শেরশাহের রাজ্য বিস্তার

শেরশাহের রাজ্য বিস্তার প্রসঙ্গে শের শাহের বাংলা অভিযান, বাংলা অধিকার, সুলতান রূপে অভিষেক, হুমায়ুনকে দুর্বল করা, চৌসার যুদ্ধ, চৌসার যুদ্ধের গুরুত্ব, বিলগ্রামের যুদ্ধ, হুমায়ুনের ভারত ত্যাগ, দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন, গক্কার উপজাতির বিরুদ্ধে অভিযান, সিন্ধু মুলতান পাঞ্জাব রাজপুতানা মালব জয়, মেবার জয়, কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

শেরশাহের রাজ্য বিস্তার

ঐতিহাসিক ঘটনাশেরশাহের রাজ্য বিস্তার
রাজাশেরশাহ
বংশসুরি বংশ
রাজধানীদিল্লি
মৃত্যু১৫৪৫ খ্রি
শেরশাহের রাজ্য বিস্তার

ভূমিকা :- ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধের পর শের খাঁ তাঁর দূরদৃষ্টির দ্বারা বুঝতে পারেন যে, দিল্লীর সম্রাট হুমায়ুন তার শক্তিবৃদ্ধিকে সহ্য করবেন না। এর আগে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে চূনার আক্রমণ দ্বারা হুমায়ূন তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।

শেরশাহের বাংলা অভিযান

  • (১) শের খাঁ দেখেন যে পশ্চিমে দিল্লীর সম্রাট ও পূর্বে বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ তাকে দুদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন। তিনি one by one policy বা একের পর এক নীতি নিয়ে প্রথমে বাংলার মাহমুদ শাহকে ধ্বংস করার সঙ্কল্প নেন, যাতে হুমায়ূনের আক্রমণের সময় তার হাত পরিষ্কার থাকে।
  • (২) বিহার ও বাংলা তার অধীনে যুক্ত করতে পারলে তিনি তাঁর আত্মরক্ষার পরিধিক্ষেত্র (room for defence) বাড়াতে পারবেন। হুমায়ূনের আক্রমণের সময় মাহমুদ শাহ তার পৃষ্ঠদেশে চুরিকাঘাত করতে পারবেন না।

শেরশাহের বাংলা অধিকার

  • (১) হুমায়ুনের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার আগেই একের পর এক (One by One) রণকৌশল নিয়ে শের খাঁ ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। মাহমুদ শাহ ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ও কিউল হতে সকরিগলি ঘাট পর্যন্ত স্থান শের শাহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
  • (২) কিন্তু শের শাহের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার সিংহাসন অধিকার। সুতরাং ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে শের খাঁ পুনরায় বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। শের খাঁর শক্তি বৃদ্ধি মুঘল সাম্রাজ্য-এর পক্ষে আদপেই নিরাপদ নয় একথা হুমায়ূন বুঝতে পারেন।
  • (৩) সুতরাং শের খাঁ গৌড় অবরোধে ব্যস্ত থাকার সুযোগে হুমায়ূন বিহারে শের খাঁর ঘাঁটি চুনার দুর্গ অবরোধ করেন। হুমায়ূন চুনার অবরোধে অযথা কালক্ষেপ করেন। এই সুযোগে শের খাঁ গৌড় লুঠপাট করেন।

সুলতান রূপে শেরশাহের অভিষেক

১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় সুলতান রূপে তার অভিষেক সম্পন্ন করেন। তিনি সুলতান ফরিদ-উদ-দুনিয়া-ওয়াদিন-আবুল মুজাফ্ফর শের শাহ উপাধি নেন।

শেরশাহ কর্তৃক হুমায়ূনকে দুর্বল করা

  • (১) চুনার দুর্গ অধিকারের পর হুমায়ূন বাংলা আক্রমণ করেন। শেরশাহ অপূর্ব রণকৌশল দ্বারা হুমায়ূনকে বিপদগ্রস্থ করেন। তিনি হুমায়ূনের বাংলা আক্রমণের মোকাবিলা না করে, গৌড় ত্যাগ করেন। তিনি হুমায়ূনের পাশ কাটিয়ে বিহারে চলে আসেন।
  • (২) তিনি তাঁর পূর্ণ শক্তি নিয়ে রোটাস, জৌনপুর ও কনৌজ অধিকার করে আগ্রায় মুঘল শাসনকে বিপন্ন করেন। হুমায়ুনের আগ্রায় ফিরে আসার পথ তিনি রুদ্ধ করেন। মাছ জল হতে ডাঙায় পড়লে যেমন অবস্থা হয়, তেমন রাজধানী আগ্রা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলায় পড়ে থেকে হুমায়ূন দুর্বল হয়ে পড়েন।

