বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর প্রসঙ্গে দুর্ভিক্ষের কারণ, ভয়াবহতা, বিশেষ উল্লেখ্য, সরকারের ভূমিকা, পঞ্চাশের মন্বন্তরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল সম্পর্কে জানব
বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর
ঐতিহাসিক ঘটনা | পঞ্চাশের মন্বন্তর |
বাংলা তারিখ | ১৩৫০ বঙ্গাব্দ |
ইংরেজি তারিখ | ১৯৪৩ খ্রি |
স্থান | অবিভক্ত বাংলা |
দেশ | ভারতবর্ষ |
নবান্ন | বিজন ভট্টাচার্য |
অশনি সংকেত | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
নিষিদ্ধ গ্ৰন্থ | ক্ষুধার্ত বাংলা |
ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান বার্মা বা ব্রহ্মদেশ দখল করে ভারতের দিকে নজর দেয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন) মাসে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। প্রায় এক বছর ধরে সারা বাংলায় দাপিয়ে বেড়িয়ে এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। অনাহারে ও অপুষ্ঠিতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। খাদ্যের অভাবে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মানুষ শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কোনো বিরল ঘটনা নয়
এটা কোনো বিরল ঘটনা ছিল না যে, অনাহারী মায়ের কঙ্কালসার দেহের ওপরে তার দুধের শিশুটি কখন মারা গেছে তা মায়ের দেখার শক্তিও নেই। একটু পরে মায়েরও মৃত্যু হয়। এক বছর পর খাদ্যের জোগান স্বাভাবিক হওয়ার পরও মহামারির ফলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সঠিক হিসেব ব্রিটিশ সরকার কখনও প্রকাশ করেনি। অনুমান করা হয়, এই দুর্ভিক্ষে বাংলার অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।
পঞ্চাশের মন্বন্তর
১৩৫০ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হয়েছিল বলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের এই দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর সাধারণভাবে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত।
বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ
স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের মদতে রচিত ইতিহাসে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) দুর্ভিক্ষের অর্থাৎ পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য সূত্র থেকে পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। সেই সব তথ্য বিচার করলে পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিভিন্ন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এই দুর্ভিক্ষের সম্ভাব্য কারণগুলি ছিল –
(ক) পূর্ববর্তী খাদ্য সংকট
এক্ষেত্রে প্রধান দুটি দিক হল –
(১) ১৯৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দের সংকট
অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে সীমিত আকারে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। তখন সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলে ব্যাপক প্রাণহানির হাত থেকে বাংলা রক্ষা পেলেও পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে বাংলার মানুষের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে।
(২) দারিদ্রাবৃদ্ধি
দরিদ্র মানুষের যেটুকু অর্থ-সম্পদ ছিল তাও খাদ্যক্রয়ে ফুরিয়ে যায়। ফলে বাংলার মানুষ আরও হতদরিদ্র হয়ে পড়ে।
(খ) খাদ্য উৎপাদন হ্রাস
এই সময় বিভিন্ন কারণে বাংলায় খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুমান করা হয় যে, পঞ্চাশের মন্বন্তরের পূর্বে বাংলায় যে পরিমাণ ধান উৎপন্ন হয় তার পরিমাণ ছিল বিগত ১০ বছরের গড় উৎপাদনের চেয়ে অন্তত ২.৫ মিলিয়ন টন কম। এর কারণগুলি ছিল –
(১) ঘূর্ণিঝড় ও জলস্রোত
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলস্রোতে বাংলার আমন ধানের উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়।
(২) ধানের মড়ক
ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে যেসব শস্য বেঁচে যায়, সেগুলি শীঘ্রই ‘বাদামি দাগ’ নামে পরিচিত এক ধরনের ছত্রাকঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়। এতে উৎপাদন ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যায়।
(৩) উদ্বৃত্ত শস্যের অভাব
ইতিমধ্যে খাদ্যের অভাবে গবাদিপশুগুলি অশক্ত হয়ে পড়লে পরের বছর চাষের কাজও ব্যাহত হয়। এর ফলে বাংলায় খাদ্যসংকট ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে চরমে ওঠে।
(গ) খাদ্য সরবরাহ হ্রাস
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) জোগানের ঘাটতি
পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল চাহিদার তুলনায় বাংলায় খাদ্যের জোগানে ঘাটতি। এই সময় বিভিন্ন কারণে কোচিন, ত্রিবান্দ্রম, বোম্বাই, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে এবং প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। সেখানকার ঘাটতি মেটাতে পাঞ্জাব ও অন্যান্য স্থানের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য প্রচুর পরিমাণে সেই সব অঞ্চলে রপ্তানি শুরু হয়। এর ফলে বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানি হ্রাস পেলে বা বন্ধ হলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে এখানে খাদ্যসংকট দেখা দেয়।
(২) যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী বছরগুলিতে বাংলায় ভয়াবহ বন্যার ফলে গ্রামের প্রধান রাস্তাগুলির অধিকাংশই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফলে দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে খাদ্যদ্রব্য পাঠানো এবং ত্রাণকার্য চালানো দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।
(ঘ) বার্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হওয়া
- (১) বিংশ শতকের প্রথমদিক থেকে বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানি করে এখানকার খাদ্যের চাহিদা মেটানো হত। বার্মা থেকে আমদানি করা চালে বাংলার অনেকটা ঘাটতি মিটত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাপান ইংরেজদের হাত থেকে বার্মা দখল করে নেয়। এর ফলে বার্মা থেকে বাংলা, তথা ভারতে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
- (২) বাংলায় দ্রুত চালের সংকট দেখা দেয়। এদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের সহযোগিতা নিয়ে সেই সময় বার্মা থেকে বাংলায় চাল পাঠানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাতে সাড়া না দেওয়ায় তাঁর উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বার্মা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যা। ফলে বাংলার খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়ে।
(ঙ) জাপানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কা
জাপান কর্তৃক বার্মা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল যে, জাপান হয়তো বাংলা হয়ে ব্রিটিশ-ভারতে অভিযান চালাতে পারে। এজন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগগুলি ছিল –
(১) ‘পোড়ামাটির নীতি’ ঘোষণা
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঘোষণা করেন যে, ইংরেজরা ভারতের সীমান্ত অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সেখানকার খাদ্য ও যানবাহন নির্মমভাবে ধ্বংস করা হবে এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা হবে। এভাবে সরকার ‘পোড়ামাটি নীতি’র দ্বারা ভারতে জাপানি সেনাদের সম্ভাব্য আক্রমণের সময় ভারতবাসীকে সমস্যায় ফেলার পরিকল্পনা করে।
(২) যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস
বার্মার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘পোড়ামাটি নীতি’ কার্যকরী হয়। সেখানকার মানুষ মাছ ধরা, পণ্য পরিবহণ প্রভৃতি কাজে যে সব নৌকা, মোটরযান, গোরুর গাড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করত, সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে সরকার সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়। ফলে বাংলার সীমান্তে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
(৩) বাংলার উপকূল অঞ্চলে গৃহীত যুদ্ধকৌশল
জাপানিরা সাগরপথে বাংলার উপকূলে এসে নামতে পারে – এই আশঙ্কায় সরকার কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে উপকূল অঞ্চলের সব নৌকা ধ্বংস করে। ফলে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে সেখানে খাদ্য আনার কোনো সুযোগ ছিল না।
(৪) সামরিক কাজে পুরুষদের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ
বাংলার বহু পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষদের সরকার সামরিক কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। ফলে সেসব পরিবারের নারী ও শিশুরা অভুক্ত থাকতে বা ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়
(চ) সরকারি নীতির ফাঁস
বিভিন্ন সরকারি নীতির ফলে বাংলায় খাদ্য আমদানি ব্যহত হয়। এই নীতিগুলি হল –
(১) কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় অন্যান্য রাজ্য থেকে খাদ্য আমদানি করে সরকার বাংলার খাদ্যাভাব দূর করতে পারত। কিন্তু সরকারি নীতির ফলে তা সম্ভব হয় নি। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে বাণিজ্যগণ্ডি তৈরি করার ফলে ব্যবসায়ীরা অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় খাদ্যশস্য আমদানি করতে ব্যর্থ হয়।
(২) প্রাদেশিক সরকারের বাধা
বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারগুলিও তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজ প্রদেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করে। পাঞ্জাবের অনেক ব্যবসায়ী বাংলায় খাদ্য রপ্তানি করতে চাইলেও পাঞ্জাব সরকার অনুমতি দেয় নি। পাঞ্জাবের মতো যেসব প্রদেশের শস্য উদ্বৃত্ত ছিল, সেখান থেকে বাংলা, মাদ্রাজ ও কোচিনের মতো খাদ্যসংকটযুক্ত অঞ্চলগুলিতে খাদ্য পাঠাতে রাজনৈতিক নেতা ও পদস্থ সরকারি কর্মচারীরা বাধার সৃষ্টি করে। বাংলায় খাদ্য আমদানি বন্ধ হলে শহর কলকাতায় মাত্র দু-সপ্তাহের খাদ্য মজুত ছিল
(ছ) পঞ্চাশের মন্বন্তরে চার্চিলের ভূমিকা
জার্মানির প্রবাসী বাঙালি লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জি সম্প্রতি ‘Churchill’s Secret War’ নামে তাঁর গবেষণাগ্রন্থে পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করেছেন। এক্ষেত্রে যুক্তি গুলি হল –
(১) জাহাজ সংকটের অজুহাত
বাংলার চরম দুর্যোগের দিনে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা সমুদ্রপথে জাহাজে করে বাংলায় খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু চার্চিল যুদ্ধের জন্য জাহাজ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে খাদ্য-পরিবহণে কোনো জাহাজ ছাড়তে রাজি হন নি।
(২) ভাইসরয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান
বাংলার দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে কমান্ডার-ইন-চিফ ওয়াভেল ও ভাইসরয় লিনলিথগো প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে জাহাজ চাইলে চার্চিল বুঝিয়ে দেন যে, এভাবে জাহাজ দিয়ে যুদ্ধের কার্যক্রমকে ব্যাহত করা যাবে না। উপরন্তু চার্চিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে জাহাজে করে বাংলায় খাদ্য পাঠানোর পরিবর্তে গ্রিস-এর দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
(৩) চার্চিলের হিটলার সুলভ মনোভাব
ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী লিও আমেরির ডায়রি থেকে মধুশ্রী মুখার্জি উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, “চার্চিল ও হিটলার-এর মনোভাবের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখতে পাই নি। তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে লাখো লাখো মানুষের খাবার কেড়ে নিয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন।” মধুশ্রী মুখার্জি উল্লেখ করেছেন যে, বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মৃত্যুতে নির্দয় চার্চিল মন্তব্য করেছিলেন, “ভারতীয়রা খরগোশের মতো বাচ্চা দেয়।” চার্চিলের এরূপ অমানবিক মনোভাবের ফলে দুর্ভিক্ষের সময় বাংলায় বিদেশি খাদ্য আমদানি সম্ভব হয় নি।
(জ) সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি
- (১) ভারতবর্ষ তখন খাদ্য উৎপাদনে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ছিল না। এজন্য কিছু পরিমাণ খাদ্য বাইরে থেকে আমদানি করতে হত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য ভারত থেকে রপ্তানি করে।
- (২) শ্রীলঙ্কায় অবস্থানকারী ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য প্রচুর খাদ্যশস্য পাঠানো হয় এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শস্য সরবরাহ করে সেনাদের চাহিদাপূরণ নিশ্চিত করতে গিয়ে বহু খাদ্যের অপচয় হয়েছিল। এভাবে দেশে খাদ্যশস্যের সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।
(ঝ) তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাব
খাদ্যশস্য উৎপাদন, চাহিদা ও জোগান সম্পর্কে যথার্থ পরিসংখ্যান সরকারের কাছে না থাকায় এবং তথ্যে গরমিল থাকায় সরকার পঞ্চাশের মন্বন্তরের মাত্রা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে এবং তার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
(ঞ) মজুতদারি
এক্ষেত্রে তিনটি দিক হল –
(১) সরকারের মজুতদারি
জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে বার্মা আক্রমণ করলে এবং ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বোমাবর্ষণ করলে বাংলায় দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা যায়। এই দুর্যোগের পরিস্থিতিতে সরকার সেনাদলের জন্য বাংলা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ চাল সংগ্রহ ও মজুত করে। যশোহরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টন চাল কিনে প্ল্যাটফর্মে রেখে দিয়ে দুর্ভিক্ষের সময়ও সে চাল বাইরে যেতে দেন নি। একইভাবে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে মজুত করা ৯০ হাজার টন চাল দুর্ভিক্ষের পরে পচে যাওয়ায় তা জলে ফেলে দিতে হয়েছিল।
