জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার

একজন প্রখ্যাত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এবং “পরমাণু বোমার জনক” নামে পরিচিত জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার (১৯০৪-১৯৬৭)। তিনি ম্যানহাটন প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক পরিচালক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওপেনহাইমার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গবেষণাতেও অবদান রেখেছিলেন এবং পরবর্তীকালে পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে কাজ করেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, তিনি তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য মার্কিন সরকার দ্বারা বিতর্কিত হন। তার জীবন ও কর্ম বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং নৈতিকতার মেলবন্ধনের এক অসাধারণ উদাহরণ।

পরমাণু বিজ্ঞানী জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার

ঐতিহাসিক চরিত্রজেমস রবার্ট ওপেনহাইমার
জন্ম২২ এপ্রিল, ১৯০৪ খ্রি
দেশআমেরিকা
প্রধান ক্ষেত্রপদার্থবিজ্ঞান, পরমাণু বিজ্ঞান
বিখ্যাত কাজম্যানহাটন প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক পরিচালক
উল্লেখযোগ্য অবদানপ্রথম পরমাণু বোমা তৈরির নেতৃত্বদান
উপাধি“পরমাণু বোমার জনক”
পুরস্কার ও সম্মাননাএনরিকো ফার্মি পুরস্কার (১৯৬৩)
প্রভাবপারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন এবং পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার
মৃত্যু১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ খ্রি
জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার

ভূমিকা :- আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই। এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মরুভূমির জিরো হিল অঞ্চলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল মানব ইতিহাসের প্রথম পরমাণু বোমাটির। আর এই চমকপ্রদ কর্মকান্ডের প্রধান হোতা ছিলেন ডঃ জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার।

রবার্ট ওপেনহাইমারের জন্ম

জে. রবার্ট ওপেনহাইমারের জন্ম নিউইয়র্ক শহরে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ২২শে এপ্রিল এক ইহুদি পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। তাই ছেলেবেলা থেকে মানুষ হয়েছিলেন প্রাচুর্যের মধ্যে এবং যথাসময়েই তাঁর লেখাপড়া শেখারও উপযুক্ত ব্যবস্থা হয়েছিল।

বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু ওপেনহাইমার

অসাধারণ কৌতূহল আর পর্যবেক্ষণ প্রবণতা নিয়েই জন্মেছিলেন ওপেনহাইমার। যখনই যা কিছু তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করত, তার সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে জেনে তবে তিনি স্বস্তি পেতেন। এই ভাবে ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু সত্তার।

ওপেনহাইমারের ছেলেবেলার নেশা

যখন মাত্র সাত বছর বয়স, সেই সময়েই বিচিত্র আকার-আকৃতির পাথরের রীতিমত এক সংগ্রহশালা তিনি গড়ে ফেলেছিলেন পড়ার ঘরে। কেবল পাথর নিয়েই নয়, নানা ধরনের কীটপতঙ্গ খুঁজে বেডানোও তাঁর নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। জীবাণু পরীক্ষা করবার উদ্দেশ্যে একটি অনুবীক্ষণ যন্ত্র ওই বয়সেই কিনে ফেলেছিলেন তিনি।

রবার্ট ওপেনহাইমারের বহুমুখী প্রতিভা

কেবল বিজ্ঞানের বিষয়ই যে তাঁকে আকর্ষণ করত তাই নয়। শিল্পের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ কিছু কম ছিল না। ভাল আঁকতে ও গাইতে পারতেন তিনি। ভাষা শিক্ষার প্রতিও ছিল গভীর আগ্রহ। বলা চলে বহুমুখী প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন ওপেনহাইমার।

ওপেনহাইমারের শিক্ষা

বিচক্ষণ বাবা-মা ছেলের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে শহরের সবচেয়ে নামজাদা ও সেরা স্কুল এথিক্যাল কালচারে তাঁকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁর লেখা পড়ার পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। কাজেই দুটো দিকেই সমান মনোযোগ ছিল তাঁর। বছর বারো বয়সে বিজ্ঞানের একটি শাখা রসায়নের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। নতুন কিছু আবিষ্কারের ঝোঁক চাপল ঘাড়ে। রাতদিন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই ডুবে থাকেন।

