হবসন লেনিন থিসিস

হবসন লেনিন থিসিস প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের উদ্যোগ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে হাসনের ব্যাখ্যা, হবসনের ব্যাখায় উদবৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি, পুঁজিপতিদের চাপ, শোষণ, ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের উপায়, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে লেনিনের ব্যাখ্যা, লেনিনের ব্যাখ্যায় পুঁজির উদ্ভব, বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ, পুঁজি বিনিয়োগ, হবসন লেলিন থিসিসের সমালোচনা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

হবসন লেনিন থিসিস

ঐতিহাসিক বিষয়হবসন-লেনিন থিসিস
‘সাম্রাজ্যবাদ – একটি সমীক্ষা’জে এ হবসন
‘সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’লেনিন
বাড়তি মূলধনের চাপসাম্রাজ্যবাদ
পুঁজিবাদী অর্থনীতিযুদ্ধের জন্মদাতা
হবসন লেনিন থিসিস

ভূমিকা :- আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর বিভিন্ন দেশের ভূখণ্ড দখল না করেও সুকৌশলে সে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছে। ঔপনিবেশিক প্রসারের এই আধুনিক কৌশল নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদ নামে পরিচিত।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্যোগ

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের উদ্যোগ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সাম্রাজ্যবাদী উদ্যোগকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ’ ও ‘নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদ” এর প্রসারের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

‘হবসন-লেনিন থিসিস’

সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাদাতাদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য হলেন জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে তাঁদের এই অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ‘হবসন-লেনিন থিসিস’ নামে পরিচিত।

সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে হাসনের ব্যাখ্যা

উদারনৈতিক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এ. হবসন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ –একটি সমীক্ষা’ (Imperialism: A Study) গ্রন্থে বলেছেন যে, নয়া সাম্রাজ্যবাদের পেছনে কোনো মহৎ ও উচ্চতর লক্ষ্য বা আদর্শ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদের মূল শিকড় হল “উদবৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুসন্ধান। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ছিল পশ্চিম ইউরোপ -এর শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিকশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বাভাবিক পরিণতি। হবসনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি নিম্নরূপ –

(ক) হবসনের ব্যাখায় উদবৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি

  • (১) হবসন বলেছেন যে, ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকদের হাতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর মূলধন সঞ্চিত হয়। এই মূলধনের পাহাড়’ সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ ছিল সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য।
  • (২) ইউরোপের পুঁজিপতিরা পিছিয়ে পড়া এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে শিল্পের প্রসার ঘটাত এবং উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য অনুন্নত দেশগুলিতে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত।
  • (৩) এভাবে তাদের হাতে প্রচুর উদবৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি হয়। এই পুঁজি নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা আরও বেশি মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনা করতে থাকে।

(খ) হবসনের ব্যাখায় পুঁজিপতিদের চাপ

হবসন মনে করেন যে বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের উদবৃত্ত মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনা করে। এজন্য তারা নিজ নিজ দেশের সরকারকে চাপ দিয়ে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। এভাবে পুঁজিপতি শ্রেণি আরও মুনাফা অর্জন করে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে।

(গ) হবসনের ব্যাখায় শোষণ

  • (১) হবসন মনে করেন যে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পুঁজিপতি শ্রেণির অন্যতম লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা ও সম্পদ অর্জন। এই লোভে তারা সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রির বাজার দখল, উদবৃত্ত মূলধন লগ্নির জন্য ইউরোপের বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকায় নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নিজ দেশের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
  • (২) এরপর উপনিবেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উপনিবেশের বাজারে নিজেদের শিল্পজাত পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা আরও বাড়তি মুনাফা অর্জন করে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে।

(ঘ) হবসনের ব্যাখায় ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের উপায়

  • (১) হবসন মনে করেন যে, পুঁজিপতি শ্রেণির বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগের জন্য নতুন উপনিবেশ দখলের ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব। তিনি বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে।
  • (২) তিনি পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যে তা ব্যবহারের কথা বলেন। তাঁর মতে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে তারা কলকারখানায় উৎপাদিত উদবৃত্ত শিল্পসামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে উদবৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য আর উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন হবে না।

সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে লেনিনের ব্যাখ্যা

বিখ্যাত রুশ কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসারে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে হবসনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর (‘Imperialism : the Highest Stage of Capitalism) গ্রন্থে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। লেনিনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) লেনিনের ব্যাখ্যায় পুঁজির উদ্ভব

  • (১) লেনিন দেখিয়েছেন যে, শিল্পের অগ্রগতির ফলে ইউরোপের দেশগুলির মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চিত হয়। এই সঞ্চিত পুঁজি লাভজনকভাবে লগ্নি করা পুঁজিপতিদের কাছে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
  • (২) এই পুঁজি ইউরোপের ভূখণ্ডের গণ্ডির মধ্যে বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার সম্ভাবনা কম ছিল। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী দেশগুলি ইউরোপের বাইরে নতুন উপনিবেশের প্রসার ঘটিয়ে সেখানে উদবৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
  • (৩) এই বাস্তব প্রয়োজন থেকেই ইউরোপের পুঁজিপতি রাষ্ট্রগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সেখানে পুঁজি লগ্নির উদ্যোগ নেয়।

(খ) লেনিনের ব্যাখ্যায় বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ

লেনিনের মতে, পুঁজিবাদের জঠরে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শিল্পমালিকরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় দেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পণ্য বিক্রি এবং শিল্পোৎপাদনের জন্য সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালায়।

(গ) লেনিনের ব্যাখ্যায় পুঁজি বিনিয়োগ

  • (১) লেনিন উপনিবেশের প্রসারের ক্ষেত্রে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উপনিবেশে মূলধন বিনিয়োগের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলির পুঁজিপতি শ্রেণি নতুন উপনিবেশ দখল করে সেখানকার শিল্প পণ্য বিক্রির বাজার দখলের চেয়েও সেখানে পুঁজি বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী ছিল।
  • (২) তাই উপনিবেশ থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল নিজ দেশে না নিয়ে গিয়ে উপনিবেশেই পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানেই পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করার চেষ্টা চালায়। লেনিনের মতে “সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ সম্প্রসারিত রূপ”।

(ঘ) লেনিনের ব্যাখ্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা

  • (১) বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের উদ্যোগ নিলেও উপনিবেশের সংখ্যা ছিল সীমিত। ফলে উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুজিঁবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে কাড়াকাড়ি অর্থাৎ প্রতিযোগিতা শুধু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল যুদ্ধ।
  • (২) যেসব ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আগে থেকে বিভিন্ন উপনিবেশ দখল করে রেখেছে তারা তাদের উপনিবেশগুলি ধরে রাখার চেষ্টা করে। আবার পরবর্তীকালে উপনিবেশ দখলে এগিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলি নতুন উপনিবেশ স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে পুরোনো উপনিবেশ দখল করতে এগিয়ে এলে লড়াই শুরু হয়।
  • (৩) লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি হল যুদ্ধের জন্মদাতা। তিনি মনে করেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পুঁজিবাদী শক্তিগুলি কর্তৃক উপনিবেশ দখলের লড়াই।

(ঙ) লেনিনের ব্যাখ্যায় অনুগত অভিজাত শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা

  • (১) লেনিন মনে করেন যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দিকেও পুঁজিপতি শ্রেণির নজর ছিল। তারা এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত অঞ্চলগুলিকে বেছে নিয়ে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানকার নতুন শ্রমিক শ্রেণির ওপর সীমাহীন শোষণ চালায়।
  • (২) এর ফলে পুঁজিপতিরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজ দেশের শ্রমিকদের উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুগত একধরনের অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করে। এই শ্রমিক শ্রেণি শ্রমিক বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে বুর্জোয়াদের সমর্থন করে।

হবসন-লেনিন থিসিসের সমালোচনা

সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী দেশগুলি কর্তৃক কাঁচামাল সংগ্রহ, বাজার দখল, পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুসন্ধান প্রভৃতি বিষয়গুলির যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হবসন-লেনিন প্রদত্ত সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল না। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই মতবাদের সমালোচনা করা হয়। যেমন –

