হজরত মহম্মদ

বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ প্রসঙ্গে তার জন্ম, শৈশবকাল, মদিনা গমন, বিবাহ, নবুয়্যত লাভ, ইসলাম প্রচার, কোরায়েশদের বিরোধিতা, মদিনার সনদ, মক্কা গমন ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ

ঐতিহাসিক চরিত্রহজরত মহম্মদ
জন্ম২৯ আগস্ট, ৫৭০ খ্রি:
মাতাআমিনা
পিতাআবদুল্লাহ
বিশেষ পরিচিতিবিশ্বনবী
মৃত্যু৭ জুন, ৬৩২ খ্রি:
বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ

ভূমিকা :- যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এই ধরা পৃষ্ঠের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না, যার পদচারণ ধন্য হয়েছে পৃথিবী, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, ক্ষমা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আমানতদারী, সুরুচি পূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ; যিনি ছিলেন একাধারে এতীম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত; যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, মহৎ রাজনীতিবিদ এবং সফল রাষ্ট্র নায়ক; তিনি হলেন সর্বকালের সর্বযুগের এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ।

হজরত মহম্মদের আবির্ভাবের সমকাল

তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল।

হজরত মহম্মদের জন্ম

৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট সোমবার প্রত্যূষে আরবের মক্কা নগরীতে সম্ভ্রান্ত কোরায়েশ বংশে মাতা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন।

হজরত মহম্মদের শৈশবকাল

আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বনী সাদ গোত্রের বিবি হালিমার উপর। এই সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্র সন্তান ছিল, যার দুধ পানের মুদ্দত তখনো শেষ হয় নি।

বিবি হালিমার বর্ণনায় হজরত মহম্মদ

বিবি হালিমা বর্ণনা করেন, “শিশু মহম্মদ কেবলমাত্র আমার ডান স্তনের দুধ পান করত। আমি তাঁকে আমার বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না। আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুই ভাইয়ের জন্যে রেখে দিতেন। দুধ পানের শেষ দিবস পর্যন্ত তাঁর এই নিয়ম বিদ্যমান ছিল।” ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়ে দিয়েছেন।

হজরত মহম্মদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন

মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রী মা হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মাতা আমিনার গৃহে।

হজরত মহম্মদের মদিনা গমন

৬ বছর বয়সে তিনি মাতা আমিনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা যান এবং মদীনা হতে প্রত্যাবর্তনকালে ‘আবহাওয়া’ নামক স্থানে মাতা আমিনা মৃতৃবরণ করেন। এরপর এতীম মহম্মদের লালন পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্রমান্বয়ে দাদা আবদুল মোত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের উপর।

হজরত মহম্মদের ‘আ আমীন’ উপাধি লাভ

পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত হিসেবে; তিনি হলেন আজনা এতীম এবং দুঃখ বেদনার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে উঠেন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং আমানতদারী হিসেবে। তাঁর চরিত্র, আমানতদারী, ও সত্যবাদিতার জন্য আরবের কাফেররা তাঁকে, ‘আ আমীন’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

হজরত মহম্মদের ব্যথা অনুভব

তৎকালীন আরবে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ‘হরবে ফুজ্জার’ এর নৃশংসতা বিভীষিকা ও তান্ডবলীলা দেখে বালক মহম্মদ দারুণভাবে ব্যথিত হন।

হজরত মহম্মদের সমাজ সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা

৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চাচা হজরত যুবায়ের ও কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে অসহায় ও দূর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে তোলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন। বালক মহম্মদ ভবিষ্যতে জীবনে যে শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত হবেন এখানেই তার প্রমাণ মেলে।

হজরত মহম্মদের বিবাহ

যুবক মহম্মদের সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা চেতনা, কর্ম দক্ষতা ও ন্যায় পরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ও বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ বিবাহের প্রস্তাব দেন। এ সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং হজরত মহম্মদের বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে বিবি খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিবাহের পর বিবি খাদিজা তাঁর ধন-সম্পদ হজরত মহম্মদের হাতে তুলে দেন।

