চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, চাকরি গ্ৰহণ, বিবাহ, ইংল্যান্ড গমন, পথের পাঁচালী ছবি তৈরি, অপরাজিতা ছবি, অপুর সংসার ছবি, রবীন্দ্রনাথ অবলম্বনে ছবি, হিন্দি ছবি, গোয়েন্দা ছবি, সাহিত্য সৃষ্টি, চিত্রশিল্পী, অস্কার বিজয়ী ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | সত্যজিৎ রায় |
জন্ম | ২ মে, ১৯২১ খ্রি: |
দেশ | ভারত |
পরিচিতি | চলচ্চিত্র পরিচালক |
শ্রেষ্ঠ ছবি | পথের পাঁচালী |
সম্মান | অস্কার পুরস্কার |
মৃত্যু | ১৯১২ খ্রি: |
ভূমিকা :- বিশ্ববরেণ্য জাপানী চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, “এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখে চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতই অদ্ভুত ঘটনা।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পর বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অপর কেউই বিশ্বের দরবারে এতখানি সম্মান পাননি। ভারতীয় চলচ্চিত্রকে তিনি শুধু যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাই নয়, তাকে এক মহত্তর সৌন্দর্যে উত্তরণ ঘটিয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম
বিরল প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির জন্ম ১৯২১ সালের ২রা মে।
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বংশ পরিচয়
- (১) কৃতী বংশের যোগ্য উত্তরপুরুষ। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একমাত্র ঠাকুর পরিবারের সঙ্গেই এই পরিবারের তুলনা করা যায়। সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ছিলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা।
- (২) সাহিত্য ছাড়াও বাংলা ছাপাখানার উন্নতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিরাট। ১৯০০ সালে তিনি সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে ইউ রায় অ্যান্ড সঙ্গ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। এখান থেকে বহু বই প্রকাশিত হয়েছিল।
- (৩) উপেন্দ্রকিশোরের বড় ভাই সারদারঞ্জন ছিলেন পণ্ডিত মানুষ আর ক্রিকেটের ভক্ত। আরেক ভাই কুলদারঞ্জনও ছিলেন সাহিত্যিক। তাঁর কন্যা বিখ্যাত সাহিত্যিক লীলা মজুমদার।
- (৪) উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায়-এর জন্ম ১৮৮৭ সালে। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর ছবি আঁকা, কবিতা লেখা। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর সন্দেশ পত্রিকা চালু করবার পর সুকুমার সেখানে নিয়মিত লিখতেন।
- (৫) ১৯১৪ সালে সুকুমারের বিয়ে হল ঢাকার বিখ্যাত সমাজসেবক কালীনারায়ণ গুপ্তের নাতনি সুপ্রভার সাথে। বিবাহের ৭ বছর পর জন্ম হয় সত্যজিতের। ১৯২৩ সাল, সত্যজিৎ তখন দু বছরের শিশু, কয়েকদিনের জ্বরে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মারা গেলেন সুকুমার। এই স্বল্প জীবনকালেই তিনি রচনা করেছেন আবোল তাবোল, হ- য-ব-র-ল, পাগলা দাশুর মত অসাধারণ শিশু সাহিত্য।
সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষা
১৯৪০ সালে বি. এ. পাশ করলেন সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথ খুবই স্নেহ করতেন সত্যজিৎকে। প্রধানত তাঁরই আগ্রহে ভর্তি হলেন শান্তিনিকেতন– এর শিল্প বিভাগে এখানে নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকার তালিম নিতেন।
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের চাকরি গ্ৰহণ
এক বছর পর তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। বাড়িতে বিধবা মা, অন্যের উপর নির্ভর করে কতদিন জীবনধারণ করবেন। ১৯৪৩ সালে ডি. জে. কীমার নামে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের বিবাহ