রসায়নের পর্যবেক্ষক ওপেনহাইমার

ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাবা-মা তাঁর জন্য একটি ছোটখাট রসায়নাগারও তৈরি করে দিলেন। কেবল তাই নয়, রসায়নের নিয়ম প্রকরণ ভালভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য তাঁর জন্য উপযুক্ত শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। সেই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ও শিক্ষায় মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যেই রসায়নের একজন পাকা পর্যবেক্ষক হয়ে উঠলেন ওপেনহাইমার।

ওপেনহাইমারের বিশেষ আগ্রহ

পড়াশুনো, গবেষণা তার সঙ্গে ছবি আঁকা এবং সঙ্গীত শিক্ষার মধ্যে দিয়েই বড় হয়ে উঠতে লাগলেন ভবিষ্যতের পরমাণুবিজ্ঞানী। খেলাধুলোয় বিশেষ আগ্রহ তাঁর কোনো কালেই ছিল না। তাই বাড়ির বাইরে বড় একটা বেরুতেন না-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও মেলামেশার সুযোগ হত না। নিজের মনে পছন্দমতো কাজ নিয়ে একা থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

রবার্ট ওপেনহাইমারের ডিঙি ট্রাইমিথি

ছেলের এই অন্তর্মুখীনতা ভাল লাগত না বাবা-মায়ের। তাই ছেলেকে বাইরের জগতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বাবা তাঁকে একটা ডিঙ্গি নৌকো কিনে দিয়েছিলেন। সেই নৌকো চেপে নদীতে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর ওপেনহাইমার। বেরুতেন একা, কখনো সঙ্গে থাকতেন বাবা-মা। নিজের ডিঙি নৌকোর একটা নামও দিয়েছিলেন ওপেনহাইমার। সেই সময় তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন রাসায়নিক ট্রাইমিথিলিন ক্লোরাইড নিয়ে। তাই ওই রাসায়নিকের নামেই ডিঙিটির তিনি নামকরণ করেছিলেন ট্রাইমিথি। যথাসময়ে এথিক্যাল কালচার স্কুল থেকে শেষ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে স্নাতক হলেন ওপেনহাইমার।

ইউরোপ সফরে ওপেনহাইমার

প্রতিভাবান ছেলের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর বাবার। ছেলেকে নানা দেশের সঙ্গে পরিচিত করাতে এবারে তিনি তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপ সফরে। তাঁরা প্রথমে এলেন ইতালির রাজধানী রোম-এ। সেখান থেকে গেলেন গ্রিস-এ। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহান পুরোহিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, গ্যালিলিও, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ আবির্ভূত হয়েছিলেন এসকল দেশে। গ্রীস ইতালিকে তাই বলা হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে ওপেনহাইমার ঘুরে ঘুরে দেখেন দুই দেশের ঐশ্বর্য। এভাবে ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে এক সময়ে তাঁরা ফিরে এলেন নিউইয়র্কে।

নানান ভাষায় দক্ষ ওপেনহাইমার

বিভিন্ন দেশের ভাষা আগেই রপ্ত করেছিলেন ওপেনহাইমার। এবারে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষার শ্রেষ্ঠ বই পত্র সংগ্রহ করে তার মধ্যে ডুব দেন তিনি।

স্নাতক ওপেনহাইমার

সেই সময় মাত্র উনিশ বছর বয়েস ওপেনহাইমারের, নিজের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একদিন স্থির সিদ্ধান্ত নেন। উচ্চ শিক্ষা নেবার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের ক্লাসে ভর্তি হন। রসায়নের সঙ্গে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যাও শিখতে থাকেন। অসাধারণ মেধাবী ওপেনহাইমার ক্লাসের চার বছরের পাঠ তিন বছরেই সম্পূর্ণ করলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে স্নাতক হলেন।

ক্যাভেন্ডিসে ওপেনহাইমার

ইংল্যান্ড-এ ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরির খ্যাতি তখন তুঙ্গে। জগদ্বিখ্যাত রসায়ন-বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিসের নামে প্রতিষ্ঠিত এই ল্যাবটির তত্ত্বাবধান করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণার অত্যাধুনিক সব রকম সুযোগ সুবিধাই এখানে পাওয়া যায়। ওপেনহাইমার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাভেন্ডিসে গবেষণার সংকল্প নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে এলেন।

রাদারফোর্ডের সংস্পর্শে ওপেনহাইমার

এই সময় রসায়ন বিজ্ঞানের অন্যতম পুরোধাপুরুষ লর্ড রাদারফোর্ড ক্যাভেন্ডিসে কাজ করছেন। পরমাণু বিজ্ঞানে বিস্ময়কর আবিষ্কারের জন্য তাঁর খ্যাতি জগৎ জুড়ে। তিনি তখনও নিরলস গবেষণা করে চলেছেন পরমাণুর বিভিন্ন গঠনের রহস্য নিয়ে। গবেষণার সূত্রেই ওপেনহাইমার লর্ড রাদারফোর্ডের সংস্পর্শে এলেন। তাঁর কাছেই পরমাণু পদার্থবিদ্যার শিক্ষা নিলেন তিনি। নতুন এক জীবনের দরজা যেন খুলে গেল তাঁর সামনে।

ম্যাক্স বর্নের সংস্পর্শে ওপেনহাইমার

কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিসে আরও এক প্রতিভাধর পদার্থবিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ পেলেন ওপেনহাইমার। তিনি হলেন বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন। পরমাণু পদার্থবিদ্যায় গভীর আগ্রহের পরিচয় পেয়ে বার্ন ওপেনহাইমারকে পরামর্শ দিলেন জার্মানির গাটিনগেন শহরে যাওয়ার জন্য। সেই সময়ে এই শহরে গবেষণারত ছিলেন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদগণ। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার সাহায্যে তাঁরা নতুন নতুন আবিষ্কার করে সমৃদ্ধ করে চলেছেন বিশ্ববিজ্ঞানকে।

ওপেনহাইমারের পি. এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ

নতুন পরিবেশে এসে গবেষণার কাজে যুক্ত হলেন ওপেনহাইমার। এখানেই তিনি জার্মানির কয়েকজন শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদের সংস্পর্শে আসেন। গবেষণায় তাঁর আগ্রহ ও নিষ্ঠা চমৎকৃত করে সকলকে। গাটিনগেনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কাজ করলেও ওপেনহাইমারের যোগাযোগ বেশি ছিল অধ্যাপক বার্নের সঙ্গে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপরে তত্ত্বীয় গবেষণা করে দুজনে মিলে সম্পূর্ণ করলেন এক গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রে তাঁরা অণুর ওপরে শক্তির প্রতিক্রিয়াকে যথাযথ ব্যাখ্যা করলেন। এই গবেষণাপত্রের সুবাদেই পি. এইচ. ডি ডিগ্রি পেলেন ওপেনহাইমার।

আন্তর্জাতিক মহলে রবার্ট ওপেনহাইমারের পরিচিতি

এর পরে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপরে আরও কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি চলে এলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে। কিছুদিন এখানে কাজ করার পর এলেন নেদারল্যান্ড বা হল্যান্ডের লিডেন শহরে। এই ভাবে কেটে গেল দুটি বছর। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ওপেনহাইমার ফিরে এলেন স্বদেশে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখন তাঁর সারা মন জুড়ে বসেছে। কাজের সূত্রে ইতিমধ্যেই তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি লাভ করেছে তাঁর নাম। এবারে নতুন কাজে হাত দেন ওপেনহাইমার।