(২) ব্যবসায়ীদের মজুতদারি
খাদ্যসংকটের আগাম আভাস পেয়ে বাংলার বহু ব্যবসায়ীও প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য কিনে গুদামে মজুত করে। এই মজুতদারির ফলে কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার সর্বত্র খাদ্যের অভাব দেখা দেয়।
(৩) সরকারি উদ্যোগের অভাব
মজুতদারি বন্ধ করতে বা গুদামে মজুত করা খাদ্য বাজারে ছাড়তে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয় নি। বাংলার দরিদ্র মানুষ প্রথমদিকে সর্বস্ব বিক্রি করে খাদ্যশস্য কিনলেও কিছুদিন পর আকাশছোঁয়া মূল্যে খাদ্য ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়।
(ট) খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি
এই সময় সারা ভারতেই বিশেষ করে বাংলাতে খাদ্যশস্যের প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এর কারণগুলি হল –
(১) খাদ্যশস্যের অভাব
সারা ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ খাদ্য উৎপাদন কম হলে বাংলার বাজারে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়।
(২) মজুতদারি
খাদ্যসংকটের আগাম আশঙ্কা করে বাংলার ধনী ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী খাদ্যশস্য মজুত করতে শুরু করে। ফলে বাজারে খাদ্যের জোগান আরও কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যশস্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
(৩) বাংলায় মূল্যবৃদ্ধির সর্বাধিক তীব্রতা
এই সময় খাদ্যসংকটের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলায়। ফলে বাংলায় খাদ্যশস্যের মূল্য একেবারে আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ে। দরিদ্র সাধারণ বাঙালি এই অগ্নিমূল্যে খাদ্য কিনতে অপারগ হয়ে পড়ে। অন্য প্রাদেশিক সরকারগুলির মতো বাংলার সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানায়। কিন্তু তাতে দুর্ভিক্ষের সময় বাংলার খাদ্যশস্যের মূল্য মোটেই হ্রাস পায় নি।
(ঠ) সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতা
এই দুর্ভিক্ষের জন্য যে সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতাও অনেকখানি দায়ী ছিল, তা বলা যায়। এরকম বলার কারণ হল –
(১) সতর্কবার্তায় কান না দেওয়া
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নেতা ফজলুল হক সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, “বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।” বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও আগে থেকেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বাংলার সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে আদৌ কর্ণপাত করে নি।
(২) বাংলার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন আচরণ
ইতিপূর্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সময় সরকার বাইরে থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ করত এবং দুর্ভিক্ষপীড়িতদের অর্থ সাহায্য করত। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার মন্বন্তরেও সরকার এরূপ দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় সরকার বাংলায় অনুরূপ দায়িত্ব পালন করে নি।
(৩) উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারের তৎপরতার অভাব
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যসংকট শুরু হলে বাংলার প্রাদেশিক সরকার এর মোকাবিলায় মোটেই তৎপরতা দেখায় নি। যখন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় সরকার তখন অতি ধীর গতিতে ত্রাণকার্য শুরু করে। একটি পর্যায়ে এসে সরকার তার কোশাগারের অর্থ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ত্রাণকার্যের গতি আরও কমিয়ে দেয়।
(৪) সামান্য সুবিধা থেকেও গ্রামকে বঞ্চনা
দুর্ভিক্ষের সময় সরকার কয়েকটি শহরে ন্যায্য মূল্যের সামান্য কয়েকটি দোকান খুললেও গ্রামগুলি এই ধরনের কোনো সুবিধা পায় নি।
(৫) নেতাদের বিরোধ
ফজলুল হক ও নাজিমুদ্দিনের মতো নেতারা দুর্ভিক্ষের সময় পরস্পরকে দোষারোপ করে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলেন।
(৬) দুর্নীতির ক্ষতিকারক প্রভাব
বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের পদস্থ কর্মচারীদের দুর্নীতি ও জালিয়াতি দুর্ভিক্ষকে তীব্রতর করে তুলেছিল।
(৭) সামরিক কারণে রেলের ব্যস্ত থাকা
