিন সিংহাসনে বসার সময় অভিজাতদের নিজপক্ষে আনার জন্য তাদের বেতন, ভাতা বাড়ান এবং ওয়াকফ, ইনানী বাবদ ভূমিদান করেন।
  • (৪) তিনি এখন এই বাড়তি দানগুলি নাকচ করেন। যে জমি আগে খলিসা জমির অন্তর্গত ছিল না সেই জমি তিনি খলিসা জমিতে পরিণত করেন নি (Nothing was taken into the Kalisha, which originally did not belong to it)।

আলাউদ্দিন খলজির উদ্দেশ্য

আলাউদ্দিনের উদ্দেশ্য ছিল অভিজাতদের বিদ্রোহী মনোভাব দূর করা, জনসাধারণের অর্থ লুণ্ঠন করা নয়। তবে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা উৎসাহবশত নিশ্চয়ই কিছু বাড়াবাড়ি করে তাতে সন্দেহ নেই। যাতে জনসাধারণ জীবিকা অর্জনের কাজে ব্যস্ত থাকে, অলসতায় বিদ্রোহের চিন্তা না করে, এটিই ছিল সুলতানের লক্ষ্য।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক ভূমি কর বৃদ্ধি

হিন্দু খৃৎ, মুকাদ্দম, চৌধুরী প্রভৃতি গ্রামীণ অভিজাতদের বিদ্রোহী মনোভাব দমনের জন্য আলাউদ্দিন ভূমিকর বাড়িয়ে ফসলের ৫০ ভাগ করেন। এর ফলে এই শ্রেণীর হাতে বাড়তি অর্থ জমা হত না।

মদ্যপান ও মাদক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ

  • (১) অভিজাতদের দমনের উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন তার তৃতীয় নির্দেশ দ্বারা বলেন যে, দিল্লীতে মদ্যপান ও মদ্য বিক্রয় করা চলবে না। আলাউদ্দিন নিজের আচরণ দ্বারা এই নির্দেশ কার্যকরী করার চেষ্টা করেন।
  • (২) তিনি বাদাউন দরওয়াজায় জনতার সামনে নিজের পানপাত্র ভেঙে ফেলে মদ্যপান বন্ধের সূচনা করেন। রাজকর্মচারীরা শহরের সর্বত্র মদ্যপানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে দেয়। তবে কিছুদিন বাদে আলাউদ্দিন তাঁর আদেশ সংশোধন করে বলেন যে, নিজ গৃহে বসে মদ্য তৈরি ও পান করা চলতে পারে।

সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খলজির পদক্ষেপ

  • (১) আলাউদ্দিনের চতুর্থ হুকুমনামার দ্বারা দরবারি অভিজাতদের মধ্যে সুলতানের অনুমতি ছাড়া মেলামেশা, পান-ভোজন ও বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়। সুলতান গুপ্তচরদের কঠোর নির্দেশ দেন, যাতে মালিক ও আমীররা এই আইন ভাঙছেন কিনা তার খবর তাকে দেওয়া হয়।
  • (২) পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে অভিজাতরা উজির সৈয়দ খানের অনুমতি নিয়ে তা করতে পারত। এই অনুমতি আদায়ের জন্য অভিজাতদের সৈয়দ খানের বহু তোষামদি করতে হত। এজন্য অভিজাতরা সৈয়দ খানকে আড়ালে “ফিৎনা আঙ্গেজ খান” অর্থাৎ অপরের ক্ষতিকারী খান বলত।

কে. এস. লালের মন্তব্য

এই প্রসঙ্গে ডঃ কে. এস. লালের মন্তব্য স্মর্তব্য। তার মতে আলাউদ্দিন অভিজাতদের তাঁর দাসে পরিণত করেন এবং দাসত্বের তিনটি শর্ত তাদের ওপর আরোপিত করেন। যথা –

  • (১) অভিজাতদের সম্পত্তির অধিকার সুলতানের ওপর বর্তাবে।
  • (২) তাঁদের পরিবারের মধ্যে বিবাহ সুলতানের অনুমোদন সাপেক্ষ হবে।
  • (৩) অভিজাতদের সন্তানরা পিতাদের মতই সুলতানের দাসত্ব করবে।

আলাউদ্দিন খলজির সময় কঠোরতা

সুলতান আলাউদ্দিনের এই ব্যবস্থাগুলি এমন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় যে, তার ফলে অভিজাত শ্রেণী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সাহস করত না।

হাবিবের অভিমত

ডঃ ইরফান হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, হিন্দু জমিদার বা খুৎ, মুকাদ্দমগণ বলহার বা কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে তা ভোগ করত। আলাউদ্দিন জমিদারদের এই বে-আইনী রাজস্ব আদায়ের অর্থ সরকারে আদায় করার চেষ্টা করেন।

উপসংহার :- বরণীর মতে হিন্দু জমিদারদের হাতি, ঘোড়া চড়তে নিষেধ করা হয়। তারা এতই দরিদ্র হয়ে পড়ে যে তাদের বাড়ির মহিলারা মুসলিম গৃহে পরিচারিকার কাজ নিয়ে জীবনধারণ করতে বাধ্য হয়। আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক বরনীর এই মন্তব্যে অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে করেন।

(FAQ) সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন?

আলাউদ্দিন খলজি।

২. আলাউদ্দিন খলজির আমলের গুপ্তচরদের কি বলা হত?

বারিদ।

৩. নবমুসলমানরা কখন বিদ্রোহ করে?

১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে।

৪. কোন সুলতান দরবারি অভিজাতদের সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হন?

আলাউদ্দিন খলজি।

Leave a Comment