পরমাণু শক্তির কাজে ওপেনহাইমার

সেই সময় ইউরোপ ও আমেরিকার তাবড় বিজ্ঞানীরা পরমাণু বিদারণের বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা উদ্ভাবনের চেষ্টায় কাজ করে চলেছেন। তরুণ ওপেনহাইমারও এই কাজে হাত লাগালেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিদীর্ণ পরমাণু থেকে উদ্ভূত শক্তি দিয়ে মানব সভ্যতার প্রভূত উন্নতি সম্ভব হবে।

অধ্যাপক ওপেনহাইমার

কিছুদিনের মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে গেলেন ওপেনহাইমার। পাশাপাশি আরও একটি কাজ নিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া ইনসটিটিউট অব টেকনলজিতে অধ্যাপনা। এভাবে জীবনের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। সফল অধ্যাপক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই সুখ্যাতি অর্জন করেন ওপেনহাইমার। গবেষণার সূত্রে ইতিমধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ফলে তত্ত্বীয় পদার্থ বিদ্যায় শিক্ষালাভের জন্য দেশবিদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে লাগল তাঁর ক্লাসে।

ওপেনহাইমারের বিবাহ

এরপর বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করলেন। সুন্দরী পত্নীকে নিয়ে, গান আনন্দ, নৌকাবিহার, কখনো ছবি আঁকা, এসবের মধ্য দিয়ে তর-তর করে বয়ে চলতে থাকে জীবন- তরীখানি।

রবার্ট ওপেনহাইমারের ব্যাখ্যা থেকে নতুন আলোর সন্ধান

পদার্থবিদ্যার তত্ত্বীয় গবেষণাগুলির মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার সম্ভব করতে না পারলেও ওপেনহাইমারের ব্যাখ্যা থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা যে নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সময়ে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন পদার্থবিদ কার্লভি অ্যান্ডারসন এবং পদার্থবিদ ডির‍্যাক কাজ করছিলেন পরমাণুর গঠন ও তার ভেতরের বিভিন্ন উপ-কণা নিয়ে। এই দুই বিজ্ঞানীকে তাঁদের গবেষণার উৎসটির সন্ধান জানিয়েছিল ওপেনহাইমারের গবেষণা। পরবর্তীকালে কার্লভি এন্ডারসন এবং ডির‍্যাক উভয়েই নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।

ওপেনহাইমার-ফিলিপস এফেক্ট

মেলবা ফিলিপস নামে এক পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করে সম্মিলিত ভাবে একটি গবেষণায় তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার এক নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন ওপেনহাইমার। তাঁদের এই তত্ত্ব পরবর্তীকালে ওপেনহাইমার-ফিলিপস এফেক্ট নামে পরিচিত হয়।

পরমাণু প্রকল্পের দায়িত্বে ওপেনহাইমার

  • (১) ইতিমধ্যে ইউরোপের রাজনীতিক্ষেত্রে ঝড় তুলেছেন জার্মানীর নাৎসি নেতা এডলফ হিটলার। গোটা পৃথিবীকে নিজের অধিকারে আনার স্বপ্নে মশগুল হয়ে তিনি গঠন করেছেন দূর্ধর্ষ নাৎসি বাহিনী। এই বাহিনীর পদভরে কেঁপে উঠেছে সমগ্র ইউরোপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়েছে বিশ্বের আকাশ।
  • (২) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ৭ই ডিসেম্বর জাপান ঝাঁপিয়ে পড়ল মার্কিন নৌবাহিনীর বন্দরদুর্গ পার্ল হারবারে। এই আকস্মিক আক্রমণে স্বভাবতঃই বিভ্রান্ত দিশাহারা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় প্রেসিডেন্টের আসনে সমাসীন রুজভেল্ট। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন তাঁর সামনে। এই সঙ্কটাপন্ন সময়ে মার্কিন বিজ্ঞানী মহল প্রেসিডেন্টকে ভবিষ্যতের এক সর্বনাশা সম্ভাবনার কথা জানালেন।
  • (৩) পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা আইনস্টাইন তখন আমেরিকায়। তিনিও রয়েছেন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। এক বৈঠকে মিলিত হয়ে তাঁরা জানালেন, জার্মান ও ইতালির পদার্থ বিজ্ঞানীরা এক ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী পরমাণু বোমা প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন। তাঁদের চেষ্টা সফল হলে গোটা বিশ্বের বুকে ত্রাস সৃষ্টি হবে।
  • (৪) এই ঘটনার পরে রুজভেল্টের তৎপরতায় অবিলম্বে দেশের দুদে বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত হল পরমাণু বোমা তৈরির পরিকল্পনা। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্টের আহ্বানে এই প্রকল্পের পরিচালন দায়িত্ব গ্রহণ করতে হল পদার্থ বিজ্ঞান ও পরমাণুগবেষণার কুশলী বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারকে।

