ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বিপ্লবের সন্তান না বিনাশক সেই প্রসঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ, বিপ্লবের সন্তান নেপোলিয়ন হিসেবে ফরাসি বিপ্লব, গণসার্বভৌমত্ব, সাম্য নীতির স্থায়িত্ব, বিপ্লবী শক্তিবর্গের নীতি বজায় রাখা, যোগ্যতার স্বীকৃতি, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, বৈদেশিক নীতি বিপ্লবের নির্বাহক ও উত্তরাধিকারী, বিপ্লবের বিনাশক নেপোলিয়ন হিসেবে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ, স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন, আইনসভা নির্বাচন, ফরাসি বিপ্লবের সমাধি, পোপের সাথে চুক্তি, শিক্ষা নীতি, সর্বসাধারণের ভোটাধিকার হরণ, সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি ও বিপ্লব ধ্বংস সম্পর্কে জানবো।
নেপোলিয়ন বিপ্লবের সন্তান না বিনাশক
বিষয় | নেপোলিয়ন বিপ্লবের সন্তান না বিনাশক |
বিপ্লবের সন্তান | নেপোলিয়ন |
জন্ম | ১৫ আগস্ট, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ |
রাজ্যাভিষেক | ২ ডিসেম্বর, ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ |
মৃত্যু | ৫ মে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ |
ফরাসি বিপ্লব-এর আদর্শ | সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা |
ভূমিকা:- সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত নেপোলিয়ন একটি আত্মজীবনীমূলক রচনায় দুটি পরস্পর-বিরোধী উক্তি করেন। এক জায়গায় তিনি নিজেকে ‘বিপ্লবের সন্তান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখছেন যে, ‘আমিই বিপ্লব’। এই বইয়ের অন্যত্র আবার তিনি নিজেকে ‘বিপ্লবের ধ্বংসকারী’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখছেন যে, ‘আমিই বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি’।
ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ
আপাত দৃষ্টিতে এই দুটি উক্তি পরস্পর-বিরোধী বলে মনে হলেও এর মধ্যে যথেষ্ট সত্যতা আছে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, ফরাসি বিপ্লব -এর তিনটি মূল আদর্শ ছিল—‘স্বাধীনতা’, ‘সাম্য’ ও ‘মৈত্রী’। তিনি সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শকে গ্রহণ করলেও ‘স্বাধীনতা’-র আদর্শকে গ্রহণ করেন নি।
বিপ্লবের সন্তান নেপোলিয়ন
ফ্রেডরিক ম্যাসন, সোরেল, জর্জ লেফেভর, ফিশার প্রমুখের মতে নেপোলিয়ন ছিলেন ‘বিপ্লবের সন্তান’—বিপ্লবের মূর্ত প্রতীক, বিপ্লবের ধারক ও বাহক। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য গুলি হল –
(১) ফরাসি বিপ্লব
রাজরক্তহীন এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ফ্রান্স-এর সম্রাট পদে বৃত হন। ফরাসি বিপ্লব ব্যতীত তাঁর এই উত্তরণ কখনোই সম্ভব হত না। এদিক থেকে সত্যই তিনি ছিলেন বিপ্লবের সন্তান।
(২) গণসার্বভৌমত্ব
তিনি ঈশ্বর প্রদত্ত রাজক্ষমতা তত্ত্বের উপর আঘাত হেনে ‘গণসার্বভৌমত্ব’ নীতির উপর তাঁর শাসনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর প্রবর্তিত গণভোট প্রথা গণসার্বভৌমত্ব নীতির প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
(৩) সাম্য নীতির স্থায়ীত্ব
তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্যের আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন যে, “ফরাসি জাতি স্বাধীনতা চায় না, চায় সাম্য।” তাঁর আমলে প্রবর্তিত বিভিন্ন আইন দ্বারা তিনি সাম্য নীতিকে স্থায়িত্ব দেন।
(৪) বিপ্লবী শাসকবর্গের নীতি গুলি বজায় রাখা
১৭৯১ থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফ্রান্সের বিপ্লবী শাসকবর্গ সামন্তপ্রথা, সামন্ত কর, স্থানীয় শুল্ক প্রভৃতি বিনাশ করেছিলেন। নেপোলিয়ন সেগুলি বজায় রাখেন। বিপ্লবী যুগের ভূমিব্যবস্থাকেও তিনি অপরিবর্তিত রাখেন।
(৫) যোগ্যতার স্বীকৃতি
বিপ্লবী আমলের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগের যে নিয়ম প্রবর্তিত হয়, তাকে তিনি স্বীকৃতি দেন।
(৬) সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা
‘কোড নেপোলিয়ন‘ দ্বারা তিনি আইনের চোখে সবার সমান অধিকার স্বীকার করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
(৭) ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ
তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বজায় রাখেন এবং পোপের সঙ্গে চুক্তি (Concordat) দ্বারা তিনি গির্জার সম্পত্তি জাতীয়করণের স্বীকৃতি দেন।
(৮) বৈদেশিক নীতি
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিপ্লবের ধারক ও বাহক — বিপ্লবের অগ্নিময় তরবারি’ (“Napoleon was the sword of Revolution.”)। তাঁর বিজয়ী সেনাদল ইতালি, জার্মানি এবং ইউরোপ-এর অন্যান্য স্থান যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই পুরাতনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়ে ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারা – যথা সামাজিক সাম্য, সামন্ততন্ত্র-এর অবসান, বিশেষ অধিকার লোপ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিপ্লবের উত্তরাধিকারী ও নির্বাহক
তাই ফিলিপ গুয়েদালা মন্তব্য করেন যে, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিপ্লবকে ব্যাহত না করে, বিপ্লবের বিস্তার সাধন করেছে। সুতরাং এদিক থেকে তাকে বিপ্লবের ‘উত্তরাধিকারী ও নির্বাহক” বললে অযৌক্তিক হয় না।
বিপ্লবের বিনাশক নেপোলিয়ন
জর্জ রুদে এবং অপরাপর কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ‘বিপ্লবের সস্তান’ ছিলেন না। টমসন ও গ্যারাট বলেন যে, নেপোলিয়ন বহুক্ষেত্রেই বিপ্লবের আদর্শ লঙ্ঘন করেন। এক্ষেত্রে যুক্তি গুলি হল –
(১) রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ
বিপ্লবের কালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সূত্র ধরেই নেপোলিয়ন কনসাল নিযুক্ত হন। কনসাল থেকে তিনি সম্রাট হন এবং বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ও রাজসভা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। রাজসভায় তিনি জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব-অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেন।
(২) স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন
ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তিনি সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। প্রথম কনসাল হিসেবে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা—অন্য দুই কনসাল ছিল তাঁর আজ্ঞাবাহী কর্মচারী মাত্র।
(৩) আইনসভার নির্বাচন
সর্বসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটে আইনসভার নির্বাচন রদ করা হয়। ফরাসি সিনেট তাঁর আজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত হয়।
(৪) ফরাসি বিপ্লবের সমাধি
তিনি প্রাদেশিক আইনসভাগুলির ক্ষমতা লোপ করেন। তিনি নিজে সরকারি কর্মীদের মনোনীত করতেন। এর ফলে তাঁর একনায়কত্ব বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক ওলার বলেন যে, নেপোলিয়নের কনসাল বা সম্রাট পদ লাভের সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের সমাধি রচিত হয়।
(৫) বিভিন্ন আদর্শ বিসর্জন
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, বাক্-স্বাধীনতা হরণ, বিনা বিচারে গ্রেপ্তার, ফরাসি উপনিবেশে ক্রীতদাস প্রথার পুনরুজ্জীবন এবং জেকোবিন দলের প্রজাতন্ত্র ও গণভোটের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তিনি বিপ্লবের বিনাশসাধনই করেন।
(৬) পোপের সাথে চুক্তি
তিনি পোপের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তাও ছিল বিপ্লব-বিরোধী। এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি ক্যাথলিক গির্জাকে অনেক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন।
(৭) শিক্ষানীতি
তাঁর শিক্ষানীতি ছিল বিপ্লবী ভাবধারার পরিপন্থী। তিনি জেকোবিনদের সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আদর্শ গ্রহণ করেন নি। তাঁর শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল একদল অনুগত নাগরিক তৈরি করা।
(৮) সর্বসাধারণের ভোটাধিকার হরণ
তিনি সর্বসাধারণের ভোটাধিকার দেন নি। তিনি দরিদ্রদের স্বার্থে ‘Law of Maximum’ এবং ‘Law of Minimum’ পুনঃপ্রবর্তন করেন নি।
(১০) সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি
ওলার বলেন যে, সামাজিক সাম্য অপেক্ষা তিনি সামাজিক বৈষম্যই সৃষ্টি করেন। তিনি বুর্জোয়া শ্রেণিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি ভোগ করার অধিকার দেন এবং একটি নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করেন।
(১১) বিপ্লব ধ্বংস
লেফেভর, গুডউইন, জোয়ারেস, মাঁতিয়ে প্রমুখের মতে, নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্রের ফলে বিপ্লব ধ্বংস হয়।
উপসংহার:- নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের মাধ্যমে ইউরোপে বিপ্লব সম্প্রসারিত হয় নি। তাঁর সাম্রাজ্য শোষণ ও স্বৈরতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এটি বিপ্লবের মৈত্রী বা Fraternity-র আদর্শের পরিপন্থী। এইসব কারণে নেপোলিয়নকে কখনোই ‘বিপ্লবের সন্তান’ বলা যায় না।
(FAQ) নেপোলিয়ন বিপ্লবের সন্তান না বিনাশক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে।
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা।