গার্গী

পরবর্তী বৈদিক যুগের বিদুষী নারী গার্গী প্রসঙ্গে গার্গীর পরিচিতি ও শিক্ষা লাভ, গার্গীর ব্রহ্মবাদিনী উপাধি লাভ, গার্গী কর্তৃক নির্ভীকভাবে শাস্ত্রালোচনা, তার্কিক গার্গী, ঋষিদের স্নেহভাজন গার্গী, গার্গীর প্রখর ও গভীর শাস্ত্রজ্ঞান, গার্গী ও বাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন, জনক রাজার শাস্ত্রীয় মীমাংসা সভা, রাজা জনকের সহস্র ধেনু উপহার এবং জনকের রাজসভায় গার্গী ও বাজ্ঞবল্ক্যের তর্ক যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক গার্গী বাচকন্বী প্রসঙ্গে গার্গীর শিক্ষা লাভ, ব্রহ্মবাদিনী, বিদুষী গার্গী, ঋগ্বেদের টীকাকার গার্গী, গার্গী অর্থ গর্গ মুনির কন্যা, প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠা বিদুষী গার্গী, তার্কিক গার্গী, ঋষিদের স্নেহভাজন গার্গী, গার্গীর প্রখর ও গভীর শাস্ত্রজ্ঞান সম্পর্কে জানব।

পরবর্তী বৈদিক যুগের বিদুষী নারী গার্গী

ঐতিহাসিক চরিত্রগার্গী
অন্য নামবাচক্নবী
উপাধিব্রহ্মবাদিনী
পিতাবচক্নু ঋষি
তর্কযুদ্ধে উপস্থিতজনক রাজার সভায়
পরবর্তী বৈদিক যুগের বিদুষী নারী গার্গী

ভূমিকা :- প্রাচীনকালের আর্য মহিলাগণের মধ্যে গার্গীর নাম চিরবরণীয় ও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

গার্গীর পরিচিতি ও শিক্ষা লাভ

বচক্নু ঋষির পুণ্য তপোবনে তার শিষ্যরা যেমন ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা করতেন, তেমনই তাঁর কন্যা বাচক্নবীও বিদ্যার্থিদের সাথে একত্রে বিদ্যালাভ করতেন। এই বাচক্নবীই গার্গী নামে পরিচিত।

গার্গীর ব্রহ্মবাদিনী উপাধি লাভ

বিদুষী গার্গী কি বেদ, কি বেদান্ত, কি উপনিষদ, সর্ব বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞানবতী ছিলেন বলে তাঁকে ঋষিগণ ব্রহ্মবাদিনী উপাধি দিয়েছিলেন।

গার্গী কর্তৃক নির্ভীকভাবে শাস্ত্রালোচনা

বিদুষী গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যের ন্যায় মহাজ্ঞানী ব্যক্তির সাথেও নির্ভীকভাবে শাস্ত্রালোচনা করতেন। এই সময়ে তার বয়স বেশি ছিল না, তিনি তখন তরুণী ছিলেন।

তার্কিক গার্গী

গার্গী এইরূপ তেজস্বিনী মহিলা ছিলেন যে, কোনো ঋষির সাথে তর্ক উপস্থিত হলে যে পর্যন্ত না কোন সুমীমাংসা হত সে পর্যন্ত তিনি কোনোরূপেই নিবৃত্ত হতেন না। তার তর্ক করবার শক্তি, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং যুক্তির অবতারনা দেখে ঋষিরা আনন্দ লাভ করতেন এবং তাকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করতেন।

ঋষিদের স্নেহভাজন গার্গী

গার্গী এইরূপ তর্কবিতর্কের মধ্যেও আপনার নারী সুলভ বিনয় ও নম্রতার এতটুক ত্রুটি করতেন না। এজন্য ঋষিরা তার প্রতি সকলেই স্নেহপরায়ণ ছিলেন।

গার্গীর প্রখর ও গভীর শাস্ত্র জ্ঞান

বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের ষষ্ঠব্রাহ্মণ অধ্যায়ে গার্গী ও যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন হতে গার্গীর শাস্ত্র জ্ঞান যে কিরূপ প্রখর ও গভীর ছিল তা জানতে পারা যায়।

গার্গী ও বাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথন

গার্গী: “উপনিষদ বলে, পৃথিবী জলের উপর বিরাজমান, একথা সত্য বলিযাই প্রতীতি হয়, কারণ পৃথিবী খনন করলেই জল পাওয়া যায়। অতএব পৃথিবী জলের উপর প্রতিষ্ঠিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব জল হতেই পৃথিবী উৎপন্ন হয়েছে – জলই পৃথিবীর উপকরণ তা নিঃসন্দেহ। কিন্তু মহর্ষি, এই জল কার উপর অবস্থিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: “জল বায়ুর উপর অবস্থিত। কারণ বায়ুই জলের উপাদান।”

গার্গী: বায়ু কার উপর অবস্থিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: বায়ু আকাশে ওতপ্রোতভাবে বিরাজিত।

গার্গী: আকাশ বা অন্তরীক্ষের অবস্থান কোথায়?

যাজ্ঞবল্ক্য: গন্ধর্বলোকে অবস্থিত।

গার্গী: গন্ধর্বলোক কোথায় বিরাজমান?

যাজ্ঞবল্ক্য: আদিত্যলোকে বিরাজিত।

গার্গী: আদিত্যলোক কোথায় অবস্থিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: চন্দ্রলোকের উপর বিরাজমান।

গার্গী: চন্দ্রলোক কাহার উপর অবস্থিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: চন্দ্রলোক নক্ষত্রলোকের উপর অবস্থিত।

গার্গী: নক্ষত্রলোকের অবস্থান কোথায়?

যাজ্ঞবল্ক্য: ইন্দ্রলোকের উপর।

গার্গী: ইন্দ্রলোক কোথায়?

যাজ্ঞবল্ক্য: ইন্দ্রলোক প্রজাপতিলোকের উপর।

গার্গী: প্রজাপতিলোক কোথায় প্রতিষ্ঠিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: ব্রহ্মলোকের উপর বিরাজিত।

গার্গী: ব্রহ্মলোক কোথায় অবস্থিত?

যাজ্ঞবল্ক্য: “বৎসে গার্গী ! তুমি আর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিও না। ব্রহ্মলোক কারও উপর অধিষ্ঠিত নয়। নিখিল ব্রহ্মাণ্ডই তাঁর উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁরই আশ্রয়ে বিদ্যমান। ব্রহ্মলোককে আশ্রয় করে সকল লোক অবস্থান করছে।”

জনক রাজার শাস্ত্রীয় মীমাংসা সভা

  • (১) সেকালে রাজর্ষি জনকের অপূর্ব মনীষা ছিল ভারতবিখ্যাত। জনক রাজা বিবিধ শাস্ত্রীয় মীমাংসার জন্য তার সভায় মহাজ্ঞানী মহা-ঋষিদেরকে আহ্বান করতেন। তাঁর সভায় ব্রহ্ম কি, পরলোক কি, মানবের শেষ পরিণতি কি, সৃষ্টি-স্থিতি-নাশ ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ের আলোচনা হত।
  • (২) ঐ আলোচনাসভায় একদিকে যেমন জনকরাজা পুরুষদেরকে আহ্বান করতেন, তেমনি নারী ঋষিদেরকেও নিমন্ত্রণ করতে ভূলতেন না। পুরুষ ও নারী ঋষিরা সভাস্থলে পরস্পর তর্কবিতর্ক, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও তার মীমাংসা করতেন। তর্কসভার পরিসমাপ্তির পর উভয়জাতীয় পণ্ডিতেরাই যথাযোগ্য ভাবে অভিনন্দিত হতেন এবং উপহার লাভ করিতেন।

রাজা জনকের সহস্র ধেনু উপহার

  • (১) একবার রাজর্ষি জনক এক বিরাট যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। সেই বিরাট যজ্ঞক্ষেত্রে কুরুপাঞ্চাল দেশের বড় বড় পণ্ডিতেরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। রাজা ব্রাহ্মণদের দান করবার জন্য এক সহস্র ধেনু রেখেছিলেন। প্রত্যেকটি ধেনুর শৃঙ্গে দশ দশ পাদ সুবর্ণ ও সযত্নে রাখা হয়েছিল।
  • (২) রাজর্ষি জনক সকল পুরুষ ও নারী ঋষিগণ যজ্ঞস্থলে সমবেত হলে তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “আপনারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞানী মহর্ষি, আপনাদের মধ্যে যিনি ব্রহ্মিষ্টতম, তিনি কৃপাপূর্বক এই ধেনু সকল নিজগৃহে প্রণয়ন করুন।”
  • (৩) যজ্ঞস্থলে এক বিষম সমস্যা উপস্থিত হল। ঋষিগণ কি করবেন স্থির করতে পারলেন না। কে গাভী গ্রহণ করবেন ? কে আপনাকে ব্রহ্মিষ্টতম বলে পরিচয় দেবেন ? বহুক্ষণ পর্যন্ত সকলে নীরব থাকলেন। কিছুকাল পরে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর শিষ্যদেরকে ঐ সহস্র ধেনু গ্রহণ করবার জন্য আদেশ করলেন। শিষ্যগণ যাজ্ঞবল্ক্যের আদেশে গাভীগুলি নিয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের আশ্রমে গমন করলেন।
  • (৪) অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা এতে যাজ্ঞবল্ক্যের উপর ক্রুদ্ধ হলেন। রাজর্ষি জনকের পুরোহিত বজ্রগম্ভীর-কণ্ঠে যাজ্ঞবল্ক্যকে সম্বোধন করে বললেন “আপনি কি মনে করেন যে আপনি এই যজ্ঞস্থলে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ? আপনি ব্রহ্মিষ্টতম – এই কি আপনার বিশ্বাস ?”
  • (৫) যাজ্ঞবল্ক্য বললেন “আমি এমন আস্পর্দা করছি না। আপনারা সকলে ব্রহ্মিষ্ট। তবে আমার ধেনুগুলি গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা বলবতী, তাই আমি এইগুলিকে গ্রহণ করলাম।”
  • (৬) অশ্বল তেজস্বী এবং ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার উপর তিনি আপনাকে একজন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মিষ্ট বলেও মনে করতেন। অশ্বল এরপর দ্রুত যাজ্ঞবল্ক্যকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করলেন। উভয়ে তর্ক আরম্ভ হল।
  • (৭) অশ্বল প্রথমে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। যাজ্ঞবল্ক্য সে সমুদয় প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে তাকে নিরস্ত করলেন। অশ্বল নীবর হলেন। অশ্বলের পরে আতভাগ, কহোল প্রমুখ আরও কয়েকজন ঋষি তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন, তারাও পরাজয় স্বীকার করলেন।

জনকের রাজসভায় গার্গী ও বাজ্ঞবল্ক্যের তর্ক যুদ্ধ

যখন আর কোনো ব্রাহ্মণই যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করতে অগ্রসর হলেন না তখন অগ্রসর হলেন মহীয়সী বিদুষী মহিলা গার্গী। যজ্ঞসভাতলে এই তেজস্বিনী মহিলার অপূর্ব প্রতিভামণ্ডিত বদনশ্রী এবং সাহস দেখে ব্রাহ্মণগণ আশ্চর্য হলেন। গার্গী প্রশ্নের পর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও আশ্চর্য শাস্ত্রজ্ঞান দেখে সকলে বিস্মিত হলেন। যাজ্ঞবল্ক্যকে পরাজয় স্বীকার করতে হল।

উপসংহার :- সেই দিন রাজর্ষি জনকের সভাস্থলে ব্রাহ্মণদেরকে একজন মহিলাকেই শ্রেষ্ঠতম ও ব্রহ্মিষ্টতম হিসেবে স্বীকার করে নিতে হল।

(FAQ) পরবর্তী বৈদিক যুগের বিদুষী নারী গার্গী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গার্গী কে ছিলেন?

পরবর্তী বৈদিক যুগের একজন বিদুষী নারী।

২. গার্গীর পিতার নাম কি ছিল?

বচক্নু ঋষি।

৩. গার্গীর অন্য নাম কি ছিল?

বাচক্নবী।

৪. গার্গী কার রাজ সভায় তর্কযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন?

রাজা জনক।

৫. গার্গী তর্কযুদ্ধে কাকে পরাজিত করেন?

যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি কে।

৬. ঋষি গার্গী কেন বিখ্যাত হয়েছিলেন?

প্রাচীন ভারতীয় ঋষি ও দার্শনিক হলেন গার্গী। বৈদিক সাহিত্যে তিনি একজন মহান প্রাকৃতিক দার্শনিক হিসাবে সম্মানিত, বেদের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকর্তা এবং ব্রহ্মবাদিনী নামে পরিচিত, যিনি ব্রহ্ম বিদ্যার জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment