দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে সফল সুলতান নন, মূল ভিত্তি অরক্ষিত, দুর্বল ও শিথিল শাসননীতি, ফিরোজ শাহের নিষ্ক্রিয়তা, ব্যক্তিগত চরিত্রের ত্রুটি তোষণ নীতি, উদারনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে জানবো।

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাদিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব
সুলতানফিরোজ শাহ তুঘলক
প্রশংসাআফিফ
মৃত্যু১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ
দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব

ভূমিকা :- ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে ৪৫ বৎসর বয়সে সুলতানি সিংহাসনে বসেন। ফিরোজ শাহের রাজত্বকাল শান্তি ও স্থিতির দ্বারা সূচিত হয়। কোনো বৈদেশিক আক্রমণ অথবা বড় ধরনের বিদ্রোহ তাঁর আমলে সুলতানি সাম্রাজ্যের শান্তি নষ্ট করে নি। তার শাসন ব্যবস্থা মোটামুটি জনপ্রিয় ছিল।

ফিরোজ শাহ তুঘলক সফল সুলতান নন

সমকালীন ঐতিহাসিক আফিফ তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ফিরোজের শাসনকালে কোনো দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সঙ্কটও ঘটে নি। সরকারী কর্মচারী, অভিজাত ও উলেমারা তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। তথাপি ঐতিহাসিকদের বিচারে ফিরোজকে সফল সুলতান বলা চলে না। তুঘলক সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ফিরোজ শাহের দায়িত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

দিল্লি সুলতানির মূল ভিত্তি অরক্ষিত

  • (১) সুলতানি যুগে force অর্থাৎ শক্তি ছিল রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রধান উৎস। এই শক্তি বলতে প্রধানত সামরিক শক্তি এবং সুলতানের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা বুঝাত। বলবন, আলাউদ্দিন খলজি এই দুই প্রকার শক্তির দ্বারা সুলতানি শাসনকে মজবুত করেন।
  • (২) মহম্মদ বিন তুঘলকও এই শক্তি মোটামুটি রক্ষা করেন। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ ঘটলেও তিনি তা দমন করে তার স্বৈর ক্ষমতার মাধ্যমে সুলতানি সিংহাসনকে রক্ষা করেন। ফিরোজ শাহ যদিও জনপ্রিয় সুলতান ছিলেন, তিনি সুলতানি সিংহাসনের এই মূল ভিত্তিকে রক্ষা করতে পারেন নি।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের দুর্বল ও শিথিল শাসননীতি

  • (১) ফিরোজ শাহের দুর্বল ও শিথিল শাসননীতির জন্য কর্মচারীদের ভীতি কমে যায়। সেনাদলে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সকল স্তরের কর্মচারীরা দুর্নীতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। সুলতানি আমলাতন্ত্রের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়।
  • (২) সরকারী পদগুলিকে ব্যবহার করে আমলা শ্রেণী নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করে। সুলতান তাদের শাস্তি দিতে অক্ষমতা দেখালে, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের সাহস বেড়ে যায়।
  • (৩) উদাহরণ স্বরূপ ইমাদ-উল-মুলক বশিরের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি সেনাদলে দেওয়ান-ই-আরজের পদটিকে ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ দ্বারা ১৩ কোটি টাকা সঞ্চয় করেন। এই অর্থ ছিল ফিরোজের দু বছরের গোটা রাজস্বের সমান।
  • (৪) আইন-ই-মহরুর মতে, সুলতান এই সকল দুর্নীতির কথা জানলেও এই বিষয়ে চোখ বুজে থাকাকেই নীতি হিসাবে নেন। এর ফলে আমলাতন্ত্রের কর্মশক্তির শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। সুলতান তার চেষ্টাকৃত উদাসীনতার জন্য আমলাতন্ত্রের প্রিয়ভাজন হলেও, রাষ্ট্রের স্বৈর ক্ষমতা ধ্বসে পড়ে।