ধ্যানমগ্ন হজরত মহম্মদ

তৎকালীন আরবের কাফের, মুশরিক, ইহুদি, নাসারা ও অন্যান্য ধর্ম মতাবলম্বীদের অন্যায়, জুলুম, অবিচার, মিথ্যা ও পাপাচার দেখে হজরত মহম্মদের হৃদয় দুঃখ বেদনায় ভরে যেত এবং পৃথিবীতে কিভাবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে চিন্তায় তিনি প্রায়ই মক্কার অনতিদূরে ‘হেরা’ নামক পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন।

বিবি খাদিজা কর্তৃক হজরত মহম্মদকে পূর্ণ সুযোগ প্রদান

বিবি খাদিজা স্বামীর মহৎ প্রতিভা ও মহান ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে হজরত মহম্মদকে নিশ্চিত মনে অবসর সময় ‘হেরা’ পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন। 

হজরত মহম্মদের নবুয়্যত লাভ

তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন এবং তাঁর উপর সর্ব প্রথম নাজিল হয় পবিত্র কোরআনের সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। এরপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রয়োজন অনুসারে তাঁর উপর পূর্ণ ৩০ পারা কোরআন শরীফ নাজিল হয়।

গোপনে হজরত মহম্মদের ইসলাম প্রচার

নবুয়্যত প্রাপ্তির পর প্রথম প্রায় ৩ বছর তিনি গোপনে স্বীয় পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। সর্ব প্রথম ইসলাম কবুল করেন বিবি খাদিজা।

হজরত মহম্মদের প্রতি কোরায়েশদের বিরোধিতা

যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং ঘোষণা করেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ তখন মক্কার কোরায়েশ কাফেররা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করে। এতদিন বিশ্বনবী কোরায়েশদের নিকট ছিলেন ‘আল আমীন’ হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এই ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি হলেন কোরায়েশ কাফেরদের ভাষায় একজন জাদুকর ও পাগল।

হজরত মহম্মদের প্রতি লোভ প্রর্দশন

যেহেতু কোরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং আরববাসীদের ভাষাও ছিল আরবী, তাই তারা হজরত মহম্মদের বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মহম্মদ যা প্রচার করছেন তা কোনো সাধারণ কথা নয়। যদি এটা মেনে নেওয়া হয় তাহলে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকে থাকবে না। তাই তারা হযরত মহম্মদকে বিভিন্ন ভয়, ভীতি, হুমকি; এমনকি ধন-দৌলত ও আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবতী নারীদের দেবার লোভ দেখাতে শুরু করে।

হজরত মহম্মদের ঘোষণা

মহম্মদ কাফেরদের শত ষড়যন্ত্র ও ভয়-ভীতির মধ্যেও ঘোষণা করেন, “আমার ডান হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে চাঁদও দেওয়া হয়, তবু আমি সত্য প্রচার থেকে বিরত থাকব না।” কাফেরদের কোনো লোভ লালসা বিশ্বনবীকে ইসলাম প্রচার থেকে বিন্দুমাত্র বিরত রাখতে পারে নি।

কোরায়েশদের অত্যাচার

মক্কায় যারা পৌত্তলিকতা তথা মূর্তি পূজা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কোরায়েশরা তাঁদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু ইসলামের শাশ্বত বাণী যারা একবার গ্রহণ করেছে তাঁদেরকে শত নির্যাতন করেও ইসলাম থেকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারে নি।

হজরত মহম্মদের স্ত্রী ও চাচার মৃত্যু

৬২০ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদের জীবন সঙ্গিনী বিবি খাদিজা এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চাচা আবু তালিব মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তে তাদেরকে হারিয়ে বিশ্বনবী শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বিবি খাদিজা ছিলেন বিশ্বনবীর দুসময়ের সঙ্গী, উপদেষ্টা এবং বিপদ আপদে সান্ত্বনা স্বরূপ। চাচা আবু তালিব ছিলেন শৈশবের অবলম্বল, যৌবনের অভিভাবক এবং পরবর্তী নবুয়্যত জীবনের একনিষ্ঠ সমর্থক।

হজরত মহম্মদের তায়েফ গমন

ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র হজরত যায়েদ বিন হারেসকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফ গমন করলে সেখানেও তিনি তায়েফবাসীদের কর্তৃক নির্যাতিত হন। তায়েফবাসীরা প্রস্তরাঘাতে বিশ্বনবীকে জর্জরিত করে ফেলে।

ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে হজরত মহম্মদের আত্মনিয়োগ

৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই নবুয়্যতের ত্রয়োদশ বছরের মধ্যে মদীনায় ইসলামী আন্দোলনের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। মদীনাবাসীগণ মহম্মদের কার্যপদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। এতদিন মক্কায় ইসলাম ছিল কেবলমাত্র একটি ধর্মের নাম; কিন্তু মদীনায় এসে তিনি দৃঢ় ভিত্তির উপর ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

মদীনার সনদ

তিনি মদিনায় চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দেন। সেই সময় মদীনায় পৌত্তলিক ও ইহুদিরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। মহম্মদ মনে প্রাণে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় লোকের বাস সেখানে সকল সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি সেখানে সকল সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আন্তর্জাতিক সনদপত্র ও সাক্ষরিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে, ‘মদীনার সনদ’ নামে পরিচিত।

প্রথম লিখিত সংবিধান

পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ ছিল প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়। মহম্মদ হন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সভাপতি। তিনি যে একজন দূরদর্শি ও সফল রাজনীতিবিদ এখানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

হজরত মহম্মদ কর্তৃক উদারতার মাধ্যমে ইসলামের প্রতিষ্ঠা

মদীনার সনদ নাগরিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থাপিত হয় ঐক্য। বিশ্বনবী তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন নি বরং উদারতার মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।

হজরত মহম্মদের প্রতি ষড়যন্ত্র

তাঁর ও নবদিক্ষিত মুসলমানগণের (সাহাবায়ে কেরাম) চালচলন, কথাবার্তা, সততা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে যখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল তখন কোরায়েশ নেতাদের মনে হিংসা ও শত্রুতার উদ্রেক হয়। অপরদিকে মদীনার কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মহম্মদের প্রাধান্য সহ্য করতে না পেরে গোপনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

হজরত মহম্মদের তলোয়ার ধারণ

কাফেরদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্যই মহম্মদ তলোয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে ঐতিহাসিক বদর, উহুদ ও খন্দক সহ অনেকগুলো যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং সকল যুদ্ধের প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানগণ জয়লাভ করেন। বিশ্বনবী মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

হজরত মহম্মদের মক্কা গমন

৬২৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মহম্মদ মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন।

কোরায়েশ বাহিনী ও হজরত মহম্মদের মধ্যে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’

পথিমধ্যে কোরায়েশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।

‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র শর্ত

সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে উল্লেখ ছিল যে-

  • (১) মুসলমানগণ এই বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে,
  • (২) আগামী বছর হজে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না,
  • (৩) যদি কোন কাফের স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদীনায় গমন করে তাহলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদীনা হতে যদি কোনো ব্যক্তি পলায়ন পূর্বক মক্কায় চলে আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না,
  • (৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় বসবাস করছে তাদের কাউকে সাথে করে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর মুসলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না।। আর মুসলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না,
  • (৫) আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর এই স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমনি ও কাফের) মাঝে যাদের সঙ্গে ইচ্ছে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে,
  • (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে।

হজরত মহম্মদের নির্দেশ

কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসূলল্লাহ’ বাক্য দু’টি কেটে দেওয়ার জন্য দাবি করেছিল। কিন্তু সন্ধি পত্রের লেখক হজরত আলী তা মেনে নিতে রাজি হলেন না। অবশেষে বিশ্বনবী সুহায়েল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দু’টি নিজ হাতে কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’ লেখার নির্দেশ দেন।

‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র গুরুত্ব

বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই সন্ধি মুসলমানদের জন্য অপমানজনক হলেও তা মহম্মদকে অনেক সুযোগ সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল। যেমন –

  • (১) এই সন্ধির মাধ্যমে কোরায়েশরা মহম্মদের রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
  • (২) সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
  • (৩) এই সন্ধির পরই মহম্মদ বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
  • (৪) মহম্মদ যেখানে মাত্র ১৪০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে হুদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ অষ্টম হিজরীতে ১০,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।
  • (৫) যে মক্কা থেকে বিশ্বনবী নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হয়েছিলেন, সেখানে আজ তিনি বিজয়ের বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন।

