সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র

সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র প্রসঙ্গে গুপ্ত যুগের সামন্ততন্ত্রের অবসান, দিল্লির সুলতানি আমলে সামন্ততন্ত্র, ইক্তা ব্যবস্থা, সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে ইক্তা ব্যবস্থা, ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য, ইক্তা ব্যবস্থায় বিবর্তন, সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা, সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় অভিজাতগোষ্ঠীর উত্থান ও ডক্টর মুজিবের মন্তব্য সম্পর্কে জানবো।

ভারতে সুলতানি আমলে সামন্ততন্ত্র প্রসঙ্গে দিল্লির সুলতানি আমলে সামন্ততন্ত্র, ভারতে সুলতানি আমলে ইক্তা ব্যবস্থা, সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো, সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা ও ভারতে সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানব।

সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি যুগে ভারতে সামন্ততন্ত্র
ইক্তা প্রথাইলতুৎমিস
অর্থএক অংশ
মাকতিইক্তার প্রাপক
খালিসাসুলতানের খাস জমি
নিয়ন্ত্রণ শিথিলগিয়াসউদ্দিন তুঘলক
বংশানুক্রমিকফিরোজ শাহ তুঘলক
সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র

ভূমিকা :- মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপ-এ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা যেরূপ ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছিল অনুরূপ ব্যাপকতা ভারত-এ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতে মধ্যযুগে দিল্লি সুলতানির শাসনকালে শাসনব্যবস্থার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো লক্ষ্য করা যায়। তবে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র-এর বিচারে ভারতে সামন্ততন্ত্র-এর অস্তিত্ব খুবই দুর্বল।

গুপ্ত যুগের সামন্ততন্ত্রের অবসান

প্রাচীন যুগে, বিশেষ করে গুপ্ত যুগে সামন্ততন্ত্র ও পরবর্তীকালে আদি-মধ্য যুগে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান কিছুটা সক্রিয় থাকলেও ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে তুর্কি মুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই এর অবসান ঘটেছিল।

দিল্লি সুলতানির আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র

ভারতে সুলতানির প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় আবার সামন্ততান্ত্রিক কিছু কিছু উপাদান প্রবেশ করে। তবে অবশ্যই তা পশ্চিম ইউরোপের সামন্ততন্ত্র-এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। দিল্লি সুলতানির কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচ লক্ষ্য করা গিয়েছিল মাত্র।

সুলতানি আমলে ইক্তা ব্যবস্থা

এই সময় রাজকীয় জমি ছোটো-বড়ো বিভিন্ন অংশে ভাগ করে সেনাধ্যক্ষ, সৈনিক এবং অন্যান্য মুসলিম অভিজাতদের মর্যাদা অনুসারে তাদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হত। এটি ইক্তা ব্যবস্থা নামে পরিচিত। দিল্লি সুলতানির শাসনকালে কেন্দ্রীয় শাসন যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও ইক্তা ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে এই সময় সুলতানি শাসনব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

ভারতে সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো

ইক্তা ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(ক) ইক্তা ব্যবস্থা

আক্ষরিক অর্থে ‘ইক্তা’ বলতে ‘এক অংশ’ বোঝায়। ইক্তা ব্যবস্থা ইসলামীয় জগতে প্রচলিত ছিল এবং সেখান থেকে তুর্কিরা এই ব্যবস্থা ভারতে আমদানি করে। ইতিহাসবিদ কে. এ. নিজামি লিখেছেন, “ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য দিল্লির প্রথম দিকের তুর্কি সুলতানগণ বিশেষ করে ইলতুৎমিস ইক্তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।” কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন সুলতানের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুলতানি যুগে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

(খ) সুলতানি আমলে ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ইক্তা ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

  • (১) এই ব্যবস্থার দ্বারা সুলতান তাঁর ‘খালিসা’ জমির বাইরে অবস্থিত জমিগুলি নির্দিষ্ট শর্ত ও কর্তব্য পালনের বিনিময়ে তাঁর সেনাধ্যক্ষ, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন।
  • (২) বিনিময়ে ইক্তাদার’ বা ‘মুক্তি’ বা ‘মাকতি’ নামে ইক্তার প্রাপকরা সুলতানকে প্রয়োজনে সৈন্য সরবরাহ করতেন।
  • (৩) সুলতানের নামে মাকতি তাঁর ইক্তা এলাকায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। এক কথায়, সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে ইক্তাদারকে নগদ অর্থের পরিবর্তে ভূমিদান করা হত যেখান থেকে ইজাদার রাজস্ব আদায় করে তাঁর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতেন।

(গ) সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থায় বিবর্তন

ইলতুৎমিসের পরবর্তীকালে কোনো কোনো সুলতান ইক্তা ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা রোধ করার উদ্যোগ নিলেও কোনো কোনো সুলতানের পদক্ষেপে ইক্তা ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোটি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। যেমন –

  • (১) আলাউদ্দিন খলজি ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করলেও গিয়াসউদ্দিন তুঘলক-এর আমলে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে।
  • (২) ফিরোজ শাহ তুঘলক ইক্তা ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে এই প্রথাকে বংশানুক্রমিক করেন। ফলে ইক্তাদারের আত্মীয়রা বংশানুক্রমে ইক্তার ভোগ দখলের অধিকার পায়। পরবর্তীকালে এদের মধ্যে স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। এই ভাবে ইক্তা প্রথায় সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

