ভারতে আরব অভিযান প্রসঙ্গে খলিফা ওমরের আমলে অভিযান, মাকরান অভিযান, বোলান অভিযান, হজ্জাজের সিন্ধু আক্রমণ, মহম্মদ-বিন-কাশিমের অভিযান, সিন্ধু ও মুলতান জয়, ভারতীয় রাজাদের বাধা প্রদান ও আরব শক্তির পতন সম্পর্কে জানবো।
ভারতে আরব অভিযান
ঐতিহাসিক ঘটনা | আরব অভিযান |
খলিফা | ওমর |
ইরাকের রাজা | হজ্জাজ |
সিন্ধুর রাজা | দাহির |
সিন্ধু জয় | ৭১২ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের দেহত্যাগ হলে খলিফাগণ ইসলামের নেতৃত্ব দেন। খলিফাগণের প্রভাবে ইসলামের রাজ্য বিস্তারের দিকে কাজ আরম্ভ হয়। আরব জাতি ইসলামে দীক্ষিত হয়ে নব উন্মাদনায় রাজ্য জয়ে বেরিয়ে পড়ে।
খলিফা ওমরের আমলে অভিযান
- (১) হজরত মহম্মদের মৃত্যুর কিছু পরে খলিফা ওমরের শাসনকালে (৬৩৪-৪৪ খ্রি) ভারতে প্রথম আরব অভিযান আরম্ভ হয়। ওমরের আদেশে অন্তত তিনটি নৌ অভিযান বোম্বাইয়ের থানা, ভারুচ বন্দর ও সিন্ধুর দেবল বন্দর আক্রমণ করে। এই অভিযানগুলিতে আশানুরূপ ফল না হলে ওমর এই অভিযান রদ করেন।
- (২) এর পর আরব আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় স্থলপথে উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথ ধরে পরিচালিত হয়। খলিফার নির্দেশে আরব-বাহিনী কাবুলের পথে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করে। আরবদের মতে, এই অঞ্চলের নাম ছিল কাবুল ও জাবুল। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রবল বাধার ফলে আরবরা বেশীদুর এগোতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই অভিযান পরিত্যক্ত হয়। এভাবে আরব আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হয়।
মাকরান অভিযান
এর পর আরবরা পথ পরিবর্তন করে মাকরান বা বালুচিস্থানের পথে ভারতে অভিযান চালায়। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরব সেনাপতি আবদুল্লাহ মাকরান অভিযান আরম্ভ করেন। মাকরান অধিকার করার ফলে সিন্ধুর দরজা আরবদের কাছে খুলে যায়।
বোলান অভিযান
৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আলির শাসনকালে বোলান গিরিপথ দিয়ে মধ্য সিন্ধুতে আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। আরবরা সিন্ধুর উত্তরাঞ্চলে কিকান পর্যন্ত এগিয়ে আসে। কিন্তু স্থানীয় জাটদের বাধায় এই অভিযান বিফল হয়।
হজ্জাজের সিন্ধু আক্রমণ
- (১) ইরাকের আরব শাসনকর্তা হজ্জাজ ৭০৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় সিন্ধু অভিযান আরম্ভ করেন। একটি ঘটনাকে উপলক্ষ করে হজ্জাজ এই আক্রমণ আরম্ভ করেন। সিংহলের রাজা উপঢৌকন সহ একটি জাহাজ হজ্জাজের কাছে পাঠান। কিন্তু সিন্ধুর দেবল বন্দরের কাছে জলদস্যুরা এই জাহাজ লুঠ করে।
- (২) হজ্জাজ এজন্য সিন্ধুর রাজা দাহিরকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ চান। দাহির ক্ষতিপূরণ না দিলে তার বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান হয়। এ সম্পর্কে অন্য একটি মত হল এই যে, ভারত থেকে ক্রীতদাসী ও বিলাস দ্রব্য কেনার জন্য হজ্জাজ ধনরত্ন নিয়ে জাহাজ পাঠান। জাহাজটি দেবল বন্দরে লুঠ হয়। যাই হোক এটি ছিল একটি উপলক্ষ। আসলে সিন্ধু দেশের ওপর আরবরা দীর্ঘদিন ধরে আক্রমণ চালাচ্ছিল। এই আক্রমণ ছিল তারই অঙ্গ।
মহম্মদ-বিন-কাশিমের অভিযান
- (১) হজ্জাজ প্রথম দুটি অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিমের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অভিযান পাঠান। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ কাশিম দেবল অধিকার করে নাগরিকদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন।