হুমায়ুন ও শেরশাহের মধ্য়ে চৌসার যুদ্ধ

হুমায়ূন নিজের বিপদ বুঝতে পেরে দিল্লীর দিকে দ্রুত ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিহারের বক্সারের কাছে গঙ্গাতীরে চৌসা গ্রামে শেরশাহ তাঁর পথ আটকান। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধ-এ শেরশাহের বিক্রমে মুঘল বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। হুমায়ূন কোনো রকমে গঙ্গা পার হয়ে প্রাণ বাঁচান।

চৌসার যুদ্ধের গুরুত্ব

  • (১) শেরশাহের জীবনে চৌসার যুদ্ধ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর ফলে তিনি কনৌজ থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আধিপত্য পান। তিনি এর পর শেরশাহ সুলতান-ই-আদিল খেতাব ধারণ করেন।
  • (২) ডঃ কে. আর কানুনগোর মতে, চৌসার জয়ের ফলে জৌনপুরের শর্কি বংশের রাজ্যসহ বিহার ও বাংলা তার অধিকারে চলে আসে। তিনি দিল্লীর সম্রাটের সমকক্ষ ক্ষমতার অধিকারী হন। এরপর তার লক্ষ্য হয়, দিল্লীর সিংহাসন দখল।

হুমায়ুন ও শেরশাহের মধ্যে বিলগ্ৰামের যুদ্ধ

হুমায়ূন আগ্রায় ফিরে এসে পুনরায় সৈন্য সংগঠন করেন এবং ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আক্রমণ হানেন। কিন্তু কনৌজের কাছে বিলগ্রামের যুদ্ধে শেরশাহ সম্পূর্ণভাবে হুমায়ূনকে বিধ্বস্ত করেন। হুমায়ূনের কামান বাহিনী, ধনরত্ন ও রসদপত্র শের শাহ অধিকার করেন। বহু মুঘল সেনা নিহত হয়। সংখ্যাগুরু মুঘল বাহিনী প্রাণ ভয়ে পালায়।

ঐতিহাসিক সরকারের অভিমত

স্যার জে. এন. সরকারের মতে, “এই যুদ্ধকে যুদ্ধ না বলে ভীতি ও আতঙ্কগ্রস্থ বাহিনীর অসহায় পলায়ন বলা উচিত, যা মুঘল মহিমাকে অবর্ণনীয় অসম্মানের পাকে ডুবিয়ে দেয়”।

হুমায়ূনের ভারত ত্যাগ

  • (১) পরাজিত হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তিনি আশ্রয় পাওয়ার জন্য নানা স্থানে চেষ্টা করলেও, শের শাহের আক্রমণের ভয়ে কেউ তাকে আশ্রয় দেন নি। এমনকি এই বিপদের দিনে তাঁর ভ্রাতা কামরান তাকে লাহোরে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেন।
  • (২) হুমায়ূনের পিছু নিয়ে শেরশাহ লাহোর চলে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর সেনাপতি ব্রহ্মজিৎ গৌড় আগ্রা এবং সেনাপতি নাসির খান দিল্লী দখল করেন। শের শাহ পাঞ্জাব থেকে হুমায়ূনের অন্য ভ্রাতাদের হঠিয়ে দেন। হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত পারস্যে চলে যান। শের শাহের জীবিতকালে তাঁর পক্ষে আর ভারত-এ ফিরে আসা সম্ভব হয়নি।

দিল্লিতে শেরশাহের রাজধানী স্থাপন

বিলগ্রাম বা কনৌজের যুদ্ধ জয়ের পর শের শাহ দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি দখল করে দিল্লীকে নিজ রাজধানীতে পরিণত করেন।

গক্কার উপজাতির বিরুদ্ধে শেরশাহের অভিযান

এর পর তিনি সিন্ধু ও ঝিলামের মধ্যবর্তী অঞ্চলে গক্কার উপজাতির বিরুদ্ধে অভিযান চালান। গক্কাররা মুঘলদের অনুগত ছিল। গক্কার অঞ্চলে তিনি দ্বিতীয় রোটাস নামে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করেন।