১৯৪৮ সালে সত্যজিৎ তাঁর মায়ের বৈমাত্রেয় ভাই চারুচন্দ্রের ছোট মেয়ে বিজয়াকে বিয়ে করলেন। দুজনেই পরস্পরকে ভালবাসতেন। শুধুমাত্র পুত্রের সুখের কথা ভেবে সুপ্রভা দেবী এই বিবাহে মত দিলেন।
চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায়ের ইংল্যান্ড গমন
চাকরিসূত্রে কয়েক মাসের জন্য ইংল্যান্ড-এ গেলেন সত্যজিৎ। এই সময় তিনি ইউরোপ–আমেরিকার শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের অসংখ্য ছবি দেখতেন। যা দেখতেন গভীরভাবে অনুভব করবার চেষ্টা করতেন।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবি
- (১) ভারতে ফিরে এসে স্থির করলেন পথের পাঁচালী ছবি করবেন। সত্যজিতের মায়ের এক বন্ধুর সাথে বিধানচন্দ্র রায়-এর পরিচয় ছিল। সেই সূত্রেই সত্যজিৎ তাঁকে পথের পাঁচালীর কিছুটা অংশ দেখালেন। পথের পাঁচালী বিধান রায়ের ভাল লেগেছিল। তিনি দশ হাজার টাকার সরকারী অনুদান দিলেন।
- (২) আমেরিকা থেকে এসেছিলেন মনরো হুইলার। পথের পাঁচালীর অর্ধেক দেখেই তিনি মুগ্ধ হলেন। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে নিউইয়র্কে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি সেখানে পথের পাঁচালীকে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলেন।
- (৩) সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ছবি শেষ হল। বাক্সবন্দী পথের পাঁচালী ছবি পাঠানো হল আমেরিকায়। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে মুক্তি পেল। প্রযোজক পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
- (৪) প্রথম দিকে দর্শকরা এই ছবিটিকে গ্রহণ করতে না পারলেও কয়েক সপ্তাহ পর থেকে চারদিকে সত্যজিতের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। জনসাধারণের ভিড় বাড়তে থাকে। এর মূলে ছিল পথের পাঁচালীর অসাধারণত্ব।
- (৫) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের মূল সুরটিকে এক আশ্চর্য দক্ষতায় ছবির পর্দার ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ। প্রত্যেকের অভিনয় ছিল জীবন্ত আর সজীব। এর সাথে ছিল রবিশঙ্করের অসাধারণ সংগীত।
- (৬) রবিশঙ্করই প্রথম দেখালেন চলচ্চিত্রে সংগীতের কত সার্থক প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে পথের পাঁচালীর মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন লাভ
১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেল পথের পাঁচালী। তারপর দেশে-বিদেশে একের পর এক পুরস্কার। এক অখ্যাত বাঙালী তরুণ শুধুমাত্র একটি ছবি করেই জগৎবিখ্যাত হয়ে গেলেন। পথের পাঁচালী শুধু একটি ছবি নয়, গভীর প্রশান্ত সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত এক তুলনাহীন সৃষ্টি-যা দেশকাল উত্তীর্ণ হয়ে মানুষকে অভিভূত করে। জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “সত্যজিৎ রায় আর তাঁর ছবি পথের পাঁচালী আমাদের গর্ব।”
সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিতা ছবি
পথের পাঁচালীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সত্যজিৎ তৈরি করলেন অপরাজিতা। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি। অপুর কৈশোর জীবনের কাহিনী। অপরাজিতা সাধারণ দর্শকরা গ্রহণ করতে না পারলেও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব-এ পেল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গোল্ডেন লায়ন।
চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার ছবি