ইলেকট্রন কণার আবিষ্কার

এরই মধ্যে আধুনিক পরমাণু বিজ্ঞানের চর্চায় বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞানীরা একের পর এক রহস্য উন্মোচন করে এক মহাশক্তির সম্ভাবনার ইশারা লাভ করেছেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে জে. জে. টমসন নামে এক ইংরাজ পদার্থ বিজ্ঞানীর গবেষণায় জানা গেছে, পদার্থের সূক্ষ্মতম কণা পরমাণুকে ভেঙ্গে পাওয়া যায় এক ধরনের অতিসূক্ষ্ম ঋণাত্মক বিদ্যুৎ আধানবাহী কণা। এই কণার নাম ইলেকট্রন।

পরমাণুর ভেতরের শক্তি রহস্য উন্মোচন

বিজ্ঞানী টমসনের এই আবিষ্কারের পর থেকেই পরমাণুর রহস্য অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের পদার্থ বিজ্ঞানীরা। ডেন পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বোর ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পরমাণু নিয়ে গবেষণাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর গবেষণায় ধরা পড়ে পরমাণুর ভেতরের শক্তি রহস্য। সেখানে ধনাত্মক বিদ্যুৎ আধানযুক্ত পরমাণুর নিউক্লিয়াস ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন শক্তিস্তরে বিভিন্ন সংখ্যার ইলেকট্রন।

রাদারফোর্ডের গবেষণা

বোরের আবিষ্কারের সূত্র ধরে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তুলে ধরেছেন পরমাণুর ক্ষমতার এক অজানা রহস্য। তিনি দেখিয়ে দিলেন, পরমাণুর ভেতরের যে ধনাত্মক বিদ্যুৎ আধানযুক্ত নিউক্লিয়াস রয়েছে, তা আসলে ঋণ বিদ্যুৎকণা প্রোটন ও প্রশম কণা নিউট্রনের আবাসস্থল। কোনও এক পরমাণুর নিউক্লিয়াসে এই কণারা থাকে নির্দিষ্ট সংখ্যায় এবং প্রচন্ড এক বলের আকর্ষণ এই কণাগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে। প্রচণ্ড শক্তি কবলিত নিউক্লিয়াসের কণাগুলোকে যদি পৃথক করা সম্ভব হয় তবে উৎপন্ন হবে অপ্রতিরোধ্য ভয়ঙ্কর শক্তি।

এনরিকো ফের্মির গবেষণা

ইতালিয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পরমাণু সম্পর্কে গবেষণাকে তিনি এগিয়ে দেন আরও এক ধাপ। পূর্বেই জানা গিয়েছিল, যে কোনও প্রাকৃতিক মৌলের মধ্যে সবচেয়ে হালকা মৌল হল হাইড্রোজেন। আর সব চেয়ে ভারী মৌলটি ইউরেনিয়াম। এই মৌলগুলোর পারমাণবিক ওজনও জানতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ফের্মির পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, ইউরেনিয়াম মৌলের ওপরে দ্রুতগতিসম্পন্ন এক ঝাঁক নিউট্রন ফেলতে না ফেলতেই দুয়ে মিলে এক নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়। ফের্মি অবশ্য এই নতুন মৌলটির সঠিক পরিচয় ধরতে পারলেন না। ফেমির গবেষণার ফল বিশ্বের পরমাণু বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করে তুলে। শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

নিউক্লিয়ার ফিশান

জার্মান বিজ্ঞানী লিজ মিনার ও অটো ফ্রিৎখ পরীক্ষা করে দেখালেন, ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভাঙ্গলে দুটি অপেক্ষাকৃত হাল্কা তেজস্ক্রিয় সমস্থানিকের উদ্ভব হয়। এদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই ইউরেনিয়ামের ভেতর থেকে নির্গত হতে থাকে অপরিমেয় শক্তি-স্রোত। বিজ্ঞানীরা শক্তি উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ার নাম দিলেন নিউক্লিয়ার ফিশান বা পারমাণবিক বিস্ফোরণ।

বিশ্বখ্যাত পরমাণুবোমা তৈরির কাজে ওপেনহাইমার

  • (১) পরমাণুবোমা তৈরির কাজে বাইরের জগতে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ধ্বংস ক্ষমতা যে কত ব্যাপক সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যথেষ্টই সচেতন ছিলেন। তাই শত্রুপক্ষের প্রস্তুতির সংবাদ জানার পর রুজভেল্ট দেশের বিজ্ঞানীদের একত্রিত করে পরমাণুশক্তি আহরণের তোড়জোড় আরম্ভ করলেন। যাকে বলে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। পরমাণুবোমা তৈরির কাজটিও এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। তা সম্পন্ন করতে হবে শত্রুপক্ষ প্রস্তুত হবার আগেই।
  • (২) স্থান নির্বাচন হল লোকালয় থেকে বহু দূরে-নিউ মেক্সিকোর মরু অঞ্চলের এক শহর লস আলামাসে। সেখানে জড় হতে লাগল প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি। একে একে দেশের ও আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া ভিনদেশী প্রতিভাবান কুশলী বিজ্ঞানীরাও চলে এলেন অকুস্থলে। তাঁদের সকলের নেতৃত্বে রইলেন ওপেনহাইমার। তাঁর সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন বিজ্ঞানীরা। সামরিক নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ঘিরে রাখল এই সঙ্গুপ্ত স্থানটিকে। বাইরের কাকপক্ষীও যেন এই মহাশক্তি-মন্থন-সংবাদ জানতে না পারে।
  • (৩) পরমাণু বোমা তৈরির এই মার্কিন প্রকল্পে দেশীয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জার্মানত্যাগী বিজ্ঞানী মিনার ও অটো ফ্রিৎখ। ইতালিত্যাগী বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি, ডেন বিজ্ঞানী নীলস বোর এবং হাঙ্গেরীত্যাগী বিজ্ঞানী জিলার্ড ও টেলার। সমবেত বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন ওপেনহাইমার।
  • (৪) কর্মব্যস্ততার চূড়ান্ত অবস্থা তাঁর। দিনরাত ঘুরে কাজ দেখছেন, সমস্যা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সুস্থির হয়ে দু’দণ্ড বসবার উপায় নেই। কাজের মধ্যেই সামান্য স্যান্ডউইচ খেয়ে দিন কাটে। তিনচার ঘণ্টার হাল্কা ঘুমের সময়টুকুও সবসময় পাওয়া যায় না।
  • (৫) এই বিপুল কর্মযজ্ঞের বিপুল খরচখরচা জোগাচ্ছে মার্কিন সরকার। তাই প্রয়োজনীয় সবকিছুই সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে হাতের কাছে। ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়, আমেরিকার এই পরমাণু বোমা পরিকল্পনায় সর্বমোট ব্যয় হয়েছিল ২০০০,০০০,০০০,০০০-দুই বিলিয়ন ডলার। কাজ করেছিলেন পঁচাত্তর হাজারেরও বেশি কুশলী কর্মী-বিজ্ঞানী।
  • (৬) তেনেশি শহরের ওয়াকরিজ পর্বতের শিখরে তৈরি হতে লাগল পরমাণু বোমা তৈরির প্রধান উপকরণ ইউরেনিয়াম। এই মৌলের কণার আঘাতেই ঘটবে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন ছয় পাউণ্ডের ইউরেনিয়াম-২৩৫। কাজের মাঝখানেই বিজ্ঞানীরা পেয়ে গেলেন ইউরেনিয়ামের চাইতেও কার্যকরী অন্য এক মৌল। দেখা গেল ইউরেনিয়াম থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাওয়া সম্ভব হচ্ছে এই নতুন কৃত্রিম কণা।
  • (৭) বিজ্ঞানীরা এবারে উঠে পড়ে লাগলেন এই কৃত্রিম কণা সংগ্রহের কাজে। এই কাজের নেতৃত্ব দিলেন পরমাণু বিজ্ঞানের অন্যতম কৃতী বিজ্ঞানী গ্রেন থিওডোর সীবর্গ। তিনিই এই কৃত্রিম কণার নামকরণ করেছেন প্লুটোনিয়াম। মোট নটি কৃত্রিম কণার আবিষ্কর্তা এই বিজ্ঞানী। এইভাবে একসময় ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে ও কর্মকুশলতায় সর্বপ্রথম তৈরি হল বিশ্বের ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা। মানুষের হাতে পৃথিবী তার সম্ভাব্য ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেল এক ধাপ।

প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ

এই বোমার বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল অতি ভয়াবহ। বিস্ফোরণ স্থলে ছিল একটি একশো ফুট লম্বা টাওয়ার। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সেই টাওয়ার। তার নিচে যে বালির স্তূপ ছিল, প্রচন্ড উত্তাপে সেই বালি (সিলিকন) কাচে (সিলিকেট) রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিস্ফোরণের এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে জীবনের কোনো চিহ্ন ছিল না। নিউ মেক্সিকো থেকে চারশো পঞ্চাশ মাইল দূরের রাজ্য টেক্সাস থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া গিয়েছিল।

বিশ্ববিশ্রুত পরমাণু বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার

ওপেনহাইমার ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত পরমাণু বিজ্ঞানী। তিনি নিজেই বলেছিলেন, পরমাণু শক্তি কোনো দিনই হয়তো সঠিক ভাবে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। কেন না, এই অতুলনীয় শক্তিবলে বলীয়ান হয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ হয়ে উঠবে প্রভুত্বপরায়ণ। ক্ষমতার দম্ভ আর আস্ফালন তাকে করে তুলবে আগ্রাসী। মানবকল্যাণ পদে পদে হবে লাঞ্ছিত। বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার পরমাণু শক্তি সম্পর্কে শেষ কথা বলেছিলেন কিনা, সেই মীমাংসা এখনো হয় নি।

রবার্ট ওপেনহাইমারের উদ্বেগ

  • (১) মানব সমাজের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন ওপেনহাইমার। তাই দেখা গেল বোমার পরীক্ষামূলক বিদারণের পরে সম্পূর্ণ এক নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি। প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি মানুষটি যিনি বন্ধুদের সঙ্গে গানে আড্ডায় মেতে থাকতেন, রাতারাতি সেই মানুষটি হয়ে গেলেন এক বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি।
  • (২) জাপানের নাগাসাকি হিরোসিমায় আমেরিকার পরমাণু বোমার সর্বনাশা ছোবল সংখ্যাহীন মানুষের প্রাণহানি ঘটাল। বেদানার্ত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদ ওপেনহাইমারের বুকে আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগল। অশান্ত বিচলিত বিজ্ঞানী ছুটে গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে। ততদিনে রাষ্ট্রপতির পদে এসেছেন দুঁদে রাজনীতিক আইজেনহাওয়ার।
  • (৩) ওপেনহাইমার বললেন, পরমাণু বোমা তৈরির কলাকৌশল সরকারের হাতে এসেছে। কিন্তু তাকে ব্যবহারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কোনও মার্কিন নাগরিকের জানার অধিকার আছে। পরমাণু শক্তিকে এর পরে কিভাবে ব্যবহার করা হবে তা সরকারকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। কেননা এর যথেচ্ছ ব্যবহার বিশ্বের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।
  • (৪) বিবেচক আইজেনহাওয়ার বিজ্ঞানীর উদ্বেগের কারণ অনুধাবন করতে পারলেন। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার বিষয়টিও মাথায় রেখেই তিনি আশ্বস্ত করলেন ওপেনহাইমারকে। বিশ্বমানবতার প্রশ্নে আইজেনহাওয়ারের অধীন সরকার পরমাণু শক্তি সংগ্রহের বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট সংযত হলেন। বিবেক-দহনে ক্লিষ্ট ওপেনহাইমারের চেষ্টাতেই একসময় মানবকল্যাণের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণুশক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী হয়।

সুন্দরের সাধক ওপেনহাইমার

বিজ্ঞানসাধনার পুরোধাপুরুষ মানবতাবাদী ওপেনহাইমার ছিলেন সুন্দরের সাধক। মানুষের পৃথিবীকে আরও সুন্দর করার স্বপ্নেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন বিজ্ঞানসাধনায়। তাই বরাবর পৃথিবীর মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন পরমাণু মারণাস্ত্র সম্পর্কে-মানুষের হীন বুদ্ধি যেন প্রাস না করে জগতের মঙ্গল প্রচেষ্টাকে।

সম্মানিত ওপেনহাইমার

পরমাণু বোমার কুশলী শিল্পী-কারিগর ওপেনহাইমারকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সরকার সম্মানিত করে এনরিকো ফের্মি পুরস্কারে। রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি নিজে এই পুরস্কার তুলে দেন ওপেনহাইমারের হাতে।

ওপেনহাইমারের মৃত্যু

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন প্রিন্সটন শহরের ইনসটিটিউট ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডি সেন্টারের সর্বময় অধিকর্তা। তাঁর পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এই পদে বৃত হলেন ওপেনহাইমার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বহন করে গেছেন তিনি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।

উপসংহার :- জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার ছিলেন একজন প্রভাবশালী বিজ্ঞানী, যার কাজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তার নেতৃত্বে ম্যানহাটন প্রজেক্ট পরমাণু যুগের সূচনা করে, যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে এবং যুদ্ধনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। ওপেনহাইমারের কাজ বিজ্ঞানের অসাধারণ সাফল্য হলেও, এর নৈতিক ও মানবিক দিক নিয়ে তিনি গভীর আত্মমুল্যায়ন করেছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলেন। তার জীবন একটি জটিল সংমিশ্রণ, যেখানে বিজ্ঞান, রাজনীতি, এবং নৈতিকতার টানাপোড়েন ছিল প্রবল।

(FAQ) জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জেমস রবার্ট ওপেনহাইমার কে ছিলেন?

ওপেনহাইমার একজন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি ম্যানহাটন প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রথম পরমাণু বোমা তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি “পরমাণু বোমার জনক” নামে পরিচিত।

২. ম্যানহাটন প্রজেক্ট কী ছিল?

ম্যানহাটন প্রজেক্ট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন প্রকল্প, যার মাধ্যমে প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করা হয়েছিল। ওপেনহাইমার এই প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক পরিচালক ছিলেন।

৩. ওপেনহাইমারের রাজনৈতিক বিতর্ক কী ছিল?

ওপেনহাইমারের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে পূর্বেকার সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তাকে নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা একটি বিতর্কিত ঘটনা।

৪. ওপেনহাইমার কোন পুরস্কার পেয়েছিলেন?

ওপেনহাইমার ১৯৬৩ সালে এনরিকো ফার্মি পুরস্কার পান, যা তার বৈজ্ঞানিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হয়।

৫. ওপেনহাইমারের মৃত্যুর কারণ কী ছিল?

১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে থ্রোট ক্যান্সারের কারণে ওপেনহাইমার মৃত্যুবরণ করেন।

৬. ওপেনহাইমার পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কী মতামত পোষণ করতেন?

পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পর ওপেনহাইমার শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তি ব্যবহারের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছিলেন।

Leave a Comment