শেরশাহের পুনরায় বাংলা অভিযান

  • (১) গক্কার বিদ্রোহ সম্পূর্ণ দমন করার আগেই শেরশাহকে বাংলায় ছুটে যেতে হয়। বাংলার শাসনকর্তা খিজির খাঁ বিদ্রোহ ঘোষণা করায় তিনি তাকে পদচ্যুত করেন। তিনি বাংলাকে ১৯টি সরকারে ভাগ করে প্রতি সরকার শিকদারের শাসনে রাখেন।
  • (২) ১৯ জন শিকদারের ওপরে আমীর-ই-বাংলা নামে এক কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়। প্রতি শিকদার ফৌজদারী মামলার বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার পান। তাঁদের অধীনে সৈন্যদল রাখা হয়।
  • (৩) প্রতি সরকারে দেওয়ানী মামলার বিচারের জন্য মুন্সেফ নিযুক্ত করা হয়। সরকারগুলিকে পরগণায় ভাগ করা হয়। তিনি তার বিশ্বাসভাজন কাজী ফজিলৎকে আমিন-ই-বাংলা বা বাংলার প্রধান শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করেন। শের শাহ বাংলায় সামরিক শাসনের স্থলে অসামরিক শাসন প্রবর্তন করেন।

আফগাণ শাসক শেরশাহের সিন্ধু, মূলতান, পাঞ্জাব, মালব জয়

  • (১) এরপর তিনি সিন্ধু, মূলতান ও পাঞ্জাব জয় করেন। পশ্চিম ভারতে রাজপুত শক্তি খানুয়ার যুদ্ধ-এ পরাজয়ের পর নতুন করে শক্তি লাভ করছিল। শেরশাহ রাজপুতদের দমন করার কাজে হাত দেন।
  • (২) তিনি প্রথমে মালব আক্রমণ করেন। মান্ডু, উজ্জয়িনী ও রনথম্ভোর অধিকারের পর তিনি গোয়ালিয়র জয় করেন। মালব সম্পূর্ণভাবে তাঁর পদানত হয়। এর পর শের শাহ রায়সিন অধিকার করেন।

শেরশাহের মারওয়াড় দখল

রাজপুত রাজাদের মধ্যে মারওয়াড়ের অধিপতি মালদের খুবই শক্তিশালী ছিলেন। তিনি শেরশাহকে প্রবল বিক্রমে বাধা দিয়ে পরাস্ত হন। আজমীর থেকে আবু পাহাড় পর্যন্ত অঞ্চল শেরশাহের পদানত হয়।

আফগাণ শাসক শেরশাহের মেবার জয়

এরপর তিনি মেবার জয় করেন। বিখ্যাত চিতোর দুর্গ তার অধিকারে আসে। এই জয়ের ফলে সমগ্র রাজস্থান শেরশাহের বশ্যতা স্বীকার করে।

শেরশাহের কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ

রাজপুতানা জয়ের পর শের শাহ বুন্দেলখণ্ডে কালিঞ্জর দুর্গ অধিকারের চেষ্টা করেন। এই দুর্গের অধিপতি কিরাত সিং তাকে এক বছর ধরে বাধা দেন।

শেরশাহের মৃত্যু

কালিঞ্জর দুর্গের অবরোধ চালাবার সময় একটি বারুদের নল ফেটে ২২শে মে, ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যু হয়।

উপসংহার :- মৃত্যুকালে শেরশাহের সাম্রাজ্য সীমা ছিল কাশ্মীর, গুজরাট ও আসাম ব্যতীত সমগ্র উত্তর ভারত। তার সাম্রাজ্যের পশ্চিমে ছিল সিন্ধু নদ, উত্তর-পশ্চিমে গরুর দেশ, উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম ও দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত।

(FAQ) শেরশাহের রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুরজগড়ের যুদ্ধ কখন হয়?

১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে।

২. শের খাঁ কখন বাংলা আক্রমণ করেন?

১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে।

৩. শের খাঁ কোন কোন যুদ্ধে হুমায়ূনকে পরাজিত করেন?

১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে এবং ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে বিলগ্ৰামের যুদ্ধে।

৪. কোন দুর্গ অবরোধ কালে শেরশাহের মৃত্যু হয়?

কালিঞ্জর দুর্গ।

Leave a Comment