প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ

প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ প্রসঙ্গে রোমের পেপানধর্ম, রোমের পেগান ধর্মের বৈশিষ্ট্য, রোমে বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্ভব, রোমের বিভিন্ন দেবদেবী, রোমের বিভিন্ন দেবদেবীর পরিচিতি, প্রাচীন রোমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রোমে বহুত্ববাদের অবক্ষয় সম্পর্কে জানবো।

রোমে বহুত্ববাদ প্রসঙ্গে প্রাচীন রোমের পেপানধর্ম, প্রাচীন রোমের বিভিন্ন দেবদেবী, প্রাচীন রোমের বিভিন্ন দেবদেবীর পরিচিতি, রোমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদের অবক্ষয় সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ
পরিচিতিপেগান ধর্ম
গৃহদেবতাভেস্তা
সংগীত ও জ্ঞানের দেবতাঅ্যাপোলো
শস্যের দেবীকেরেস
স্বর্গের দেবতাজুপিটার
স্বর্গের রানীইউনো
যুদ্ধের দেবতামার্স
প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ

ভূমিকা :- প্রাচীন গ্রিস-এর মতো প্রাচীন রোম-এও খ্রিস্টের জন্মের পূর্ব থেকেই বহুত্ববাদী ধর্মের বা বহু দেবতার পূজার প্রচলন ছিল।

রোমের পেপানধর্ম

রোমানদের বহুত্ববাদী ধর্ম সাধারণভাবে ‘পেগান’ (Pagan) ধর্ম নামে পরিচিত। Pagan শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে লাতিন শব্দ Paganus থেকে যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘ বা ‘গ্রাম্য’ এবং “of the country” বা ‘দেশীয়’। প্রাচীন ইউরোপ-এ খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের পূর্বে সেখানে যে রোমান বহুত্ববাদী ধর্মচর্চার প্রচলন ছিল তাকেই সাধারণভাবে পেগানধর্ম বলা হয়।

রোমের পেগান ধর্মের বৈশিষ্ট্য

সার্বিকভাবে রোমের পেগানধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল –

  • (১) এই ধর্মে ধর্মান্তরণ প্রক্রিয়া (Proselytism) প্রচলিত ছিল না। অর্থাৎ পেগানরা অন্য ধর্মের মানুষদের উপর নিজেদের ধর্মমত চাপিয়ে দিত না।
  • (২) রোমের পেগানধর্মে সেখানকার জাতীয় দেবদেবীর সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় দেবতার উপাসনাও প্রচলিত ছিল।
  • (৩) রোম যে সমস্ত নতুন ভূখণ্ড দখল করেছিল সেখানকার মানুষের পূজিত দেবদেবীও রোমান ধর্মে প্রবেশ করেছিল। ফলে তাদের ধর্মে নিত্যনতুন দেবতার উদ্ভব ঘটত।

রোমে বিভিন্ন দেবতার উদ্ভব

সুপ্রাচীন গ্রিক সভ্যতার উত্তরসূরি হিসেবে রোমান সভ্যতার উত্থান ঘটে। প্রাচীন গ্রিসের ভূখণ্ড পরবর্তীকালে রোমানদের দখলে চলে গেলে গ্রিসের সভ্যতা-সংস্কৃতিও রোমান সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। –

  • (১) তাই রোমানদের ধর্ম-ভাবনাতেও পূর্বতন গ্রিক ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গ্রিসের মতোই রোমান ধর্মে বহুত্ববাদের অর্থাৎ বহু দেবতার উপাসনার প্রচলন ছিল।
  • (২) সাম্রাজ্যবাদী রোম পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র দখল করে এক সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাই রোমের নিজস্ব বহু দেবতাদের সঙ্গে রোমান সম্রাটদের দ্বারা বিজিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দেবদেবীও রোমানদের ধর্মচর্চায় যুক্ত হয়ে পড়ে।