সরকার এই সময় সামরিক কাজের সঙ্গে যুক্ত লোকজন ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতের রেলব্যবস্থাকে বেশি করে কাজে লাগায়। ফলে রেলের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হয়।
(ড) ড. অমর্ত্য সেনের অভিমত
এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ভাবে বলা যায় –
(১) মুদ্রাস্ফীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা পঞ্চাশের মন্বন্তরের অন্যতম কারণ ছিল বলে ড. অমর্ত্য সেন মনে করেন। তাঁর মতে, পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রথমে বাংলায় খাদ্যের আদৌ সংকট ছিল না। তিনি দাবি করেছেন যে, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে যখন দুর্ভিক্ষ ছিল না তখনকার তুলনায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যের জোগান বেশি ছিল। ড. সেনের মতে, এই সময় যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা এক শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তারা বেশি করে খাদ্য ক্রয় করলে বাজারে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়।
(২) ড. অমর্ত্য সেনের অভিমতের সমালোচনা
তবে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যশস্যের যে পর্যাপ্ত জোগানের কথা ড. সেন বলেছেন, সেই খাদ্য দুর্ভিক্ষের সময় কোথায় গেল বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মুদ্রাস্ফীতি অন্যান্য বছরগুলিতে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি না করে কেন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দেই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করল, তার সঠিক ব্যাখ্যা ড. সেনের আলোচনা থেকে পাওয়া যায় না।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সমকালীন বিভিন্ন বিবরণ থেকে এর কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়। মধুশ্রী মুখার্জি তাঁর ‘Churchill’s Secret War : The British Empire and the Ravaging of India During World War II’ নামক বইটিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিভিন্ন মর্মন্তুদ কাহিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে –
- (১) ফরিদপুরের এক বৃদ্ধ জানিয়েছেন তাদের জেলেপট্টির ৫০টি পরিবারের মধ্যে সবগুলিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
- (২) খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে এক দরিদ্র কৃষক তার বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।
- (৩) এক ক্ষুধার্ত অসহায় পিতা তার কোলের সন্তানকে বিক্রি করার জন্য কোনো ক্রেতা না পেয়ে শিশুটিকে একটি কুয়োয় ছুঁড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
- (৪) চট্টগ্রামের এক ব্রিটিশ সেনা জানিয়েছেন, একবার তাঁদের সেনা ছাউনির গার্ড বিমর্ষ হয়ে দেখেছেন যে, একটি শিয়াল তখনও বেঁচে থাকা একটি মেয়ের হাত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ্য
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কলকাতার ফুটপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলি গণমাধ্যমে কিছুটা প্রচার পেলেও গ্রামবাংলার মৃত্যুগুলি ঘটেছে নীরবে, নিঃশষে। শিয়াল-কুকুর মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে সরকারের ভূমিকা
পঞ্চাশের মন্বন্তরের মোকাবিলায় সরকারের যে সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব ছিল, তা সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় যেমন –
(১) সরকারের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার মনে করত যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলায় খাদ্যের কোনো সংকট নেই। খাদ্যের মজুতদারিই বাংলার দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ। প্রশাসন এই মজুতদারি বন্ধ করলেই দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দুর্ভিক্ষ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তখনও বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে এই মজুতদারির তত্ত্বকেই আঁকড়ে ছিলেন। এই অজুহাত দেখিয়ে সরকার প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল এবং নিজে থেকে অনাহারী মানুষকে খাদ্য জোগান দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে নি।
(২) ধনীদের অধিক ক্রয়ের তত্ত্ব
সরকারের দিক থেকে এমন যুক্তিও দেওয়া হয়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুদ্রাস্ফীতির ফলে বাংলার ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ জমা হয়েছিল। এই অর্থে তারা প্রচুর খাদ্য কিনে নিলে বাংলায় সংকট শুরু হয়।
(৩) মজুতদারি বন্ধে সরকারি উদ্যোগের অভাব
মজুতদারি বন্ধ করতে বা গুদামে মজুত করা খাদ্য বাজারে ছাড়তে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয় নি। বাংলার দরিদ্র মানুষ প্রথমদিকে সর্বস্ব বিক্রি করে খাদ্যশস্য কিনলেও কিছুদিন পর আকাশছোঁয়া মূল্যে খাদ্য ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
যাইহোক, এই দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলার অন্তত ১০ শতাংশ হতদরিদ্র মানুষ। বিদেশ থেকে যেটুকু সহায়তা এসেছিল তা মরুভূমির উত্তপ্ত মাটিতে এক বিন্দু জলের সঙ্গেই তুলনীয় ছিল। তা ছাড়া সেই সহায়তা বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে এত দেরিতে পৌঁছেছিল যে তার মধ্যেই বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ঘটা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত বাংলার দুর্ভিক্ষের চিত্রটি ছিল অত্যন্ত করুণ ও মর্মভেদী। এই দুর্ভিক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলি হল –
(ক) মৃত্যুর মিছিল
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) অগণিত মৃত্যু
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় গ্রামবাংলায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দুর্ভিক্ষে অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ বা তারও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করেনি।
(২) মৃতদেহের স্তূপ
এই সময় বাংলার রাস্তাঘাটে, বনেবাদাড়ে অনাহারে মৃত মানুষের দেহ স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যেত। মৃতদেহ সৎকারের মানুষ ছিল না। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মৃতদেহের দখল নিয়ে শিয়াল আর কুকুরের মধ্যে লড়াই চলত।
(৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ
পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলায় যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তত মানুষের মৃত্যু হয় নি। এই মন্বন্তরের ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি ছিল।
(খ) মানবিক বিপর্যয়
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় সমগ্র বাংলার সমাজজীবনে এক চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। যেমন –
(১) অখাদ্য ভক্ষণ
মানুষ দুর্ভিক্ষের সময় খিদের জ্বালায় অখাদ্য পশু মাংস, কীটপতঙ্গ, লতাপাতা, এমনকি দুর্বাঘাস পর্যন্ত খেতে শুরু করেছিল। অভুক্ত মানুষ কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে শহরের ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্যসংগ্রহের চেষ্টা করছে – এই দৃশ্য তখন খুবই সাধারণ ছিল। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকে এই চিত্রের উল্লেখ আছে।
(২) পারিবারিক জীবনে ভাঙন
খাদ্যের সন্ধানে পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন শহরে চলে গেলে গ্রাম-বাংলার পারিবারিক জীবন ভেঙে পড়ে। অভাবের তাড়নায় স্বামী তার স্ত্রীকে, পিতামাতা তাদের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুমুখে ফেলে রেখে নিজে বাঁচার তাগিদে অন্যত্র চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও বোধ হয় এত বড়ো মানবিক বিপর্যয় ঘটে নি।
(গ) অর্থনৈতিক বিপর্যয়
পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার অধিকাংশ মানুষের জীবনে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। যেমন –
(১) সঞ্চিত অর্থ ব্যয়
দরিদ্র পরিবারগুলি দীর্ঘকাল ধরে যে ধন যক্ষের মতো সযত্নে রক্ষা করে আসছিল খাদ্যসংকটের শুরুতে তা দিয়ে খাদ্য ক্রয় করেছিল। এর দ্বারা তারা হয়তো মাত্র কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের খাবারের সংস্থান করতে পেরেছিল।
(২) ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ
সঞ্চিত সামান্য অর্থসম্পদ শীঘ্রই ফুরিয়ে গেলে নিঃস্ব-রিক্ত অভুক্ত মানুষগুলি থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষা করতে বেরিয়ে পড়ে। “মা, একটু ফ্যান দাও” বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতার রাস্তায় বুভুক্ষু মানুষের দল দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং পরে অভুক্ত, কঙ্কালসার এই মানুষগুলি রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকছে – সে সময় এই দৃশ্য কলকাতার সর্বত্র দেখা যেত।
(ঘ) খাদ্য সরবরাহ
দেরিতে হলেও সরকারের টনক নড়ে। সরকার দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। এ ধরনের দু-একটি উদ্যোগ হল –
(১) ন্যায্য মূল্যের দোকান খোলা