হজরত মহম্মদ কর্তৃক শত্রুকে ক্ষমা প্রদর্শন

মক্কা বিজয়ের দিন হজরত ওমর ফারুক কোরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানকে গ্রেফতার করে মহম্মদের সম্মুখে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার এই মহান আদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান। সকল অন্যায় অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত।

হজরত মহম্মদ কর্তৃক বিদায় হজের ভাষণ

৬৩১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক দশম হিজরীতে মহম্মদ লক্ষাধিক মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ সম্পাদক করেন এবং হজ শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবীর সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন যা ইসলামের ইতিহাসে “বিদায় হজের ভাষণ” নামে পরিচিত।

বিদায় হজের ভাষণে হজরত মহম্মদের ঘোষণা

বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশ্বনবী মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন,

  • (১) হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এই দিন, এই মাস এবং এই পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তেমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট কখনো অন্যের উপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না।
  • (২) মনে রেখ, স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের উপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে।
  • (৩) সাবধান, শ্রমিকের মাথায় ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দিবে।
  • (৪) মনে রেখ, যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না।
  • (৫) চাকর চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না। তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তাই খেতে দিবে; তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দিবে।
  • (৬) কোন অবস্থাতেই এতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। এমনি ভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে পেশ করে যান।

উত্তম চরিত্রের অধিকারী হজরত মহম্মদ

তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্ব জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত।

হজরত মহম্মদের আমুল সংস্কার সাধন

বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ তাঁর নবুয়্যতের ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সাধিত হয়।

রাজনীতির ক্ষেত্রে হজরত মহম্মদের অবদান

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দিয়ে, তিনি ঘোষণা করেন, ‘অনারবের উপর আরবের এবং আরবের উপর অনারবের; কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো পার্থক্য নেই। বরং তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে অধিক মুত্তাকিন।

অর্থনীতিতে হজরত মহম্মদের অবদান

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সুদকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জাকাত ভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছিল।

সমাজ ব্যবস্থায় হজরত মহম্মদের অবদান

সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর কোনো মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। বিশ্বনবী নারী জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং ঘোষণা করলেন “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।” নারী জাতিকে শুধু মাত্র মাতৃত্বের মর্যাদাই দেন নি, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারকে করেছেন সমুন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ক্রীতদাস আযাদ করাকে তিনি উত্তম ইবাদত বলে ঘোষণা করেন।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে হজরত মহম্মদের অবদান

ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেখানে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা এবং বিভিন্ন বস্তুর পূজা আরববাসীদের জীবনকে কলুষিত করেছিল সেখানে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন। মোট কথা তিনি এমন একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোনো হানাহানি, রাহাজানি, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ ঘুষ ইত্যাদি ছিল না।

হজরত মহম্মদের মৃত্যু

অবশেষে এই মহামানব ১২ রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরী মোতাবেক ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মহম্মদ

তিনি হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। পৃথিবীর বুকে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না।

মুসলিম জাতির উদ্দেশ্যে হজরত মহম্মদের ঘোষণা

বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ সমগ্ৰ মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছেন, “আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা এই দু’টি জিনিসকে আঁকড়ে রাখবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হল আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হল আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস।

হজরত মহম্মদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক মুরের মন্তব্য

বিশ্বনবীর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিস্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, “He was the mastermind not only of his own age but of all ages” অর্থাৎ মহম্মদ যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।

হজরত মহম্মদ সম্পর্কে মনীষীদের মূল্যবান বাণী

শুধুমাত্র ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুরই নন, পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ সম্পর্কে তাদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন।

উপসংহার :- পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হজরত মহম্মদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” বর্তমান অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্ব মুখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হজরত মহম্মদের আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব।

(FAQ) বিশ্বনবী হজরত মহম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিশ্বনবী কাকে বলা হয়?

হজরত মহম্মদ।

২. হজরত মহম্মদের জন্ম কখন হয়?

৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট।

৩. হজরত মহম্মদের মায়ের নাম কি?

আমিনা বেগম।

৪. হজরত মহম্মদ কাকে বিবাহ করেন?

খাদিজা বিবি।

৫. হজরত মহম্মদের মৃত্যু কখন হয়?

৭ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে।

Leave a Comment