ফিরোজ শাহের পক্ষে যুক্তি

সুলতান ফিরোজ শাহের স্বপক্ষে এই যুক্তি দেখান যেতে পারে যে, মহম্মদ তুঘলকের আমলেই তুঘলক সাম্রাজ্য-এ ভাঙ্গন দেখা দেয়। মহম্মদ দাক্ষিণাত্যের ওপর আধিপত্য হারান। বাংলার বিদ্রোহ তিনি দমন করেন নি। সিন্ধুর বিদ্রোহ দমন করার সময় তার মৃত্যু হয়। তাছাড়া তার কঠোর ও খামখেয়ালী নীতির জন্য তিনি কর্মচারীদের আস্থা হারান। তার বিরুদ্ধে নিরন্তর বিদ্রোহ দেখা দেয়।

সুলতান ফিরোজ শাহের নিষ্ক্রিয়তা

  • (১) মহম্মদের দায়িত্ব অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, ফিরোজের দায়িত্ব মহম্মদ অপেক্ষা অনেক বেশী ছিল। মহম্মদের আমলে যে অঞ্চলগুলি সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, ফিরোজ তা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রকৃত চেষ্টা করেন নি।
  • (২) তার ৩৮ বছরের রাজত্বকালে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের বহু সুযোগ ছিল। কারণ, কোনো বৈদেশিক আক্রমণ বা বিদ্রোহ তাকে বিপন্ন করে নি। কিন্তু দক্ষিণের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য তিনি পুরোপুরি ত্যাগ করেন। মাবারের মুসলিম শাসকরা বাহমনী রাজ্য-এর বিরুদ্ধে তার সহায়তা চাইলে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেন।
  • (৩) বাংলায় ইলিয়াস শাহ-এর বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি বাংলায় ব্যর্থ অভিযান চালান। সুলতানি সরকারের এজন্য প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ইলিয়াসের পুত্র সিকান্দার শাহ-এর স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। বাংলা চিরদিনের মত সুলতানি শাসন থেকে বিচ্যুত হয়। তিনি অবশ্য মুখ রক্ষার জন্যে জাজনগর অভিযান করেন।
  • (৪) একমাত্র সিন্ধুদেশের বিদ্রোহ ফিরোজ শাহ দমনে সক্ষম হন। কিন্তু সিন্ধু অভিযানের সময় তার অপটু সামরিক নেতৃত্ব সুলতানি সেনাদলের মর্যাদা বিনষ্ট করে। প্রথম সিন্ধু অভিযানে বিফলতার পর, তিনি রাস্তা ভুল করে কচ্ছের দুর্গম ‘রান’ অঞ্চলে নানা দুর্ভোগে পড়েন।
  • (৫) শেষ পর্যন্ত তাঁর উজির খান-ই-জাহান মকবুল, দিল্লী থেকে নতুন সেনাদল এনে সিন্ধুর বিদ্রোহ দমন করেন। মহম্মদ তুঘলকের মত সামরিক দক্ষতা ও দৃঢ় মনোবল না থাকায় ফিরোজ সুলতানি সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষায় ব্যর্থ হন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের ব্যক্তিগত চরিত্রের ত্রুটি

  • (১) ফিরোজের ব্যক্তিগত চরিত্র তার সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কম দায়ী ছিল না। তিনি ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। কোনো সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার ক্ষমতা তার ছিল না। অথচ স্বৈরতন্ত্রকে কার্যকরী রাখতে হলে এই ক্ষমতার বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
  • (২) তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, নরম প্রকৃতির লোক। তাঁর নীতি ছিল বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সাহস না দেখিয়ে, গোলমালের ভয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা। তাঁর এই পলায়নী মনোবৃত্তি সুলতানি শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের তোষণ নীতি

  • (১) ফিরোজ শাহ নিজ শক্তির জোরে শাসন না করে, সাম্রাজ্যের দুই প্রধান ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী যথা উলেমা শ্রেণী ও অভিজাতদের তোষণ করে তাদের সহায়তায় নিরুপদ্রবে ৩৮ বছর রাজত্ব করেন।
  • (২) এই দুর্বল ও পৌরুষ হীন নীতি সুলতানি শাসন ব্যবস্থার মর্যাদা বিনষ্ট করে। তাঁর এই তোষণ নীতির মূল্য ছিল তাৎক্ষণিক ও নিতান্তই অস্থায়ী। তাই তার মৃত্যুর পর তুঘলক বংশ-এর শাসন ভেঙে পড়ে।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের উদারনৈতিক সংস্কার

সুলতান ফিরোজ শাহ তাঁর উদারনৈতিক সংস্কারের জন্য আফিফের মতে বিশেষ জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু যে সংস্কারগুলির জন্য তিনি এত জনপ্রিয়তা পান পরিণামে তা তুঘলক সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কারণ হিসেবে কাজ করে। যেমন –

  • (১) তিনি শরিয়ত সম্মতভাবে অপরাধীকে লঘু দণ্ডদানের নিয়ম চালু করেন। মুসলিম অপরাধীর প্রাণদণ্ড বন্ধ করেন। এর ফলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা কঠোর শাস্তির ভয় না থাকায়, দুহাতে সরকারী রাজস্ব লুঠ করতে থাকে।
  • (২) ফিরোজ শাহ শরিয়ত সম্মতভাবে দণ্ডদান প্রথা চালু করেন। কিন্তু শরিয়তে কোনো স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ও স্বাধীন সুলতানের অস্তিত্ব স্বীকার করা হত না। এর ফলে সুলতানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করত বা সুলতানি রাজস্ব তছরূপ করত তাদের রাজদ্রোহী বলা যেত না। কারণ, শরিয়ত স্বাধীন সুলতানির অস্তিত্ব স্বীকার করত না। অপরাধীরা কঠোর দণ্ডের হাত থেকে অব্যাহতি পেত।
  • (৩) আলাউদ্দিন ও মহম্মদের আমলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রই আইনবিধি রচনা করত। কিন্তু ফিরোজ শাহ উলেমাদের অনুমোদন ক্রমে আইনবিধি রচনার নীতি নেওয়ার ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়। উলেমারা শাসনকার্যে হস্তক্ষেপের সুযোগ পান।
  • (৪) তিনি সেনাদলকে নগদ বেতন দানের পরিবর্তে জাগীর থেকে রাজস্ব ভোগ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি সেনাদল সহ বিভিন্ন সরকারী পদগুলিতে বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োগের প্রথা চালু করেন। এর ফলে সেনাদলের শৃঙ্খলা ও দক্ষতা বিনষ্ট হয়।
  • (৫) তিনি সেনাদলে নিয়মিত ‘আরজ’ বা হাজির এবং কুচকাওয়াজ চালু রাখতে পারেন নি। সুলতানি সিংহাসনের মেরুদণ্ড ছিল তার সামরিক বাহিনী। ফিরোজের উপরোক্ত ব্যবস্থার ফলে সেই বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। সিন্ধু অভিযানের সময় থেকেই বোঝা যায় যে, ফিরোজ সুলতানি সরকারের সমরযন্ত্রে ভাঙন ধরিয়েছেন।
  • (৬) ফিরোজ অসংখ্য ক্রীতদাস নিয়োগ করেন। এই দাসদের ভরণ-পোষনের জন্য বহু অর্থ ব্যয় হত। ফিরোজের মৃত্যুর পর এই দাস কর্মচারীরা প্রাসাদ চক্রান্ত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এর ফলে তুঘলক বংশের পতন ঘটে।

উপসংহার :- ফিরোজ যে ৩৮ বছর কাল রাজত্ব করেন, এই সময় তিনি শক্তহাতে শাসন দণ্ড ধারণ করলে তুঘলক সাম্রাজ্যের অকালে পতন হত না।

(FAQ) দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান অসংখ্য দাস নিয়োগ করেন?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

২. ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকাল কত?

১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ।

৩. কোন সুলতানের আমলে বৈদেশিক আক্রমণ ঘটে নি?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৪. সুলতানী যুগের আকবর কাকে বলা হয়?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

Leave a Comment