শহরে কয়েকটি ন্যায্য মূল্যের দোকান খুলে মানুষের কাছে সঠিক মূল্যে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের এই প্রয়াস ছিল সিন্ধুতে বিন্দুর সমতুল্য।
(২) খাদ্য আমদানি
বাইরে থেকে বাংলায় প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করা হয়। বাংলায় মন্বন্তরের পরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৬৪ হাজার টন চাল, ২৫৮ হাজার টন গম এবং ৫৫ হাজার টন মিলেট বাংলায় আমদানি করে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। অবশ্য অনেক দেরিতে খাদ্য আমদানি করায় ইতিমধ্যেই বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল।
(ঙ) কমিশন গঠন
দুর্ভিক্ষের পর সরকার মন্বন্তরের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে সরকার দুর্ভিক্ষের পর ‘দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন দীর্ঘ তদন্ত করে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারকে তার রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন তার রিপোর্টে পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক, পৌর ও সামরিক নীতির ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, অন্য কোনো দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশের সরকার নিজের বিরুদ্ধে এরূপ সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বলে খুব একটা শোনা যায় না।
(চ) শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি
পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকে কেন্দ্র করে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। যেমন –
(১) চিত্তপ্রসাদের অবদান
চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর ‘ক্ষুধার্ত বাংলা : ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’ গ্রন্থে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। দুর্ভিক্ষের ওপর তাঁর আঁকা ছবিগুলির জন্য শিল্পজগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
(২) বিজন ভট্টাচার্যের অবদান
বিজন ভট্টাচার্য তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। শম্ভু মিত্র-এর পরিচালনায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি মঞ্চস্থ করে। পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই নাটকটি মধ্যস্থ করে তারা গ্রামবাংলার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণ তহবিল গড়ে তোলেন।
(৩) বিভূতিভূষণের অবদান
পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসটি রচনা করেন। উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেন বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
(৪) অন্যান্য সৃষ্টি
এ ছাড়া ভবানী ভট্টাচার্যের So Many Hungers, অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘আকালের সন্ধানে’ (যা পরে চলচ্চিত্রে রূপ দেন মৃণাল সেন), কে. এ. আব্বাস পরিচালিত ‘ধরতি কে লাল’ ও বিমল রায় পরিচালিত Bengal Famine চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিভিন্ন চিত্র প্রভৃতিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনি ধরা পড়েছে।
(ছ) গ্ৰন্থ নিষিদ্ধকরণ
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) সরকারের মুখোশ উন্মোচন
চিত্তপ্রসাদ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত বাংলা : ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’ গ্রন্থে পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে জীবন্ত করুণ চিত্র তুলে ধরেছিলেন তাতে সরকারের মুখোশ খুলে যায়। এই গ্রন্থে চিত্তপ্রসাদ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ভুল নীতি ও অবহেলাকে দায়ী করেছেন। এতে সরকার যথেষ্ট বিব্রত হয় এবং সরকারকে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
(২) বই বাজেয়াপ্ত
চিত্তপ্রসাদের এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার এটি নিষিদ্ধ করে এবং এর ৫০০০ কপি বাজেয়াপ্ত করে। এই বইয়ের একটি কপি লুকানো অবস্থায় চিত্তপ্রসাদের পারিবারিক সংগ্রহে থেকে গিয়েছিল সেটি বর্তমানে দিল্লির আর্ট গ্যালারিতে রাখা আছে।
উপসংহার :- পঞ্চাশের এই ভয়াবহ মন্বন্তর নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এই সময়ের ঘটনা ও তথ্য অনুসারে পরবর্তীকালে দেশে কোনো বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্ৰহণ করলে হয়তো সৃষ্টি হবে আর একটা ‘আনন্দমঠ‘।
(FAQ) বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৩৫০ বঙ্গাব্দে।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কে।
বিজন ভট্টাচার্য।
অমলেন্দু চক্রবর্তী।