লক্ষ্মণ সেন

সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন প্রসঙ্গে ধর্মমত, গৌড়েশ্বর উপাধি, রাজ্য জয়, গাহড়বালদের পরাস্ত, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, কলচুরিদের সংঘাত, তুর্কি আক্রমণ, বখতিয়ার খলজির উপস্থিতি, ইতিহাসে ধিকৃত, জাতীয় সংহতি নষ্ট, জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন শাসন, প্রশংসা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন

রাজালক্ষ্মণ সেন
রাজত্ব১১৭৯-১২০৭ খ্রি:
বংশসেন বংশ
প্রতিষ্ঠাতাসামন্ত সেন
পূর্বসূরিবল্লাল সেন
সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন

ভূমিকা :- লক্ষ্মণ সেন তাঁর পিতার মৃত্যুর পর পরিণত বয়সে, অর্থাৎ প্রায় ৬০ বছর বয়সে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি সমগ্র বাংলায় তার আধিপত্যকে সম্পূর্ণ করে ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি নেন। তাছাড়া ক্ষমতা প্রকাশের জন্য তিনি ‘অরি-রাজ-মর্দন শঙ্কর’ নামে এক গালভরা উপাধি নেন।

লক্ষ্মণ সেনের ধর্মমত

তিনি নিজেকে ‘পরম বৈষ্ণব’ বলে ঘোষণা করতেন। লক্ষ্মণ সেনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শিবের উপাসক। লক্ষ্মণ সেন তাদের সম্পর্কে ‘পরম মহেশ্বর’ অভিধা নিলেও, তার নিজের ধর্মমতের পরিবর্তন তার ‘পরম বৈষ্ণব’ উপাধির মধ্যে পাওয়া যায়। তাছাড়া বৈষ্ণব কবি জয়দেব তার রাজসভায় ছিলেন।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের গৌড়েশ্বর উপাধি গ্রহণ

  • (১) তিনি “গৌড়েশ্বর” উপাধি নেন। ডঃ আব্দুল মোমিন চৌধুরীর মতে, গৌড় ও বঙ্গদেশ জয় করেন বিজয় সেন। সুতরাং লক্ষ্মণ সেনের গৌড়েশ্বর উপাধি ছিল বাহুল্য। তবে গৌড়দেশের রাজা হিসেবে তিনি যদি গৌড়েশ্বর উপাধি নেন তাহলে ডঃ চৌধুরীর আপত্তি গ্রহণীয় হয় না।
  • (২) কিন্তু লক্ষ্মণ সেন গৌড়দেশ জয় করার গৌরব দাবী করায় ডঃ চৌধুরী বলেছেন যে, বিজয় সেনের পর এমন কোনো কিছু ঘটেনি যার জন্য লক্ষ্মণ সেনকে পুনরায় গৌড়দেশ জয় করতে হয়। হয়ত তিনি বিজয় সেনের রাজত্বকালে গৌড় অভিযানে রত ছিলেন। সেই অর্থে গৌড়েশ্বর উপাধি নেন।

লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য জয়

বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনের কয়েকটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি গৌড়, কামরূপ রাজ্য, কলিঙ্গ ও কাশী জয় করেন। তিনি পুরী, বারাণসী ও এলাহাবাদে তাঁর বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করেন। ডঃ মজুমদারের মতে, তাঁর পিতামহের জীবিতকালে সম্ভবত লক্ষ্মণ সেন এই সকল স্থান জয় করেন। সম্ভবত তিনি সেনাপতি হিসেবে এই সকল জয় করেন।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের নিকট গাহড়বালদের পরাজয়

কনৌজ-এর গাহড়বাল শক্তি মগধ জয় করে বাংলা আক্রমণের চেষ্টা করে। মগধ বিজয় সেনের আমল থেকে সেন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন গাহড়বাল শক্তি মগধ আক্রমণ করলে লক্ষ্মণ সেন খুব সম্ভব গাহড়বালদের পরাস্ত করে এলাহাবাদ পর্যন্ত তার বিজয় বাহিনী চালনা করেন। জয়চন্দ্র গাহড়বালকে তিনি মগধ হতে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। গয়া জেলায় লক্ষ্মণ সেনের শিলালিপি একথা সমর্থন করে।

লক্ষ্মণ সেনের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা

গাহড়বাল শক্তির বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের অভিযান রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কাজ হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। এই সময় তুর্কী বিজেতারা দিল্লী দখল করে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার দিকে এবং পূর্ব ভারত-এর দিকে দ্রুত আগাচ্ছিল। চৌহানদের পতনের পর গাহড়বালরাই ছিল তুর্কী আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলার প্রধান রক্ষা-প্রাচীর। লক্ষ্মণ সেন গাহড়বাল শক্তিকে আক্রমণ করে দুর্বল করে ফেলায়, তুর্কীরা সহজে গাহড়বালদের পরাস্ত করে। তারপর তারা মগধ ও বাংলায় ঢুকে পড়ে।

কলচুরিদের সাথে লক্ষ্মণ সেনের সংঘাত

লক্ষ্মণ সেন কলচুরি রাজাদের সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হন। যদিও তিনি সকল প্রতিবেশী রাজ্য আক্রমণ করেন শেষ জীবনে তিনি একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। সুন্দরবনের সামন্ত রাজা ডোম্মন পাল স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে তুর্কী আক্রমণ