এর পর সত্যজিৎ তৈরি করলেন অপু ট্রিলজির শেষ ছবি অপুর সংসার। এই ছবিতে নিয়ে এলেন তরুণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর চৌদ্দ বছরের কিশোরী শর্মিলা ঠাকুরকে। লন্ডন ফিল ফেস্টিভ্যালে অপুর সংসারকে দেওয়া হল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ট্রিলজির কোন তুলনা নেই। মহান সাহিত্যস্রষ্টাদের সৃষ্টির সাথেই এর তুলনা করা যায়।
সত্যজিত রায়ের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ
অপরাজিতা ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। এই ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য না পাওয়ার জন্য সত্যজিৎ অপুর সংসারের আগে দুটি ছোট ছবি তৈরি করেন পরশ পাথর (১৯৫৭) আর জলসাঘর (১৯৫৮)। জলসাঘর তারাশঙ্করের একটি ছোট গল্প। দুটি ছবিতেই সত্যজিতের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।
পরিচালক সত্যজিত রায়ের প্রাঞ্জল ও সরল ছবি দেবী
- (১) এরপর তৈরি করলেন দেবী। হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানলেন সত্যজিৎ। এক শ্রেণীর মানুষ এই ছবির মুক্তির ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জওহরলালের হস্তক্ষেপে এই ছবি মুক্তি পেল।
- (২) প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রবাট স্টীল লিখেছেন, সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমার জীবন শুরুই করেছেন মাস্টারপীস ছবি দিয়ে। যদি অপু সৃষ্টি না হত তবে দেবীকে সেই সম্মান দেওয়া হত। দেবী সত্যজিতের সবচেয়ে প্রাঞ্জল আর সরল ছবি। এর মধ্যে আছে এক আবেগের গভীরতা আর সৌন্দর্য যা তুলনাহীন।
রবীন্দ্রনাথ অবলম্বনে সত্যজিত রায়ের ছবি
রবীন্দ্রকাব্য সত্যজিৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোট গল্প অবলম্বনে তৈরি করলেন তিন কন্যা, মণিহারা, পোস্টমাস্টার আর সমাপ্তি। মেলবোর্ন ফিল ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরুস্কার পেল তিন কন্যা। সমাপ্তি গল্পেই প্রথম অভিনয় করলেন কিশোরী অপর্ণা।
সত্যজিত রায়ের ভিন্নধর্মী ছবি নায়ক
এর পর একে একে মুক্তি পেতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিযান (১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কাপুরুষ ও মহাপুরুষ (১৯৬৫), নায়ক (১৯৬৬)। নায়ক সত্যজিত্যের এক সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবি। এক বিখ্যাত অভিনেতার জীবন যন্ত্রণার কাহিনী।
চিত্রশিল্পী সত্যজিত রায়ের ছবি অশনি সংকেত
- (১) পথের পাঁচালীর পর গ্রাম্যজীবন নিয়ে দ্বিতীয় ছবি করেন বিভূতিভূষণের কাহিনী অবলম্বন করে অশনি সংকেত (১৯৭৩)। ৪৩-এর মন্বন্তর কিভাবে গ্রামের সহজ সরল জীবনকে ধ্বংস করে নিয়ে এল দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর ব্যভিচার, তারই এক জীবন্ত চিত্র।
- (২) এই ছবির কোনো চরিত্রকেই মনে হয়নি তারা অভিনয় করছে। সকলেই যেন জীবনের পাতা থেকে উঠে এসেছে। দুর্ভিক্ষের উপর এমন ছবি বিশ্বে খুবই কম তৈরি হয়েছিল। বার্লিন, শিকাগো দুটি চলচ্চিত্র উৎসবেই অশনি সংকেত পেয়েছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার।
সত্যজিত রায়ের প্রথম হিন্দি ছবি শতরঞ্জ কে খিলাড়ী
মুন্সী প্রেমচাদের কাহিনী অবলম্বন করে প্রথম হিন্দী ছবি করলেন শতরঞ্জ কে খিলাড়ী। দুই বিরাসী ওমরাহ সমাজ সংসার ভুলে দাবা খেলায় মত্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইংরেজরা রাজনৈতিক চালে এক একটি রাজ্য দখল করতে থাকে। নিতান্ত সাধারণ কাহিনী, ঘটনার ঘনঘটা নেই। কিন্তু প্রতিভার স্পর্শে অসাধারণ ছবি হয়ে উঠেছে শতরঞ্জ কে খিলাড়ী।
পরিচালক সত্যজিত রায় সম্পর্কে স্যার রিচার্ডের মন্তব্য
সত্যজিতের ছবির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল অতি সামান্য বিষয়ও যাতে নিখুঁত হয় সেদিকে ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি। সেই কারণে স্যার রিচার্ড অ্যাটনবরো বলেছিলেন, “সত্যজিতের যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল তা প্রতিটি বিষয়ের প্রতি তাঁর ভীক্ষ্ণ দৃষ্টি। একমাত্র চ্যাপলিন ছাড়া আর কোনো পরিচালকের সত্যজিতের মত সিনেমা পরিচালনার ব্যাপারে সকল বিষয়ে প্রতিভা আছে কিনা সন্দেহ।”
সত্যজিত রায়ের গোয়েন্দা ছবি
নিজেরই কাহিনী অবলম্বন করে সত্যজিৎ তৈরি করেছিলেন দুটি গোয়েন্দা ছবি সোনার কেল্লা আর জয় বাবা ফেলুনাথ। নিছক গোয়েন্দা লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে তিনি কাহিনীকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মনোমুগ্ধকর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে যুক্ত করেছিলেন হাসি আর হেঁয়ালি। ছোটদের জন্য এত সুন্দর গোয়েন্দা কাহিনী খুব কমই তৈরি হয়েছে।
চিত্রশিল্পী সত্যজিত রায়ের ছবি ঘরে বাইরে
সত্যজিৎ যখন ডি. জে. কীমারে চাকরি করতেন তখনই তাঁর মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের “ঘরে বাইরে” অবলম্বনে ছবি করবেন। কিন্তু সেই সময় তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। অবশেষে ১৯৮৪ সালে তৈরি করলেন ঘরে বাইরে। রবীন্দ্র রচনার মূল সুরটিকে এত নিপুণভাবে সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে তুলে ধরেছেন যা আর কোনো পরিচালকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ক্রমশই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল।
সত্যজিত রায়ের শেষ পর্বের ছবি
ঘরে বাইরের পর বেশ কয়েক বছর কোন ছবি করেননি। ১৯৮৯ সালে ইবসেন-এর কাহিনী অবলম্বনের তৈরি করেছিলেন গণশত্রু (১৯৮৯), তারপর শাখা-প্রশাখা (১৯৯০), শেষ ছবি আগন্তুক (১৯৯১)।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে সত্যজিত রায়ের স্থান
- (১) চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে সত্যজিতের স্থান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কয়েকজন পরিচালকের মধ্যে। তাঁর ছবিতে যে গভীর সূক্ষ্ম অনুভূতি, নান্দনিক সৌন্দর্য, জীবনের ব্যাপ্তি, বিষয়বস্তুর প্রতি নিষ্ঠার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তা তুলনাহীন।
- (২) তাঁর ছবি যেন সংগীত, শ্রেষ্ঠ কবির কবিতা। যতবার দেখা যায় ততবারই উন্মোচন হয় নতুন সৌন্দর্য, মনের জগতে উন্মোচিত করে এক নতুন সৌন্দর্য, মনের জগতে উন্মোচিত করে এক নতুন দিগন্ত । যার মধ্যে আমরা আমাদেরই খুঁজে পাই।
সাহিত্যস্রষ্টা সত্যজিত রায়
- (১) চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিতের খ্যাতি জগৎ জোড়া হলেও সাহিত্যস্রষ্টা হিসাবে তাঁর খ্যাতি কিছুমাত্র কম নয়। তাঁর পিতা-পিতামহের ঐতিহ্য অনুসরণে তিনিও নানান বিষয় নিয়ে লিখতেন। তাঁদের পারিবারিক পত্রিকা চালু হল।
- (২) এই পত্রিকার জন্য নিজেই কলম ধরলেন সত্যজিৎ। নিজে ছোট ছোট ছড়া লিখতেন। এবার লিখলেন ধারাবাহিক বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস প্রফেসর শঙ্কু। পরবর্তীকালে প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে আরো কয়েকটি বই লিখেছেন।
- (৩) তবে সত্যজিতে আসল খ্যাতি তাঁর ফেলুদাকে নিয়ে। শিশু-কিশোরদের কাছে ফেলুদার আকর্ষণ অতুলনীয়। গোয়েন্দা গল্পের গোয়েন্দা ফেলুদা তার স্রষ্টার মতই বিখ্যাত। সত্যজিতের গল্প বলার ভঙ্গি অসাধারণ।
- (৪) সহজ সরল ভাষা, কাহিনীর নিটোল বুনন, অপূর্ব বর্ণনা, টানটান উত্তেজনা পাঠককে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ করে রাখে। তাঁর রচনা, চিরায়ত সাহিত্যের পর্যায়ে না পড়লেও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
- (৫) ফেলুদা, শঙ্কু ছাড়াও সত্যজিৎ বেশ কিছু ছোট গল্প লিখেছেন, যেমন এক ডজন গপ্পো, আরো এক ডজন, আরো বারো এই বইগুলির প্রতিটি গল্পই যেমন উপভোগ্য তেমনি সার্থক সৃষ্টি।
- (৬) চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর প্রথম ইংরেজি বই “Our Films their Films” বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে এক মূল্যবান সংযোজন। এতে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে তাঁর সহজাত রসবোধ, অনদিকে গভীর পাণ্ডিত্য। তাঁর আত্মজীবনী “যখন ছোট ছিলাম” খুবই উপভোগ্য।
চিত্রশিল্পী সত্যজিত রায়
বিরাট প্রতিষ্ঠার অধিকারী এই মানুষটি চিত্রশিল্পী হিসাবেও ছিলেন অসাধারণ। নিজের বইয়ের সমস্ত ছবি নিজেই আঁকতেন। এছাড়া বহু বিখ্যাত বইয়ের প্রচ্ছেদ তাঁরই আঁকা। অসামান্য কীর্তির জন্য অসংখ্য পুরুস্কার পেয়েছেন সত্যজিৎ।
সত্যজিত রায়ের অর্জিত পুরস্কার
- (১) পথের পাঁচালী দিয়ে ১৯৫৬ সালে পান প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর তার পরিসমাপ্তি ঘটে ৩০শে মার্চ ১৯৯২ অস্কার পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে। এর মাঝে তিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন।
- (২) শ্রেষ্ঠ পরিচালনা, শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য পুরস্কারের কথা বাদ দিলেও নানান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন ‘ডি লিট’ উপাধি। তার মধ্যে আছে অক্সফোর্ড, দিল্লী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালর। শান্তিনিকেতন থেকে পেয়েছেন দেশিকোত্তম। ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরুস্কার।
- (৩) ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতের কলকাতায় এসে সত্যজিৎকে দিলেন সেদেশের সর্বোচ্চ সম্মান “লিজিয়ন অফ অনার”। এ এক দুর্লভ সম্মান।
- (৪) ফরাসী প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, “ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে সত্যজিৎ রায় এক অবিশ্বরণীর ব্যক্তিত্ব। চলচ্চিত্র জগতে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাঁর মতো এক মহান ব্যক্তিকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে পেরে আমি ও আমার দেশবাসী আজ কৃতজ্ঞ বোধ করছি।
- (৫) জীবনের অন্তিম পর্বে এল হলিউডের সর্বোচ্চ সম্মান অস্কার। যা পৃথিবীর সব চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে চির আকাঙ্ক্ষিত বন্ধু। তাঁকে এই পুরস্কার দেবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিখ্যাত ৭০ জন মানুষ। এঁদের মধ্যে ছিলেন স্পিলবার্গ, কপোলো, নিউম্যান, জর্জ লুকাস, আকিরা কুরোসাওয়া।
- (৬) সত্যজিতের সমগ্র সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করে তাঁকে দেওয়া হয় সাম্মানিক অস্কার। তাঁর আগে মাত্র পাঁচজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়-গ্রেটা গার্বো (১৯৫৫), ক্যারি গ্রান্ট (১৯৬৯), চার্লি চ্যাপলিন (১৯৭২), জেমস স্টুয়ার্ট (১৯৮৪), কুরোসাওয়া (১৯৮৯)।
চলচিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু
অস্কার পুরস্কার পাওয়ার মাত্র তেইশ দিন পর ২৩শে এপ্রিল ১৯৯২ সালে এই পার্থিব জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন সত্যজিৎ রায়।
উপসংহার :- যখন অস্কার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হল, সত্যজিৎ তখন অসুস্থ। বিছানায় শয্যাশায়ী। তিনি বলেছিলেন, “অস্কার পাওয়ার পর আমার পাওয়ার আর কিছুই রইল না”। জীবনের সব পাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল।
(FAQ) চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
সুকুমার রায়।
পথের পাঁচালী।
১৯৯২ সালে।