(ঘ) সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা

  • (১) সামন্ততান্ত্রিক ভূমিদান ব্যবস্থায় দেখা যেত যে, একজন সামন্ত যে শর্তে রাজার কাছ থেকে ভূমি লাভ করেছেন, তিনি আবার একই শর্তে তাঁর অধীনস্থ সামন্তকে ভূমি বিতরণ করতে পারতেন। এভাবে সামন্তপ্রভু নিজ এলাকায় রাজার মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাইতেন।
  • (২) একইভাবে সুলতানি যুগে ইক্তাদাররাও সর্বদা নিজ ইক্তার আদায়িকৃত অর্থ নিজে আত্মসাৎ করতে এবং স্বাধীনভাবে তাঁর ইক্তা এলাকা শাসন করতে চাইতেন। এভাবে ইক্তা প্রথার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা লুকিয়েছিল।
  • (৩) পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইক্তাদাররা দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনকে অগ্রাহ্য করতে থাকে। ফলে সুলতানি শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশের বিভিন্ন অংশে সামন্তপ্রভুর শাসন শুরু হয়। ইক্তা ব্যবস্থার কাঠামোটি থেকে পরবর্তী মোগল আমলে সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের জায়গিরদারি ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে।

(ঙ) অভিজাতদের ক্ষমতা

সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ অভিমত দিয়েছেন যে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল বিভিন্ন তুর্কি অভিজাতগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন। –

  • (১) বিভিন্ন অঞ্চলে অভিজাতরা স্থানীয় সামন্তপ্রভুর মতো সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করতেন। নিজ নিজ অঞ্চলে অভিজাতদের বিপুল ক্ষমতা ছিল।
  • (২) অভিজাতদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ইক্তার রাজস্ব বা নগদ বেতন। এ ছাড়া তাদের বিপুল সম্পত্তি থেকেও প্রচুর আয় হত।
  • (৩) অভিজাতদের সীমাহীন আর্থিক শক্তি কখনো-কখনো সুলতানের আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াত। এর ফলে দিল্লির অধিকাংশ সুলতান অভিজাতগোষ্ঠীকে বিশেষভাবে তোষণ করেই চলতেন।
  • (৪) অভিজাতরা সীমাহীন বিলাসিতার মধ্যে জীবন যাপন করতেন। তাঁরা সুলতানের অনুকরণে হারেম-সহ সুবিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করতেন, অসংখ্য দাসদাসী ও পরিবারের ভরণ-পোষণ বহন করতেন। অভিজাতরা বংশানুক্রমিক ভাবে তাদের ক্ষমতা ও সম্পত্তি ভোগদখল করতেন।
  • (৫) বিভিন্ন সময় অভিজাতদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত এবং এই উপলক্ষ্যে তাঁরা বিপুল অর্থ ব্যয় করতেন।
  • (৬) মূলত অভিজাতদের ক্ষমতার ওপরই সুলতানের ক্ষমতা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। অবশ্য গ্রামীণ হিন্দু অভিজাতদের ক্ষমতা শহরের তুর্কি অভিজাতদের তুলনায় অনেক কম ছিল।

সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় অভিজাতগোষ্ঠীর উত্থান

দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে সুলতানের কাজ ছিল রাজ্যজয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব আদায় করা। রাষ্ট্রের এই বিপুল কাজ সম্পন্ন করার জন্য সুলতানের একার ক্ষমতা যথেষ্ট ছিল না। তাই সুলতানদের অধীনে একটি দক্ষ ও বিশ্বস্ত অভিজাতগোষ্ঠী গড়ে উঠত। উচ্চতর প্রশাসনে তুর্কি অভিজাত এবং স্থানীয় গ্রামীণ অঞ্চলে হিন্দু অভিজাতদের মধ্যে একপ্রকার অঘোষিত ক্ষমতার বিভাজন ঘটেছিল।

সুলতানি আমলে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে মুজিব এর মন্তব্য

তাই ড. মুজিব বলেছেন যে, “দিল্লির সুলতানি শাসন ছিল প্রকৃতিতে এককেন্দ্রিক, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল কতকগুলি সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত অর্ধ-স্বাধীন ভৌগোলিক অঞ্চলের দ্বারা গঠিত রাষ্ট্রমণ্ডল।”

উপসংহার :- ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে বিতর্ক এখনো বিদ্যমান। প্রাচীন গুপ্ত যুগে এবং মধ্যযুগের সুলতানি আমলে সামন্ততন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলেও পশ্চিম ইউরোপের মত ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো কখনোই গড়ে ওঠে নি।

(FAQ) সুলতানি আমলে ভারতে সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুলতানি যুগে কোন প্রথা কে কেন্দ্র করে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে?

ইক্তা প্রথা।

২. সুলতানি আমলে ইক্তা প্রথা প্রবর্তন করেন কে?

ইলতুৎমিস।

৩. ইক্তা কথার অর্থ কি?

এক অংশ।

৪. ইক্তা প্রথা কে বংশানুক্রমিক করেন কে?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

Leave a Comment