ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ

ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ হিসেবে রোমান সভ্যতার জন্মভূমি ইতালি, ভৌগোলিক অবস্থিতি, বণিক ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা, নবজাগরণের কেন্দ্র ফ্লোরেন্স, শহরের সমৃদ্ধি, কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন, ইতালির মানবতাবাদীদের অবদান, ধর্ম প্রতিষ্ঠানের অবদান, বিভিন্ন জাতির মিলনকেন্দ্র ও মুদ্রণ বিপ্লব সম্পর্কে জানবো।

রোমান সভ্যতার ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ
অর্থনবজন্ম বা পুনর্জন্ম
প্রথম সূচনাইতালির ফ্লোরেন্স
সময়কালপঞ্চদশ শতক
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ
দ্বিতীয় এথেন্সফ্লোরেন্স
ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ

ভূমিকা :- প্রাচীন রোমান সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ইতালিতেই সর্বপ্রথম নবজাগরণের সূচনা হয় এবং পরবর্তীকালে তা ইউরোপ -এর অন্যান্য দেশে প্রসারিত হয়।

ইতালিতে নবজাগরণের প্রসার

ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল শাসক ও অভিজাতরা ইতালি থেকে বিভিন্ন পণ্ডিতদের তাঁদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে যেতেন এবং বিভিন্ন দেশের ছাত্র ও পণ্ডিতরা জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে ইতালিতে আসতেন। এইভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নবজাগরণের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে।

ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ সংঘটিত হওয়ার কারণ

ইতালিতে নবজাগরণের সূচনার জন্য কয়েকটি কারণের উল্লেখ করা যায়।যথা –

(ক) রোমান সভ্যতার জন্মভূমি ইতালি

  • (১) ইতালি ছিল প্রাচীন রোমান সভ্যতার জন্মভূমি। রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হলেও ইতালি থেকে রোমান সভ্যতা ও কৃষ্টি একেবারে অবলুপ্ত হয় নি। রোমান সাহিত্য ও শিক্ষাধারা মঠগুলিতে তখনও অব্যাহত ছিল এবং রোমের প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন ইতালিতেই ছিল সর্বাধিক।
  • (২) এই শিক্ষা ও শিল্পকলা তখনও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত ও শিল্পীদের আকর্ষিত ও অনুপ্রাণিত করত। ইতালির অধিবাসীদের কথ্যভাষা ছিল ল্যাটিন। স্বাভাবিকভাবেই প্রাচীন সভ্যতা ও ল্যাটিন সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় ইতালীয়দের যথেষ্ট উৎসাহ ছিল।
  • (৩) ঐতিহাসিক ফিশার বলেন যে, প্রাচীন রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, লিপি, মুদ্রা ও বিভিন্ন স্মারক পণ্ডিতদের আকর্ষিত করত।

(২) ইতালির ভৌগোলিক অবস্থিতি

  • (১) ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যভাগে অবস্থিত ইতালি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রাচ্যদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল। ক্রুসেডের সময় থেকেই ফ্লোরেন্স, রোম, মিলান, ভেনিস ও অন্যান্য ইতালীয় শহরগুলির সঙ্গে আরবদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
  • (২) ইতালীয় শহরগুলিতে আরবীয় বিজ্ঞান, গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা শুরু হয়। সামস্তশ্রেণির প্রভাবমুক্ত এই নগরগুলিতে স্বাধীন চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের উন্মেষ ঘটে।
  • (৩) বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী এই শহরগুলিতে যে ধনবান মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়, তারা জীবন সম্পর্কে এক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন।

(গ) নবজাগরণে ইতালির বণিক ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা

  • (১) ইতালির বিভিন্ন শহরগুলির শাসকবর্গ ও ধনী বণিকেরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই ব্যাপারে ফ্লোরেন্স ও মিলানের শাসকদের কথা বলা যায়।
  • (২) রোম -এর পোপ পঞ্চম নিকোলাস, দ্বিতীয় জুলিয়াস এবং দশম লিও শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁদের উদ্যোগে রোমে প্রাচীন পুঁথিপত্র ও পাণ্ডুলিপির একটি বিরাট সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে।
  • (৩) শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিভিন্ন শহরগুলির মধ্যে সর্বদাই প্রতিযোগিতা চলত। স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিবাদ ও বাস্তববাদী চিন্তাধারা বিস্তার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নবজাগরণকে ত্বরান্বিত করে।

(ঘ) ইতালির নবজাগরণের কেন্দ্র ফ্লোরেন্স

  • (১) ইতালির নবজাগরণে ফ্লোরেন্স নগরী সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রাচ্যের সঙ্গে একচেটিয়া বাণিজ্য করে ফ্লোরেন্স সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পের পুনরুদ্ধারের জন্য এখানে কখনোই অর্থের অসুবিধা হয় নি।
  • (২) নগরের শাসকমণ্ডলী, নানা বিবদমান গোষ্ঠী ও বণিকেরা সর্বদাই নতুন শিক্ষাধারার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই ব্যাপারে ফ্লোরেন্সের শাসক কসিমো মেডিচি এবং লরেঞ্জো মেডিচি-র নাম উল্লেখযোগ্য। কসিমো ছিলেন সাহিত্য ও শিল্পের এবং লরেঞ্জো মেডিচি ছিলেন সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক।
  • (৩) মেডিচি দরবারে পণ্ডিত ও শিল্পীগণ সমাদৃত হতেন। তাঁদের সুরমা উদ্যানে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন সযত্নে রক্ষিত হত।
  • (৪) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক পণ্ডিতদের আগমনে ফ্লোরেন্স ‘ইতালির এথেন্স’ বা ‘দ্বিতীয় এথেন্স’-এ পরিণত হয়। ফ্লোরেন্সেই নবজাগরণের অগ্রদূত বিভিন্ন মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল।

(ঙ) ইতালির শহরের সমৃদ্ধি

ফ্লোরেন্স থেকে নবজাগরণের এই ধারা ইতালির মিলান, রোম, ভেনিস, জেনোয়া, নেপলস্ ও অপরাপর স্থানে বিস্তৃত হয়। শহরগুলির বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, কৃষ্টিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎসাহ ও শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় নবজাগরণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রোম নগরীতে পোপের প্রাধান্য থাকলেও অন্যান্য নগরীগুলিতে পোপের প্রাধান্য ছিল অনেক কম। সেগুলিতে ছিল বণিকদের প্রাধান্য এবং তারা ছিল মুক্তপন্থী।

(চ) নবজাগরণের কারণ কনস্টান্টিনোপলের পতন

  • (১) ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পতন। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ এই শহরটি দখল করলে এখানকার পণ্ডিতেরা ইতালিতে গিয়ে পাড়ি জমায়।
  • (২) পণ্ডিতেরা সঙ্গে নিয়ে আসেন গ্রিক সাহিত্যের মূল্যবান পান্ডুলিপি। এই সকল পণ্ডিতেরা ইতালির বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশায় যোগদান করেন এবং সাফল্যের সাথে তারা শিক্ষা সংক্রান্ত কাজ পরিচালনা করেন।
  • (৩) তাদের ইতালিতে আগমনের ফলে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের শিল্প সাহিত্য, দর্শন ,ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বলে উঠে।জেগে উঠে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা।
  • (৪) মানুষ জ্ঞানের জন্য বসে থাকে, সৃষ্টি হয় চিন্তাজগতের আলোড়ন যার ফলশ্রুতিতে ইতালিতে প্রথম রেনেসাঁ সূত্রপাত হয়।

(ছ) নবজাগরণে ইতালির মানবতাবাদী পণ্ডিতদের অবদান

  • (১) ইতালিতে মানবতাবাদীদের অবদান ছিল অসামান্য।জ্ঞানের সাধক এই সকল পণ্ডিতেরা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন।
  • (২) অতীত যুগের ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দর্শন প্রভৃতি অর্জন করে অর্জিত জ্ঞান সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা ছিল তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য।
  • (৩) মধ্যযুগের শিক্ষা ছিল ধর্ম সাপেক্ষ। কিন্তু প্রাচীন রোমান শিল্প-সাহিত্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ।সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে। মানবতাবাদি পণ্ডিতেরা প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে, অনুবাদ করে, প্রতিলিপি প্রস্তুত করে প্রচার করত। তারা তরুণদের নতুন নতুন জিজ্ঞাসা এবং জ্ঞানের আলো জাগিয়ে তুলতো।
  • (৪) ইতালিতে এরকম মানবতাবাদ পণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পেত্রার্ক,বোকাচ্চিও, দান্তে, প্রমুখ। মানবতাবাদি মহান চিত্রশিল্পী ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো। তাদের শিল্পকর্ম ইতালিতে বলিষ্ঠ অবদান রেখেছিল।

(জ) নবজাগরণে ইতালির ধর্ম প্রতিষ্ঠানের অবদান

  • (১) রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যেও ইতালির খ্রিষ্টান প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা অক্ষুন্ন রেখেছিল।তারা রোমের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল।
  • (২) ল্যাটিন ভাষার উন্নতি সাধনে, প্রাচীন পান্ডুলিপি উদ্ধার ও সংরক্ষণে রোমের পোপ পঞ্চম নিকোলাস, দ্বিতীয় জুলিয়াসও দশম লিওয়ের অবদান অনস্বীকার্য।তারা নতুন নতুন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে।
  • (৩) প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাচীন শিল্প সাহিত্য নিদর্শন ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। শিক্ষার্থীরা বিনা বাধায় সেইসব স্থানে সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা করতে পারত।ফলে স্থানগুলি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং রেনেসাঁসের গতিকে ত্বরান্বিত করে।

(ঝ) বিভিন্ন জাতির মিলনকেন্দ্র ইতালি

  • (১) প্রথম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় থেকেই ইতালি গথ,লোম্বার্ড,ফ্রাংক, স্যারাসেন,নর্মান ও জার্মান জাতির মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
  • (২) এই সূত্রে রোমান, বাইজানটাইন, আরব, জার্মান, প্রভৃতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির যোগাযোগের ফলে ইতালিতে এক নবচেতনা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।
  • (৩) আবার বহুজাতির সহাবস্থানের ফলে এখানকার সামাজিক জীবনে সহমর্মিতা বিরাজ করেছিল। এজন্য ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পন্ডিতেরা এখানেএসে দাঁড়িয়েছিল।

(ঞ) ইতালিতে মুদ্রণ বিপ্লব

মধ্যযুগে মূল পাণ্ডুলিপি হাতে নকল করা হত। এতে অনেক বেশি সময় ও অর্থ নষ্ট হত এবং লেখার অক্ষরে প্রচুর ভুল থেকে যেত। কিন্তু জার্মানির মেইনজ নগরীর বাসিন্দা জোহান গুটেনবার্গ সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার করলে তার প্রভাবে ইতালিতেও মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে পাণ্ডুলিপি ছাপানাের ব্যবস্থা শুরু হয়। বিভিন্ন বিষয়ের মুদ্রিত বইয়ের সূত্রে জ্ঞানের প্রসার ঘটতে শুরু করে, যা ইতালিতে নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করে।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে, উপযুক্ত কারণগুলির সমষ্টিগত ফলস্বরূপ পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতেই প্রথম রেনেসাঁসের সূত্রপাত হয়েছিল বা নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল ।

(FAQ) ইতালিতে প্রথম নবজাগরণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপের কোন দেশে প্রথম নবজাগরণের সূত্রপাত হয়?

ইতালি।

২. ইতালির কোন শহরে প্রথম নবজাগরণের সূত্রপাত হয়?

ফ্লোরেন্স শহরে।

৩. দ্বিতীয় এথেন্স বা ইতালির এথেন্স কাকে বলা হয়?

ফ্লোরেন্স শহরকে।

৪. কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটে কখন?

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment