স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহেরুর উদ্যোগ, বিজ্ঞানীদের ভূমিকা, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণা, কৃষি প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, সম্প্রচার প্রযুক্তি, ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ব্যর্থতা ও ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে সাফল্য সম্পর্কে জানবো।

স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

ঐতিহাসিক ঘটনাস্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি
প্রথম আই আই টিখড়্গপুর
CATইন্দোর
সফল পরমাণু বিস্ফোরণ১৮ মে ১৯৭৪ খ্রি
কৃষিপ্রযুক্তির উন্নতিসি সুব্রহ্মনিয়াম
দূরদর্শন সম্প্রচার১৯৫৯ খ্রি
স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

ভূমিকা:- স্বাধীন ভারত-এ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ভারতে প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্ৰগতি

স্বাধীন ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) নেহরুর উদ্যোগ

বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করেছিলেন যে, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ওপর স্বাধীন ভারতের সার্বিক অগ্রগতিও নির্ভর করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নেহরুর অনুরাগ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এস. গোপাল বলেছেন যে, গান্ধী, লেনিন বা আইনস্টাইন-এর মতো মৌলিক চিন্তার অধিকারী নেহরু ছিলেন না। কিন্তু তিনি সর্বদা সৃষ্টিশীল প্রেরণার দ্বারা পরিচালিত হতেন। তিনি বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে তাকে নতুন ভারত গঠনের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। প্রযুক্তির উন্নতির জন্য তিনি সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

(২) বিজ্ঞানীদের ভূমিকা

প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে ভারতে যেসব বিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, ড. বিক্রম সারাভাই এবং শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। হোমি জাহাঙ্গির ভাবার উদ্যোগে ভারতে পারমাণবিক ও মহাকাশ গবেষণার সূত্রপাত ঘটে।

(৩) ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি

ভারতে প্রযুক্তিশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ২২ সদস্য-বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি আমেরিকার ‘মাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’র অনুকরণে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত দেয়। সেই অনুসারে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ-এর খড়গপুরে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। প্রযুক্তির উন্নতি বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় Centre for Advanced Technologies বা CAT।

(৪) মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণা

মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগতির উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ‘ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (Indian Space Research Organisation) গড়ে তোলা হয়। ভারতের মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচিতে অসামান্য অবদানের জন্য পদার্থবিদ ড. বিক্রম সারাভাইকে ‘ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জনক’ বলা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় ভারতে পরমাণু শক্তি গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। ভারত ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে পোখরানে প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

(৫) কৃষি প্রযুক্তি

বিজ্ঞানী সি. সুব্রহ্মনিয়াম ভারতে কৃষি প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি গবেষণাগারে উন্নততর কৃষিবীজ তৈরি করেন। জলসেচের ব্যাপক প্রসারের ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অতিরিক্ত ৪৫ মিলিয়ন কৃষিজমি জলসেচের আওতায় আসে। খাদ্য উৎপাদনও ৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়।

(৬) প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি

স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ‘প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৭) সম্প্রচার প্রযুক্তি

ভারতে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বেতার সম্প্রচার শুরু হলেও তা স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে যথেষ্ট প্রসারিত হয়। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’ ‘আকাশবাণী’-তে পরিণত হয়। দূরদর্শন সম্প্রচার ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে তা ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে যথেষ্ট গতিশীল হয়। ১৯৬০-এর দশকে ভারতে কম্পিউটার সফটওয়্যার গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।

ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে ব্যর্থতা

স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও এর অগ্রগতি মোটেই আশানুরূপ হয় নি। এর কারণ গুলি হল –

(১) জন-বিস্ফোরণ

প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির ফলে ভারতে সামগ্রিক উন্নতির যে সম্ভাবনা ছিল তার পথে সবচেয়ে বাধার সৃষ্টি করে অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী ৬০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা অন্তত ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১/৩ অংশই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে।

(২) অর্থসংকট

জনসংখ্যার অনুপাতে ভারতে গবেষক প্রযুক্তিবিদের সংখ্যা যেমন খুবই কম তেমনি প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণও খুবই কম। ভারতের তুলনায় আমেরিকায় এই বিষয়ে অর্থ বিনিয়োগ হয় অন্তত ৭৫ গুণ বেশি।

ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে সাফল্য

বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েও ভারত প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়। যেমন –

(১) কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি

কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব কৃষিপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির অন্যতম দৃষ্টান্ত। সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতে খাদ্য উৎপাদন ৫৫ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৫ মিলিয়ন টনে পৌঁছোয়। এর ফলে খাদ্য আমদানিকারক দেশ ভারত খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়।

(২) শক্তি উৎপাদন

শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ভারতের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ মিলিয়ন টন থেকে ৩৪০ মিলিয়ন টনে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২.৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট থেকে ৮৫ মিলিয়ন কিলোওয়াটে পৌঁছোয়।

(৩) ইস্পাত উৎপাদন

ইস্পাত উৎপাদন ১ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ মিলিয়ন টনে পৌঁছোয়।

(৪) আই টি আই এর উৎকর্ষ

আমাদের পক্ষে খুবই সুখের খবর হল যে, এশিয়া মহাদেশের সেরা দশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫টি অধিকার করে আছে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি।

উপসংহার :- কিছু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে এর অন্যতম উদাহরণ হল কৃষি প্রযুক্তিতে অগ্রগতির অন্যতম দৃষ্টান্ত কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব হয়। শক্তি এবং ইস্পাত উৎপাদনের হার বৃদ্ধি দেশের প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে বিশেষ সহায়তা করেছে।

(FAQ) স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী কে ছিলেন?

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।

২. ভারতের প্রথম আই আই টি কখন কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮ আগস্ট ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে, পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুরে।

৩. CAT কখন কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে।

৪. ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জনক কাকে বলা হয়?

ডক্টর বিক্রম সারাভাইকে।

৫. ভারতের কোথায় প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়?

১৮ মে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে পোখরানে।

Leave a Comment