বাংলায় লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের সর্বপ্রধান ঘটনা ছিল তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযান। মিনহাজ উদ-দ্দিন সিরাজের তরকাৎ-ই-নাসিরী এবং ইসামীর রচনা ফুতুহ-উস-সালাতিন থেকে এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

লক্ষ্মণ সেনের আমলে বখতিয়ার খলজির উপস্থিতি

  • (১) ডঃ মজুমদারের মতে, বখতিয়ার খলজি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের পথ ধরে অতর্কিতে নবদ্বীপে এসে পড়েন। বখতিয়ার এত দ্রুত আসেন যে, তার মূল বাহিনী পিছনে আসলেও তিনি তাঁর ১৮ জন অনুচর সহ আগেই নদীয়া বা নবদ্বীপে পৌঁছে যান।
  • (২) ডঃ মজুমদারের মতে, নবদ্বীপ লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী ছিল না। এখানে আত্মরক্ষার জন্য কোনো দুর্গ ছিল না। জ্যোতিষীরা তুর্কীদের হাতে নদীয়ার পতন হবে এরকম ভবিষ্যদ্বানী দেওয়ায় অনেকেই নদীয়া ছেড়ে চলে যান। বয়োবৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন ভয় না পেয়ে নবদ্বীপে ছিলেন। ইতিমধ্যে বখতিয়ার খলজী চলে আসেন।
  • (৩) বখতিয়ার খলজি লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া বা নবদ্বীপে ঢুকে রাজপ্রসাদের দরজায় এসে গেলে, মধ্যাহ্ন ভোজনে রত লক্ষ্মণ সেন পিছনের দরজা দিয়ে নৌকায় চেপে পূর্ব বাংলায় সপরিবারে পালিয়ে যান। বিনা যুদ্ধে বক্তিয়ার খলজী গৌড় সহ পশ্চিম বাংলা অধিকার করেন।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যু

বখতিয়ার খলজির আক্রমণের পর লক্ষ্মণ সেন পূর্ব বাংলার বিক্রমপুর থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলা শাসন করতে থাকেন। সম্ভবত ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

ইতিহাসে ধিকৃত রাজা লক্ষ্মণ সেন

লক্ষ্মণ সেন তাঁর রাজ্য রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য ইতিহাসে ধিকৃত হয়েছেন। কিন্তু তুর্কী আক্রমণের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতের বহু রাজপুত রাজারাও ব্যর্থ হন। তবে লক্ষ্মণ সেন যেভাবে বিনা যুদ্ধে রাজ্য ছেড়ে যান তার তুলনা পাওয়া যায় না। লক্ষ্মণ সেনের ব্যর্থতা ছিল একটি system বা প্রথার ব্যর্থতা।

লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক জাতীয় সংহতি নষ্ট

বল্লাল সেনের আমল হতে সেন রাজারা যে ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ও সামাজিক ভেদনীতি নিয়ে চলেন তার ফলে বাংলার সামাজিক ঐক্য ও রাষ্ট্রিক চেতনা নষ্ট হয়। জাতিভেদ, কৌলিন্য প্রথা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা, একটি উচ্চ শ্রেণীর সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি বাংলার জাতীয় সংহতিকে ধ্বংস করে। লক্ষ্মণ সেনকে তার ফল ভুগতে হয়।

জনজীবন থেকে লক্ষ্মণ সেনের বিচ্ছিন্ন শাসন

তাঁর শাসনব্যবস্থা অনেকাংশে জনজীবন হতে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে ধারণা করা যায়। নতুবা তাঁর সমর্থনে এবং বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো অভ্যুত্থান না হওয়া বিস্ময়কর। বাংলার সামন্ত রাজারা ভাল লড়াকু ছিলেন। কেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন থাকেন তা জানা যায় নি।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের প্রশংসা

লক্ষ্মণ সেন তবকতের লেখক মিনহাজ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন। সুতরাং নদীয়ার পতনের জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা বোধ হয় ঠিক নয়।

সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক রাজা লক্ষ্মণ সেন

তিনি ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, কবি ও পণ্ডিত। তাঁর পিতার অসমাপ্ত গ্রন্থ অদ্ভূত সাগর তিনি সমাপ্ত করেন। তার রচিত শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে স্থান পেয়েছে। তাঁর রাজসভায় ছিলেন কান্তকোমল পদের স্রষ্টা কবি জয়দেব, যিনি গীতগোবিন্দের সুললিত পদাবলী রচনা করেন। পবনদূতের কবি ধোয়ী, হলায়ুধ, শ্রীধর দাস প্রমুখ পণ্ডিতেরা তাঁর রাজসভাকে অলঙ্কৃত করেন।

উপসংহার :- লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন কিছুকাল পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেন। তারাও ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি বহন করতেন।

(FAQ) সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেন কে?

লক্ষ্মণ সেন।

২. বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের সময় বাংলার রাজা কে ছিলেন?

লক্ষ্মণ সেন।

৩. পঞ্চরত্ন কার রাজসভা অলঙ্কৃত করে?

লক্ষ্মণ সেন।

৪. জয়দেব কার সভাকবি ছিলেন?

লক্ষ্মণ সেন।

Leave a Comment