(ক) উপনিবেশের বাইরে বিনিয়োগ

  • (১) উদবৃত্ত পুঁজির সমগ্র অংশই এশিয়া বা আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে লগ্নি করা হয় নি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তাদের মূলধনের বেশিরভাগটাই রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিনিয়োগ করেছিল – যেগুলি তাদের উপনিবেশ ছিল না।
  • (২) অধ্যাপক জে. ডি. ফেজ দেখিয়েছেন যে, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি কর্তৃক বিনিয়োগ করা অর্থের সিংহভাগই বিনিয়োগ হয়েছিল ইউরোপেরই বিভিন্ন রাষ্ট্রে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে, উদবৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যেই সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটেছে।

(খ) শিল্পবিপ্লবের পূর্বে উপনিবেশ

শিল্প বিপ্লব ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উনিশ শতকে। অথচ তার আগে কেন উপনিবেশের উদ্ভব ঘটল তার কোনো ব্যাখ্যা হবসন বা লেনিনের তত্ত্বে পাওয়া যায় না।

(গ) ফরাসি উপনিবেশের ব্যাপক বৃদ্ধি

১৮১৫ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফ্রান্স শিল্প গঠনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও জার্মানির চেয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল। অথচ এই সময় ফ্রান্সের উপনিবেশের বৃদ্ধির হার ছিল তাদের চেয়ে দ্বিগুণ। শিল্পে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্সের উপনিবেশ বৃদ্ধির যথার্থ কারণ হবসন বা লেনিনের ব্যাখ্যায় পাওয়া যায় না।

(ঘ) শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান

  • (১) লেনিন মনে করতেন যে, শিল্পোন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই ভালো ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশের কোনো উপনিবেশ না থাকা সত্ত্বেও এই সব দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান যথেষ্ট উন্নত ছিল।
  • (২) সেই তুলনায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের শ্রমিকদের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। অর্থাৎ উপনিবেশ স্থাপনের সঙ্গে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের কোনো সম্পর্ক নেই।

(ঙ) সুসম্পর্কের গুরুত্ব

  • (১) বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ঔপনিবেশিক শোষণ নয়, সুসম্পর্কের দ্বারাই অধিক পরিমাণ উদবৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগ করা সম্ভব। ব্রিটেন লক্ষ করেছিল যে, তারা আমেরিকাকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরবর্তীকালে বরং আমেরিকায় ব্রিটেনের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • (২) তাই ব্রিটেনের হাতে বিপুল পুঁজি থাকা সত্ত্বেও তারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। কিন্তু হবসন-লেনিনের বক্তব্যে এই সুসম্পর্কের গুরুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

(চ) মৌলিকল্পের অভাব

ডেভিড টমসন সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে প্রদত্ত লেনিনের তত্ত্বকে ‘মৌলিক’ ও ‘সম্পূর্ণ’ বলে মনে করেন না।

হবসন-লেনিন থিসিসের গুরুত্ব

সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যায় হবসন ও লেনিনের মতবাদে বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এই মতবাদের গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা হিসেবে এই তত্ত্ব নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। অধ্যাপক ডেভিড টমসন উপনিবেশ দখলের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক তাগিদকে সমর্থন করে বলেছেন যে, “উনিশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় দেশগুলি কর্তৃক সাগরপারে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র সন্ধানের আগ্রহ তাদের উপনিবেশ দখলে বিশেষ উদ্যোগী করে তুলেছিল।”

উপসংহার :- সাগরপারে বিনিয়োগ যে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল তার প্রমাণ মেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ থেকে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলি এই সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে প্রায় ত্রিশ হাজার মিলিয়ন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল।

(FAQ) হবসন লেনিন থিসিস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হবসন-লেনিন থিসিসের ব্যাখ্যাকর্তা কারা?

জে এ হবসন এবং ভি আই লেনিন।

২. হবসনের লেখা গ্ৰন্থের নাম কি?

‘সাম্রাজ্যবাদ – একটি সমীক্ষা’।

৩. লেনিনের লেখা গ্ৰন্থের নাম কি?

‘সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’।

৪. সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দাতাদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য কারা ছিলেন?

জে এ হবসন এবং ভি আই লেনিন।

Leave a Comment