- (২) তিনি দেবলে ৪০০ মুসলিমকে বসবাস করান। দেবল শহরের বৌদ্ধরা তাকে বিশেষ সাহায্য করেন। মোকা নামে স্থানীয় প্রভাবশালী সামন্ত ও তার পরিবারবর্গ মহম্মদ কাশিমকে বিশেষ সাহায্য করেন।
সিন্ধু ও মুলতান জয়
- (১) এর পর মহম্মদ কাশিম সিন্ধু নদ পার হওয়ার চেষ্টা করলে, রাওর নামে এক স্থানে সিন্ধুরাজ দাহির তাঁকে বাধা দেন। ঘোরতর যুদ্ধের পর দাহির নিহত হন। দাহিরের পত্নী রাণীবাঈ রাওর দুর্গ রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জওহর ব্রত পালন করেন। কাশিম রাওয়ার দুর্গ দখল করেন।
- (২) দাহিরের পুত্র জয়সিংহ আরবদের ব্রাহ্মণাবাদ ও আলোর নামক স্থান থেকে বাধা দেন। কিন্তু জয়সিংহের মন্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতায় আলোরের পতন ঘটে। ব্রাহ্মণাবাদও আরবদের দখলে চলে যায়। ক্রমে মূলতান অঞ্চলও আরবদের হাতে চলে যায়।
- (৩) মূলতানী বণিক ও কারিগররা বিনা যুদ্ধে ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করে। মহম্মদ সিন্ধুর অধিকৃত অঞ্চলে আরব শাসন প্রবর্তন করেন। যারা ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেননি তাদের জিজিয়া কর দিয়ে আদায় সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকার দেওয়া হয়।
জুনাইদ
- (১) ইতিমধ্যে হজ্জাজের মৃত্যু হলে খলিফার নির্দেশে মহম্মদ কাশিম স্বদেশে ফিরে যান। তিনি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। মহম্মদের পর সিন্ধুর আরব শাসনকর্তা ছিলেন জুনাইদ। তিনি দাহিরের পুত্র জয়সিংহকে নিহত করে সমগ্র সিন্ধু অধিকার করেন।
- (২) তিনি খলিফার নির্দেশে ঘোষণা দেন যে, যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন তারা নিজ নিজ রাজ্য বা সম্পত্তির অধিকার পাবেন। এর ফলে বহু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। জুনাইদ সিন্ধু অঞ্চল থেকে ভারতের অন্যান্য স্থানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। তিনি রাজপুতানার মধ্য দিয়ে মালব ও ভারুচ অধিকারের চেষ্টা করেন।
ভারতীয় রাজাদের বাধা প্রদান
- (১) আরবদের রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা আদপেই সফল হয়নি। গুজরাটের চালুক্য, রাজপুতানার প্রতিহার ও কাশ্মীরের কার্কট বংশ প্রবল বাধা দিয়ে আরব অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। প্রতিহার নাগভট্ট আরবদের বহু ক্ষয়ক্ষতি করেন।
- (২) আরবদেশে আব্বাসীয় খলিফার শাসন স্থাপিত হলে সিন্ধুর পথে রাজ্য বিস্তারের জন্য শেষ চেষ্টা করা হয়। আরবরা সিন্ধু থেকে মধ্য প্রদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং উজ্জয়িনী নগরীর কাছে চলে আসে। কিন্তু স্থানীয় রাজাদের তীব্র বাধার ফলে শীঘ্রই আরবদের দম ফুরিয়ে যায়।
আরব শক্তির পতন
এদিকে আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটলে সিন্ধুদেশে আরবদের শক্তি কমে যায় এবং আরব শক্তির পতন ঘটে
উপসংহার :- আব্বাসীয় খলিফার পতনের পর সিন্ধুর আরব শাসনকর্তারা কিছুকাল স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। কিন্তু মূলতান ও ব্রাহ্মণাবাদের আরব শাসনকর্তাদের মধ্যে ঝগড়ার ফলে সিন্ধুতে আরব শক্তির পতন ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রতিহার আক্রমণের ফলে আরব রাজ্য বিধ্বস্ত হয়।
(FAQ) ভারতে আরব অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
খলিফা ওমরের আমলে।
হজ্জাজ ৭০৮ খ্রিস্টাব্দে।
জাহির।
৭১২ খ্রীস্টাব্দে।