রোমের বিভিন্ন দেবদেবী

রোমানদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। প্রাচীন রোমানদের মতে স্বর্গ এবং মর্ত্যের পৃথক পৃথক দেবতা অস্তিত্বশীল ছিল। তাদের ধর্মে বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন বিষয়ের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন। রোমান ধর্মে উল্লেখযোগ্য দেবতারা ছিলেন – ভেস্তা, অ্যাপোলো, কেরেস, ডায়ানা, জুপিটার, ইউনো, মার্স, মারকিউরি, মিনার্ভা, ভেনাস, ভলকান, ডিভাস অগাস্টাস, ডিভাস জুলিয়াস, ফরচুনা, প্লুটো, লেরিস, ক্যুইরিনাস, সল প্রমুখ।

রোমের বিভিন্ন দেবদেবীর পরিচিতি

রোমের বিভিন্ন দেবদেবীদের সাধারণ পরিচিতি নিচে উল্লেখ করা হলো। –

(১) ভেস্তা

রোমের প্রতিটি পরিবারেই একটি উপাসনালয় থাকত যেখানে গৃহদেবতার পুজো করা হত। পরিবারের গৃহদেবতার নাম ছিল ‘ভেস্তা’।

(২) অ্যাপোলো

দেবতা জিউসের পুত্র অ্যাপোলো ছিলেন সংগীত ও জ্ঞানের দেবতা। তিনি রোগ নিরাময়কারী এবং ভবিষ্যৎ বক্তা হিসেবেও পরিগণিত হতেন।

(৩) কেরেস

জুপিটারের কন্যা কেরেস ছিলেন রোমানদের শস্যের দেবী।

(৪) ডায়ানা

দেবী ডায়ানা ছিলেন রোমান পুরাণে উল্লিখিত শিকারের দেবী।

(৫) জুপিটার

রোমানদের স্বর্গের দেবতা ছিলেন জুপিটার। তিনি ছিলেন রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা।

(৬) ইউনো

জুপিটারের স্ত্রী ইউনো ছিলেন রোমের প্রভাবশালী দেবী এবং স্বর্গের রানি।

(৭) মার্স

জুপিটার ও ইউনোর পুত্র মার্স প্রথমদিকে উর্বরতার দেবতা হিসেবে গণ্য হলেও পরবর্তীকালে তিনি যুদ্ধের দেবতা হিসেবে পরিচিত হন।

(৮) মারকিউরি

রোমান বাণিজ্য দেবতা ও দৈব বার্তাবাহক ছিলেন জুপিটারের পুত্র মারকিউরি।

(৯) মিনার্ভা

রোমানদের জ্ঞান ও চারুশিল্পের দেবী ছিলেন মিনার্ভা।

(১০) ভেনাস

প্রাচীন রোমের প্রেম, সৌন্দর্য ও বসন্ত ঋতুর দেবী ছিলেন ভেনাস।

(১১) ভলকান

রোমান পুরাণে উল্লিখিত জুপিটারের পুত্র ভলকান ছিলেন আগুন, আগ্নেয়গিরি ও অস্ত্র নির্মাণের দেবতা।

(১২) অগাস্টাস

রোমান সম্রাট অগাস্টাস মৃত্যুর পরবর্তীকালে রোমানদের কাছে দেবতার আসন লাভ করেন।

(১৩) জুলিয়াস সিজার

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারও মৃত্যুর পর রোমানদের দেবতা হিসেবে পুজিত হন।

(১৪) ফরচুনা

রোমান পুরাণে উল্লিখিত সৌভাগ্যের দেবী ছিলেন ফরচুনা।

(১৫) প্লুটো

রোমানদের মৃত্যুর দেবতা ছিলেন প্লুটো।

(১৬) অন্যান্য দেবদেবী

লেরিস, কাইরিনাস, সল প্রমুখও ছিলেন উল্লেখযোগ্য রোমান দেবদেবী। এ ছাড়াও বিভিন্ন পশুপাখি, বৃক্ষ ও প্রকৃতির উপাসনা প্রচলিত ছিল। তারা নববিজিত স্থানের ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎখাত না করে, সেখানকার সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছিল। ফলে রোমের ধর্মীয় জীবনে নতুন নতুন দেবদেবীর প্রবেশ ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দেবী সিবিলি, আইসিস, এপোনা এবং দেবতা মিথরাস, সোল ইনভিকটাস প্রমুখ।

প্রাচীন রোমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান

  • (১) রোমানরা নিজেদের ধর্মচর্চাকে খুবই উন্নত বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত যে, তাদের প্রতি ঈশ্বর সদয় আছেন বলেই তারা এই সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছে। রোমানরা ধর্মীয় গুরুত্ব অনুসারে তাদের বার্ষিক ক্যালেন্ডার তৈরি করত।
  • (২) রোমের সাম্রাজ্যবাদের যুগে বছরে অন্তত ১৩৫টি দিন বিভিন্ন দেবতার সম্মানে ধর্মীয় উৎসব ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকত। পুরুষ, নারী, শিশু, ক্রীতদাস- সকলেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করত।
  • (৩) বিভিন্ন দেবতার পূজার উদ্দেশ্যে রোমানরা দেবতাদের মূর্তি নির্মাণ করত এবং উপাসনালয় বা মন্দির তৈরি করত। প্রতিটি পরিবারেই নিজস্ব উপাসনাগৃহ থাকত। তা ছাড়া ছিল বিভিন্ন প্রতিবেশী অঞ্চলের উপাসনালয়।

রোমে বহুত্ববাদের অবক্ষয়

প্রাচীন রোমে বিভিন্ন কারণে বহুত্ববাদের অবক্ষয় ঘটে। যেমন –

(১) খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক বাধা

জিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর পর থেকে রোম তথা ইউরোপে একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্ম প্রসার লাভ করতে থাকে। কিন্তু প্রথমদিকে একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ওপর রোমের বহুত্ববাদী পেগানধর্মের আক্রমণ নেমে আসে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়।

(২) খ্রিস্টধর্মের অগ্রগতি

অবশেষে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন আনুমানিক ৩১২ (মতান্তরে ৩১৩) খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, ফলে খ্রিস্টানদের ওপর উৎপীড়ন বন্ধ হয়। সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস ৩১১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের বৈধধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ফলে সমগ্র ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের পথ প্রশস্ত হয়।

(৩) বহুত্ববাদের অবক্ষয়ের সূচনা

একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে মাত্র ২০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রাচীন রোমের বহুত্ববাদী পেগানধর্মের অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়।

(৪) বর্তমান কালে বহুত্ববাদের অস্তিত্ব

কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউরোপ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও বহুত্ববাদী ধর্মের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টান, জুড (ইহুদিদের ধর্ম) ও মুসলিম ধর্মের একেশ্বরবাদী ধারণার কথা বাদ দিলে দেখা যায় যে, আজও বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মই হল বহুত্ববাদী ধর্ম।

উপসংহার :- বর্তমান হিন্দুধর্ম, মহাযান বৌদ্ধধর্ম, কনফুসীয়ধর্ম, শিন্টোধর্ম এমনকি আফ্রিকা বা আমেরিকার উপজাতিদের ধর্মেও বহু দেবতার আরাধনা করা হয়।

(FAQ) প্রাচীন রোমে বহুত্ববাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রোমের বহুত্ববাদী ধর্ম কি নামে পরিচিত?

পেগান ধর্ম।

২. রোমের প্রতিটি পরিবারের গৃহদেবতার নাম কি ছিল?

ভেস্তা।

৩. রোমের সঙ্গীত ও জ্ঞানের দেবতা কে ছিলেন?

অ্যাপোলো।

৪. রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্বর্গের দেবতা কে ছিলেন?

জুপিটার।

৫. রোমের স্বর্গের রানী কে ছিলেন?

ইউনো।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment